করোনা মহামারী শেষে ডাক্তাররা যথাযথ মর্যাদা পাবেন তো!

মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০

 

ডা. রোমেল সারওয়ার

 

কোভিড-১৯ মানবসমাজকে খুব করুণ কিছু মানবিক সমস্যার সম্মুখীন করেছে। অসুস্থ প্রিয়জনকে দেখতে না যাওয়া, এমনকি তার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে না যাওয়া। তার পরিবারের কাছে না যেতে পারার মত ব্যাপারগুলো মানব ইতিহাসে খুব বেশী নাই। ইউরোপ, আমেরিকার কথা শুনছি, আত্মীয়স্বজন নয়, ফিউন্যারাল হোমই শেষকৃত্য করছে! শেষ দেখাও হয়তো নিকটাত্মীয়রা দেখছে না! গল্পগুলো এই উপমহাদেশেও আছে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী একাই শেষকৃত্য করছেন।

বাবা/ মা’র মৃত্যুর পর সন্তান বা আত্মীয়রা হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, এমন ঘটনা শুনছি ও দেখছি! এমন অমানবিক পৃথিবীর গল্প, এমনকি অনেক যুদ্ধকালেও দেখা যায়নি। পুরো পৃথিবী এখন বিশাল এক মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছে, আমরা জানিও না এর শেষ কোথায়! সারা পৃথিবীতে চিকিৎসকেরা আছেন অন্য সমস্যায়। সৈন্যরা যেমন দেশরক্ষার শপথেই জীবন শুরু করেন এবং জানেন এতে তার মৃত্যুর আশংকা থাকলেও পিছিয়ে পড়া চলবে না। যেমন করে অগ্নিনির্বাপন কর্মীরা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই পেশায় আত্মনিয়োগ করেন, চিকিৎসাকর্মীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমনটা নয়।

কোনো কোনো সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঝুঁকি থাকলেও সেটা থেকে মুক্ত থাকার উপায়ও তাদেরই সবচেয়ে বেশী জানা। কোনও অসুখ বিশুখ হলে সবার আগে বুঝতে পারা, চিকিৎসা শুরু করা, কার কাছে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাবে সেটা অন্যদের চেয়ে ভাল জানা, আবার নিজের পরিচিত পরিবেশে চিকিৎসা পাওয়ার মত অসাধারন সুযোগটাও তারা পেয়ে যান। এভাবে নিজের বা পরিবারের অসুস্থতায় চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা একটা অগ্রিম সুবিধার অবস্থানে থাকেন। কিন্তু করোনা সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। চেষ্টা করেও তারা এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন না এবং দেখা যাচ্ছে চিকিত্সকরা একাই নয় পুরো পরিবার নিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত হাজারেরও বেশী চিকিৎসক এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ২২ জন বা তারও বেশী। তাদের বৃদ্ধ পিতা মাতার মৃত্যুর সংখ্যাটা এর চেয়েও বেশী এবং এই চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করতে গিয়েই মারা গেছেন, যেমন সৈনিকরা যুদ্ধে গিয়ে মারা যান।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বে আমাদের টিকাদান, ডায়রিয়া-কলেরা নিয়ন্ত্রন, বিস্তৃত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য থাকলেও, সার্ক দেশগুলোর মাঝে জনপ্রতি সবচেয়ে কম স্বাস্থ্যবাজেট, বিস্তৃত দূর্নীতি ও দূর্বল স্বাস্থ্যপ্রশাসন ইত্যাদি আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাতকে উন্মোচন করে দিয়েছে। আর এর বলি হচ্ছেন দেশের মানুষ ও চিকিৎসা কর্মীরা।

সবাই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে পারলেও চিকিৎসকেরা তা পারছেন না! সামাজিক দূরত্ব মেনে অনেক কিছু হলেও তো চিকিৎসা হয় না! টেলিমেডিসিনে কিছু কাজ হয়, কিন্তু এটাতো তো একটা অসম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তা কাজও করে না। মানুষ এখনো চায় চিকিৎসক তার অসুস্থ পেটে হাত রাখুক, হাত ধরে ভরসা দিক।

নিজের উদাহরন দিয়েই বলি। এক চিকিৎসকের বোনের ভাঙা পা প্লাস্টার করার ৫ দিন পর জানলাম, তার করোনা পজিটিভ। পরীক্ষার ফল আসতে লেগেছে ৫ দিন, এই সময়টা তো ভাঙা পা প্লাস্টার না করে রাখা যায় না। এক পুলিশ অফিসারের নয় বছরের মেয়ের ফ্র্যাকচার ডিসলোকেশন ( Elbow Dislocation with Radial Neck Fracture) অপারেশনের পর জানা গেল সে করোনা পজিটিভ! অর্থোপেডিক সার্জনরা জানেন, এই অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা করতে হবে। করোনা টেস্ট রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। দুটি ক্ষেত্রেই কারও করোনার কোন সিম্পটমস ছিল না। সাবধানতা নিয়েই কাজ করি। সবাই তাই করে। কিন্তু শেষ রক্ষা সব সময় হয় না এবং এভাবেই চিকিৎসকেরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন! এগুলো হচ্ছে জেনেশুনে আগুনে ঝাপ দেয়ার মত ব্যাপার! আর সঠিক ও মানসম্মত চিকিৎসা সামগ্রী না থাকায় বিপদ বাড়ছে অনেকগুন। এই জানা আগুনে ঝাপ দিয়েই একের পর এক চিকিৎসক ও তাদের পরিবারের মানুষেরা আত্মাহুতি দিচ্ছেন!

 ছবিঃ সংগৃহীত

আমি যেটা বুঝি, বাংলাদেশের প্রচলিত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এ ধরনের বিপদ থেকে মুক্তির উপায় নাই। নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম বা কিউবা কেন সফল, তা বিবেচনা করতে হবে। নিবেদিত প্রান, সৎ ও যোগ্য চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ মিলে যুগপোযোগী স্বাস্থ্যনীতি প্রনয়ন করতে হবে এবং তা করতে হবে এখনই ।

এই প্রিয় স্বদেশ ভূমি মানব ইতিহাসের বৃহত্তম এই মহামারীর বাকী সময় কিভাবে পাড়ি দিবে, তা বলা মুশকিল। তারপরও রয়ে গেছে সেকেন্ড ওয়েভ, থার্ড ওয়েভের মত বিষয়। তখন কি ঘটবে তা আল্লাহ মালুম !

করোনায় মৃত প্রথম চিকিৎসক ডা. মঈন ছিল আমার ছাত্র। বাকিদের অনেকেই ছিলেন আমার শিক্ষক বা পরিচিত। মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন বা ফিরে এসেছেন খুব ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও শিক্ষকেরা, অসুস্থ আছেন অগনিত বন্ধু, সহকর্মী বা ছাত্র।

আজকাল সারাক্ষণই অজানা আশংকায় দিন কাটে। অনেক নিদ্রাহীন রাত কাটে, যা আগে কখনো হয়নি! আজ যেমন আমি তাদের বা তাদের প্রিয়জনদের কথা বলছি, একদিন হয়ত অন্যকেউ আমার বা আমার পরিবারের কথা বলবে!

তারপর একসময় সব হারিয়ে যাবে!

‘হয়তোবা ইতিহাসে

তোমাদের নাম লেখা রবে না।

বড় বড় লোকেদের ভীড়ে,

জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে

তোমাদের কথা কেউ কবে না।

তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা

তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না

না, না, না, শোধ হবে না।’

পুনশ্চ:

বিশ্বাস হারাতে চাই না,

মানুষের ক্ষমতা অপরিসীম,

মানুষই একদিন করোনাকে পরাজিত করবে।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবা শুরু করলো জাপান ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল

Wed Jun 10 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১০ জুন ২০২০, বুধবার দেশজুড়ে চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতাল গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টর থেকে অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে এসেছে ৬৫০ শয্যাবিশিষ্ট জাপান ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বাংলাদেশ এর আইচি মেডিকেল গ্রুপ ২০১৬ তে জাপানের সাথে যৌথ চুক্তিতে জাপান ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর কার্যক্রম শুরু করে। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo