কুরবানির সময় সতর্কতা: সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য, এর কারণ ও প্রতিকার

কুরবানির ঈদের সময় এমন কি বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের পর কিছু মানুষ সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভোগেন এবং এই নিয়ে পরামর্শ চেয়ে থাকেন। তাই সবার জানার জন্য আজকের এই লেখা।

কোষ্ঠকাঠিন্য শব্দটি একেকজনের কাছে একেক রকম অর্থবহন করে, কারো কাছে প্রতিদিন নিয়মিত পায়খানা না হলে কোষ্ঠকাঠিন্য মনে হয়, আবার কারো কাছে খুব শক্ত পায়খানা হলে কিংবা পায়খানা করতে গেলে বল প্রয়োগ করতে খুব সময় ব্যয় হলে, তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য হিসাবে মনে হয়।

কোষ্ঠকাঠিন্য
কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে খুব শক্ত পায়খানা হওয়া, কিংবা সপ্তাহে তিনবারের কম পায়খানা হওয়া কিংবা পায়খানা করতে প্রচুর সময় ব্যয় হওয়া, খুব জোরাজুরি কিংবা বল প্রয়োগ করে কিংবা মলদ্বারে আংগুল প্রবেশ করিয়ে মলাশয় খালি করা, পায়খানা করার পর মনে হওয়া যে, মলাশয় খালি হয় নাই।

প্রকারভেদ
১। Acute Constipation বা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য
২। Chronice Constipation বা দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য

আজ একিউট কিংবা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবো।

সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য
যদি অল্প কয়েক দিনের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্যতার উপসর্গ দেখা দেয়, অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যতার সময় যদি ৩ মাসের কম হয়, তাহলে এই অবস্থাকে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা বলে।

উদাহরণ স্বরুপ, কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রচুর পরিমান গোস্থ খেয়ে আসছে, এর পর দেখা গেলো দুই-তিন দিন পায়খানা হচ্ছেনা কিংবা খুব শক্ত অল্প অল্প পায়খানা হচ্ছে, তাহলে এই অবস্থাকে Acute constipation বলে।

অথবা দেখা গেলো, প্রতিদিন তিন বেলায় গোস্ত মাছ ডিম ইত্যাদি দিয়ে ভাত খাচ্ছে, তাই নিয়মিত পায়খানা হচ্ছে না, হলেও শক্ত পায়খানা হচ্ছে, কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যতা উপসর্গ দেখা দিছে, তা যদি ৩ মাসের কম সময় হয়ে থাকে, তাহলে এইটাকে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হবে।

অথবা দেখা গেলো, সারা বছর সুস্থ, কুরবান ঈদের দিন প্রচুর পরিমান গোস্ত খেলো, ঈদের পরদিন বিভিন্ন আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে সেখানেও গোস্ত খেলো, বাসায় বাথরুমে এসে পায়খানা করতে গিয়ে দেখে পায়খানা হচ্ছেনা, পেট ফুলে যাচ্ছে, পেটে ব্যাথা হচ্ছে, তবে এই অবস্থাকেও Acute Constipation বলবে।

সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতার উপসর্গ
১। পায়খানার নরমাল রুটিন পরিবর্তন হয়ে যাবে
২। শক্ত পায়খানা হবে
৩। পায়খানার সময় মলাশয়ে ব্যথা হবে
৪।পায়খানা করতে গেলে জোর প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় হবে
৫। পায়খানা অল্প অল্প হতে পারে
৬। পেট ফুলে যেতে পারে
৭। পেটে ব্যথা হতে পারে
৮। কিছুক্ষন পরপর বায়ু ত্যাগ হতে পারে
৯। খাওয়ার রুচি কমে যাবে
১০। দুশ্চিন্তা ও অবসাদগ্রস্ত মনে হতে পারে
১১। স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটবে

জটিলতা
১। হেমোরয়েড বা পাইলস: পায়ুপথের আশেপাশের রক্তনালী সমূহে প্রদাহ হতে পারে এবং পায়খানা করার সময় পায়ুপথে রক্ত যেতে পারে, এমনকি ব্যথাও হতে পারে, পায়ু পথে চুলকানি দেখা দিতে পারে
২। এনাল ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে
৩। ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স দেখা দিতে পারে

কারণ
Acute constipation বা সাময়ীক কোষ্ঠকাঠিন্যতা মূলত অস্বাভাবিক লাইফ স্টাইলের কারণে দেখা দেয়। যথা –
১। আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া তথা শাক সবজি কম খাওয়া
২। নিয়মিত পায়খানা না করা, পায়খানা আটকিয়ে রেখে কাজ কর্ম করা
৩। নিয়মিত খাবার না খাওয়া
৪। পরিমিত ঘুম না যাওয়া, চিন্তা অবসাদগ্রস্ত থাকা ইত্যাদি
৫। আইবিএস এর সমস্যা থাকা
৬। মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যথা- ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, এন্টি স্পাজমোডিক, এন্টি ডায়েরিয়াল ড্রাগস, আয়রন ট্যাবলেট, এলুমিনিয়াম যুক্ত এন্টাসিড ইত্যাদি
৭। দৈনিক অত্যাধিক পরিমান প্রোটিন খাওয়া,
যথা অধিক পরিমান গোস্ত খেলে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা দেখা দিবে

দৈনিক প্রোটিনের পরিমান কতটুকু হওয়া চাই?
Institue of Medicine USA এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদা হচ্ছে ১ গ্রাম/কেজি বডি ওয়েট, অর্থাৎ একজন মানুষের ওজন যদি ৬০ কেজি হয়ে থাকে, আর সে যদি ভারি কোনো কাজ না করে, তাহলে তার দৈনিক প্রোটিন দরকার পড়ে ৬০ গ্রাম। আর ভারি কাজ করলে আরো ৩০ গ্রাম বাড়বে, অর্থাৎ ৯০ গ্রাম প্রোটিন দরকার। এইটা হচ্ছে স্বাভাবিক শারিরীক ক্রিয়া প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য প্রয়োজনিয় প্রোটিন। তবে একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক সর্বোচ্চ ২ গ্রাম /কেজি বডি ওয়েট করে প্রোটিন খেতে পারবে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত। সুতরাং একজন ৬০ কেজি ওজনের মানুষ দৈনিক সর্বোচ্ছ ১২০ গ্রাম প্রোটিন খেতে পারবে কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া ব্যতিত। এর চেয়ে বেশি খেলে ডায়েরিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।

প্রোটিনের উপাদান হচ্ছে গোস্ত, মাছ, ডিম ইত্যাদি
এবার বুঝে নিই, ১২০ গ্রাম প্রোটিন খেতে পারলে
কতগ্রাম গোস্ত খাওয়া যাবে?

আমরা অনেকে মনে করে থাকি যে, এক গ্রাম গোস্ত মানে এক গ্রাম প্রোটিন, এইটা সঠিক না, আমেরিকার ইন্সটিটিউট অফ মেডিসিনের তথ্য অনুযাই ১০০ গ্রাম রান্না করা গোস্তের মাঝে
২৬ গ্রাম প্রোটিন,
১০ গ্রাম ফ্যাট,
৬১-৬৩ গ্রাম ওয়াটার থাকে।

তার মানে গোস্ত থেকে ২৬ গ্রাম প্রোটিন পেতে হলে
১০০ গ্রাম গোস্তের প্রয়োজন, তথা ১ গ্রাম প্রোটিনের জন্য প্রায় ৪ গ্রাম গোস্তের দরকার। আমরা একটু আগে জেনেছি, একজন ৬০ কেজি ওজনের সুস্থ লাইট ওয়ার্কার মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদা হচ্ছে ৬০ গ্রাম, সুতরাং সে স্বাভাবিক গোস্ত থেকে সেই পরিমান প্রোটিন নিতে চাইলে ৬০*৪=২৪০ গ্রাম গোস্ত খেলেই যথেষ্ট।

