স্বপ্ন


ছোটবেলায় আমি পড়ালেখায় খুব ভালো ছিলাম। ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম। খুব ধুমধাম করে বাসায় অনুষ্ঠান করলো মা। আমার মা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিল। আমার বাবা ব্যাংকে চাকরি করতো। বেশ সচ্ছল অবস্থা ছিল আমাদের। মায়ের জগৎ ছিল আমাকে ঘিরে। কিভাবে আমার পড়ালেখার আরো উন্নতি হবে, কোন খাবারটা আমার পছন্দ, কোন ড্রেসটায় আমাকে মানাবে – এসব ছাড়া মায়ের ভাবনায় আর কিছু ছিল না। আমার বাবা বলতো, “আমার মেয়ে নীতু পৃথিবীর সেরা মেয়ে। একটা দিন না দেখলে কেমন অস্থির লাগে।” মা তৃপ্তির হাসি হাসতো। খুব সুখের সংসার ছিল আমাদের ।

যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, একদিন স্কুল থেকে আসার পথে মা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলেন। আমি বাসায় মার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। খুব খিদে লেগেছিল। মার উপর একটু রাগ হচ্ছিল। মা জানে আমি খিদের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। তাও কেন দেরি করছে? অবশেষে ভাবলাম, নিজে নিজে খেয়ে নিই। মার জন্য বিশাল সারপ্রাইজ হবে। মা বলে, “এত বড় হয়েছিস, তাও মুখে তুলে খাওয়ায় দিতে হয়।” কি মজা হবে, মা যখন এসে শুনবে, আমি নিজে নিজেই খেয়ে নিয়েছি এবং নিজে বেড়ে খেয়েছি! মা বাড়িতে আসলো ঠিকই, কিন্তু শোনা হলো না মেয়ের বড় হয়ে যাওয়ার গল্প। অবাক হয়ে এখনো ভাবি, মায়ের মৃত দেহ দেখে আমি কাঁদিনি। হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। শুধু দেখি আত্মীয় স্বজন সবাই কাঁদছে। আমার বাবা কে ঠেকানো যাচ্ছে না। বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদছে আর বলছে, “আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না।”

দাদা বাড়িতে মা কে কবর দেওয়া হলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আমাকে নীরা ফুপির কাছে রাখা হবে। নীরা ফুপির বিয়ে হয়েছে, পাঁচ বছর। বাচ্চা হয় না। আমি তাদের একমাত্র বাচ্চা হয়ে থাকবো। আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা মাথা নিচু করে থাকলো। বাবা কে যখন একলা পেলাম, তখন বললাম, “বাবা আমি তোমার কাছে থাকবো।” বাবা কাঁদলেন। বললেন, “প্রিন্সেস তুমি তো জানো, আমি তোমার চাচু, ফুপিদের সিদ্ধান্তের উপর কখনো কথা বলি না। আর ওরা ঠিকই বলেছে, আমি সারাদিন বাড়ি থাকি না, তোমার দেখা শোনা কে করবে? আর তুমি তো বাইরের কারো কাছে যাচ্ছো না। ফুপি তোমাকে অনেক আদর করে রাখবে।”
আমাকে ফুপির বাড়িতে নিয়ে যেয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। খুব অভিমান হলো বাবার উপর। সেই বয়সেই মনে মনে ধরে নিলাম, এক্সিডেন্টে আমার বাবা মা দুজনেই মারা গেছে ।

ঈদ সব সময়ই আমরা দাদা বাড়ি তে করতাম। মা মারা যাওয়ার পরে প্রথম যেবার দাদা বাড়ি তে ঈদ করতে গেলাম, সেবার চাচুরা, ফুপি রা সবাই আমার জন্য খুব দামী দামী ড্রেস কিনে আনলো। অনেক দিন পরে খুব ভালো লাগছিল আমার। যদিও বাবার উপর খুব অভিমান করে ছিলাম, তারপরও মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম বাবার জন্য। প্রায় পাঁচ মাস বাবা কে দেখি না। যে বাবার একটা দিনও আমাকে না দেখলে অস্থির লাগতো, সেই বাবা পাঁচ মাস আমাকে দেখে না! মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা বলে। কেমন আছি, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, কিছু লাগবে কিনা – এই জাতীয় কথাবার্তা। বাবার জন্য ও কষ্ট হতো। বারবার মনে পড়তো, বাবার বাচ্চাদের মত কান্না। বারবার বলছিল, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আসলেই তো, মাকে ছাড়া বাবা কিভাবে বাঁচবে? সবাই বলতো আদর্শ জুটি। তো যেটা বলছিলাম, আমি কিছুটা অস্থির হয়েই বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে বাবা দাদি বাড়িতে পৌঁছালো, কিন্তু একা নয়। সাথে আর একজন মহিলা কে নিয়ে । সবাই বললো, ওটা আমার নতুন মা। সেদিন প্রথম কাঁদলাম। সবার সামনে হাউমাউ করে কাঁদলাম। সবাই আমাকে বোঝালো, বাবার খাওয়া দাওয়ার খুব সমস্যা হয়ে যাচ্ছিলো। বাড়িতে মেয়েমানুষ না থাকলে, কাজের লোকও কাজ করতে চায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে মনে হলো, ভালোই হয়েছে। এবার তো নিজের বাড়ি যেতে পারবো। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময়, বাবা আমাকে সাথে নিল না। ফুপির কাছে শুনেছিলাম, নতুন মা রাজি হচ্ছে না। কিছুদিন পরে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, আমাকে বাবা নিয়ে যাবে।

ফুপি শ্বশুরবাড়ি তে থাকতো। তার ভাসুরের ছেলেটা আমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। মাঝে মাঝে ফুপি কে বলেছি। ফুপি ফুপার কাছে নালিশ করতো। কিন্তু নিজের মেয়ে না হলে কি আর দরদ বোঝে? ফুপা কর্নপাত করতো না। ফুপি খুব দুঃখ পেতো। শেষে দেখি একদিন মেঝো চাচীকে ফোন করে বলছে, “কাল নীতু কে নিতে এসো। বোঝো না, ওর নিজের বাবাই ওর দরদ বোঝে না, তাহলে ফুপাতে কেমনে বুঝবে? ভাবী, কাল তুমি নীতু কে নিতে আসো। রোজ রোজ ওর জন্য সংসারে অশান্তি ভালো লাগে না।”

আমার আশ্রয় হলো, মেঝো চাচুর বাসায়। ক্লাস নাইনে ভর্তি হলাম। সাইন্স নিলাম । চাচু, চাচী দুজনেই নিষেধ করলো সাইন্স নিতে। কিন্তু মাথার ভিতরে ঢুকে ছিল, আমাকে ডাক্তার হতে হবে। কারন আমি যেবার ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলাম, সেবার মা জনে জনে সবাই কে বলেছিল, “আমার নীতু কে ডাক্তার বানাবো।” কথাটা আমার এখনো কানে বাজে। তাই জেদ ধরেই সাইন্স নিলাম। কেন নিষেধ করেছিল, SSC তে বুঝতে পারিনি। কারন আমার কোন টিচারের প্রয়োজন পড়েনি । কিন্তু HSC তে যখন চাচী কে বললাম, চাচী আমাদের সাথে সবাই প্রাইভেট পড়ে, আমি ও পড়তে চাই । তখন চাচী সাফ জানিয়েদিল, প্রাইভেট পড়ানোর কোন টাকা দিতে পারবে না। যেন সময় থাকতে, আমি সাইন্স বদলে আর্টস নিই। বললো, তোমার বাবা তো তোমার জন্য একটা টাকা ও পাঠায় না । একটা মাত্র ছেলে তার। মাত্র তিন বছর বয়স। ছেলে কে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। তাই তোমার জন্য কোন খরচ দিতে পারবে না। আমি তবু সাইন্সই নিলাম। শুধু ম্যাথ নিলাম না। যতটুকু পারি, কলেজেই বুঝে নিই ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি। কোন কিছু না বুঝলে, বান্ধবীদের কাছ থেকে বুঝে নিই।

SSC আর HSC তে খুব বেশি ভালো রেজাল্ট ছিল না আমার। কিন্তু কিভাবে যেন মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলাম। কিন্তু চাচী মেডিকেলে পাঠাতে রাজি হলেন না। বললেন, “এত খরচ আমরা দিতে পারবো না। শুরুতে সবার এতিম বলে তোমার উপর খুব দরদ ছিল। এটা সেটা সবাই মিলে দিত। কিন্তু যখন সবাই দেখলো, তোমার নিজের বাপই তোমাকে দেখে না, তখন থেকেই কেউ আর কিছু দেয় না। আমি তোমার এত খরচ দিতে পারবো না । অনেক পড়াশুনা করছো, এবার বাদ দাও। পরে দেখেশুনে ভালো একটা বিয়ে দিয়ে দেবো।” সেদিন বিকেলে দেখি, চাচী তার বোন কে ফোনে বলছে, “পাগল হয়েছিস? ওকে কেন ডাক্তারী পড়তে পাঠাবো? ও গেলে আমার সংসারের কাজ কর্ম কে করবে? গত চারটা বছর শান্তি তে আছি। কাজের লোক খুঁজতে হয়নি। এর আগে কাজের লোক নিয়ে যে যন্ত্রণায় ছিলাম। তাই তো যখন সবাই বললো, নীতু কে আমার কাছে রাখতে হবে, না করিনি । ও মেডিকেলে গেলে আমার সংসারের কাজ কে করবে?”

সে রাতে প্রথম প্রচন্ড রাগ হলো – মায়ের উপরে ( আমাকে ফেলে অসময়ে চলে গেছে তাই ), বাবার উপরে ( বাবা বলতে ঘৃনা হয় ), পৃথিবীর উপরে। হঠাৎ করেই পাল্টে গেলাম আমি। কান্নাকাটি বন্ধ করলাম। ছোটবেলা থেকেই ঈদ বোনাসের যে টাকাগুলো পেতাম, সেগুলো জমিয়ে রেখেছিলাম। কখনো খরচ করা হয়নি। আমার একটা ব্যাংক ছিল। মা কিনে দিয়েছিল। ভাবলাম, সবমিলিয়ে দশ পনের হাজার টাকা হবে। ভেঙে ফেললাম ব্যাংকটা। অবাক হয়ে দেখি, প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা! আমি নিশ্চিত, পাঁচশো টাকার টাকার নোট গুলো আমি ভরিনি! তবে কি মা কোন কোন সময় পাঁচশ টাকার নোট গুলো ভরে দিত, ব্যাংক ভাঙলে আমার খুশি দেখার জন্য? আমার তখন এত চিন্তা করার সময় নেই ।

সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে, টাকাগুলো নিয়ে পরের দিন ভোরের ট্রেনেই রওনা দিলাম, চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। ঐদিন ঐ ট্রেনে আমার বান্ধবীর ও যাওয়ার কথা ছিল। তাই সাহস পেয়েছিলাম । ভর্তি হয়ে গেলাম, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম । চাচী শুনিয়ে দিল, দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুসেছিল। আমি শুনলাম, কিছু বলিনি। চাচী আমার মজা দেখতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, পড়ালেখার খরচ কোথা থেকে পাবে? ঠিকই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়নি। আসলে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে খুব বেশি খরচ হয় না। আমি মেডিকেল কোচিং সেন্টারে কোচিং করাতাম। প্রথম প্রথম মেয়ে বলে কোচিং এ যেতে ভয় লাগতো। নিজেকে বোঝাতাম, এতিম মেয়েদের নিজেকে মেয়ে ভাবতে হয় না। পরে আর ভয় লাগতো না। বরং আমি ছিলাম কোচিং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় টিচার। নিজের খাওয়া পড়ার খরচ খুব ভালো ভাবেই হয়ে যেত।

আমি MBBS পাশ করলাম। পাঁচটা বছর আমি বাড়িতে যাইনি। এমন কি ঈদের ছুটিতেও হোস্টেলে থাকতাম। রেজাল্ট পাওয়ার পরে মনে হলো, এবার মার সাথে দেখা করতে যাওয়া উচিত। মার কবরের কাছে যেয়ে কানে কানে বলবো, আমি ডাক্তার হয়েছি মা। দাদা বাড়িতে যেয়ে দেখি, আত্মীয় স্বজন সবাই এসেছে। সম্ভবত আমার বান্ধবীর বাবা সংবাদটা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। গ্রামের লোকজনও সব এসেছে। আমার বাবা নাকি আমার ডাক্তার হওয়া উপলক্ষে, গরু জবাই করেছে, সবাই কে দাওয়াত দিয়েছে! দেখি আমার বাবা খুব গর্ব করে বলছে, “বলেছিলাম না, আমার মেয়ে নীতু, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ে।” বাবার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এই লোকটা কে আমি চিনি না । কোনদিন দেখেছি বলে মনেও পড়লো না। আমি মার কবরের কাছে চলে গেলাম। অনেক দিন হলো মার সাথে গল্প করা হয়নি। আমি মার কবরের পাশে বসে, এতদিনের জমানো গল্পগুলো বলছি। সবাই পাগল দেখার মত করে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে লাগলো। আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আজ আমি আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করেছি। সেই স্বপ্ন পূরণের গল্প তাকে না বললে হয় ?

ডা. সুমনা তনু শিলা
৩৭ তম ব্যাচ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

প্ল্যাটফর্ম ফিচার:
সামিউন ফাতীহা
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট সিলেট এর নতুন কার্যকরী কমিটি গঠন

Sun Feb 24 , 2019
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট সিলেট (বি এ পি, সিলে) এর নতুন কার্যকরী কমিটি গঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিষ্টস – সিলেট শাখার (বাপসিল) নির্বাচন এবং নতুন মেয়াদে (২০১৯-২০২০) কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিষ্টস-সিলেট শাখার (বাপসিল) সম্মানিত সদস্যদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট & গলফ, […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo