শুক্রবার ,০২ মে ২০২৫।
বাংলাদেশের কুমিল্লা ও রাজশাহীতে ছোঁয়াচে রোগ ‘স্ক্যাবিস’-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত এই দুই মহানগরের সরকারি হাসপাতালগুলোয় খোস-পাঁচড়া জাতীয় এ রোগে আক্রান্ত রোগীর ভীড় বাড়ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণ মানুষ অনেক সময় ‘স্ক্যাবিস’কে খোস-পাঁচড়া বলে উল্লেখ করে। গরমের সময়ে এই ছোঁয়াচে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও এখন সারা বছরই দেখা দেয়।
বিবিসি বাংলার বরাতে জানা গেছে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আমাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগে বয়স্ক ও শিশু মিলিয়ে প্রতিদিন পাঁচশো থেকে সাড়ে পাঁচশো রোগী আসে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে। আর এর মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু রোগীই হয় দেড়’শ থেকে পৌনে দুইশো। তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগী।”
শুধু কুমিল্লার এই উপজেলাই নয়, এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়টির মেডিকেল সেন্টারে গত এক সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন এ চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন।তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজশাহী শহরেও এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক মাশিউল আলম হোসেন।
তিনি বলেন, “এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহীর সমস্যা নয়, এটা গোটা বাংলাদেশেরই সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টারে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী পাচ্ছি। আগে প্রাইভেট চেম্বারে দিনে দুইজন এ রোগের রোগী পাওয়া গেলেও এখন দিনে পাঁচ-ছয়জন পাওয়া যাচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চর্ম রোগগুলোর মধ্যে এই ‘স্ক্যাবিস’ সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে। একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমণ দ্রুত হলেও রোগটি প্রতিরোধযোগ্য। তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে স্ক্যাবিসের কারণে কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। ফলে এ রোগে সংক্রমণের হার ঠেকাতে ওই ব্যক্তিরই শুধু নয়, বরং ওই পরিবার বা একই ঘরে অবস্থানকারী সব সদস্যদের একসাথে চিকিৎসা করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
‘স্ক্যাবিস’ কী ও কীভাবে ছড়ায়?
‘স্ক্যাবিস’ একটি প্যারাসাইটিক বা পরজীবী চর্মরোগ। ‘সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া’ নামে এক ধরনের পরজীবীর আক্রমণে এ রোগ হয়। ‘স্ক্যাবিস’ হয়েছে এমন কারো সরাসরি সংস্পর্শ, আক্রান্ত ব্যক্তির জামা-কাপড়, বিছানা, তোয়ালেসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে জীবাণু একজন থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়ায়।
স্ক্যাবিসের লক্ষণ বা উপসর্গ কী?
‘স্ক্যাবিস’ এর প্রধান উপসর্গ হলো এ রোগে আক্রান্ত হলে সারা শরীর চুলকাতে থাকে।চিকিৎসকরা জানান, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে ভাঁজে যেমন দুই আঙুলের ফাঁক, কোমর, ঘাড়, নিতম্বে, যৌনাঙ্গে, হাতের তালুতে, কবজিতে, বগলের নিচে, নাভি ও কনুইয়ে এ রোগের সংক্রমণ বেশি হয়। এসব স্থানে ছোট ছোট লাল দানাদার র্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠে। যা খুব চুলকায়। এগুলো থেকে পানির মতো তরল বের হতে পারে। সাধারণত রাতে চুলকানি বেশি হয়। আক্রান্ত স্থানে চুলকানির ফলে ক্ষত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে অন্য সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়।
তবে এ রোগের উপসর্গ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভিন্ন হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য ধরনের উপসর্গ নিয়ে এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়।
চিকিৎসা কী?
- চিকিৎসকরা বলছেন ‘স্ক্যাবিসে’র দুই ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। একটা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা, আরেকটা প্রতিকার। সাধারণত প্রতিরোধমূলক পরামর্শগুলোই চিকিৎসকরা বেশি দিয়ে থাকেন।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
- গরম পানি দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে গোসল করতে হবে।
- সাবান দিয়ে গোসল করার পর শরীর ভালো করে মুছে শুকাতে হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গলা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের সব জায়গায় লোশন বা ক্রিম লাগাতে হবে। এরপর ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর আবার সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। এক সপ্তাহ এভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে হবে।
- রোগীর বিছানার চাদর, বালিশের কভার, গামছা- তোয়ালেসহ ব্যবহৃত অন্যান্য কাপড় নিয়মিত গরম পানিতে ফুটিয়ে
- রোগীর বিছানার চাদর, বালিশের কভার, গামছা- তোয়ালেসহ ব্যবহৃত অন্যান্য কাপড় নিয়মিত গরম পানিতে ফুটিয়ে পরজীবী-মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে পোশাক আয়রন করে নিতে হবে। কারণ জীবাণুগুলো কাপড়ে লেগে থেকে সংক্রমণ ঘটায়।
- ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
- যেসব খাবার খেলে রোগীর অ্যালার্জি হয়, সেসব এড়িয়ে চলতে হবে।
- স্ক্যাবিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুষ্টিকর খাবার ও ফলের রস খেতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান ও তরল খাবার বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
- রোগ সেরে যাওয়ার পরও রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- শরীরে পানিশূন্যতা না হলে চর্ম রোগ কম হয় বলে চিকিৎসকরা আক্রান্তদের সুষম ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
- আক্রান্ত রোগী সুস্থ হতে সাধারণত সাত দিন লাগে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সুস্থ হতে পনেরো দিন থেকে মাস-খানেক বা ইনফেকশন হলে তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা।
তবে চুলকানি হলেই তা ‘স্ক্যাবিস’ রোগ নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। তাই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চর্ম রোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
- ছোঁয়াচে এ রোগটির সংক্রমণ এড়াতে বা প্রতিরোধে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
- সুস্থ ব্যক্তিদের আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, বিছানা ও সাবান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
- পরিবারের বা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে একজন আক্রান্ত হলে অন্যদেরও স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই একজন আক্রান্ত হলে তার সঙ্গে থাকা অন্য সবার চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদকঃ মেহরুবা আক্তার