আবার ৬০ কেজি ওজনের মানুষ দৈনিক সর্বোচ্ছ
১২০ গ্রাম প্রোটিন কিংবা ৪৮০ গ্রাম গোস্ত খেতে পারবে। তবে তা হতে হবে তিন বেলায় ভাগ করে অল্প অল্প করে, অন্যথায় Malabsorption syndrome কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিবে। আবার অনেকের ক্ষেতে ২০০ গ্রামের বেশি গোস্ত খেলেও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।

ম্যানেজমেন্ট
১। লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা যায়
২। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমান শাক সবজি খাবে
৩। পর্যাপ্ত পানি পান করবে
৪। ফাস্টফুড জাতীয় খাবার কম খাবে
৫। অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার পরিহার করবে
৬। অত্যাধিক গোস্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকবে
৭। দৈনিক ১০০-১৫০ গ্রামের চেয়ে বেশি গোস্ত না খাওয়া
৮। নিয়মিত ইসবগুলের শরবর বানিয়ে খাবে
৯। সম্ভব হলে প্রতিদিন আপেল খাবে, আপেলে পর্যাপ্ত ফাইবার রয়েছে
১০। নিয়মিত ব্যায়াম করবে, পর্যাপ্ত ঘুম যাবে

অবশ্যই যেটা খেয়াল রাখবেন
যেদিন বেশি পরিমানে গোস্ত খাবে, সেদিন গোস্তের সাথে শাক সবজি, গাজর, শষা ইত্যাদি খাবে এবং
সকাল, দুপুর, রাত্রে এক গ্লাস করে ইসবগুলের শরবত খাবে। প্রতি গ্লাসে দুই টেবিল চামচ ইসবগুলের ভূসি দিবে। এতে করে কোলনের মধ্যে কিছু পরিমান পানি রিটেনশন হবে এবং পায়খানা তরল থাকবে, কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা পাবে। এবং যারা নিয়মিত ইসবগুলের শরবত খায়, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যতার প্রবণতা ৯০% কমে যাবে।

চিকিৎসা
১। Acute constipation এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পেশেন্ট কে কাউন্সেলিং করবে। তাকে লাইফ স্টাইল পরিবর্তনের গুরুত্ব সমপর্কে বুঝাবে। রোগী কোনো মেডিসন চাইলে তাকে Bulk forming Laxative তথা Ispaghula Husk দিবে। এতে কাজ না হলে অসমোটিক ল্যাক্সাটিভ যথা ল্যাক্টুলোজ সিরাপ ইত্যাদি দিবে।

২। যদি কারো sudden acute severe constipation দেখা দেয়, সেই ক্ষেত্রে তাকে লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি উপসর্গ ভালো করতে Osmotic Laxative Lactulose দেওয়া যেতে পারে, পায়খানা না হবার কারণে পেট ফুলে থাকলে Glycerol suppository দেওয়া যেতে পারে, এতে করে ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে পায়খানা হবে, পেট খালি হয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।

৩। ছোট বাচ্ছাদের কে Magnesium Hydroxide সিরাপ বাজারে Magmil নামে পাওয়া যায় দেওয়া যেতে পারে।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হচ্ছে সবসময় ইসবগুল এর শরবত খেতে বলবে।

ডা. ইসমাইল আযহারি
DCMC/2013-14

প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সামিউন ফাতীহা
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

Methotrexate এবং Anaemia সম্পর্ক

Sun Aug 11 , 2019
হয়তো অনেকেই  Methotrexate  মেডিসিনের নাম শুনেছেন, Disease Modifying Anti Rheumatic Drugs হিসাবে এইটা ব্যবহার হয়।। আবার এই ড্রাগসকে  এন্টি ক্যান্সার ড্রাগ হিসাবেও বিবেচনা করা হয়,সোরিয়াসিস আর রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং সোরিয়াটিক আর্থাইটস, জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস ইথ্যাদি রোগে  এই মেডিসিন দেওয়া হয়, মোটামুটি ৩ সপ্তাহ এই মেডিসিন ব্যবহার করলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস জনিত জয়েন্ট […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo