শল্যচিকিৎসার ইতিহাস (পর্ব২)

সার্জারি নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই Father of Modern Surgery নিয়ে লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে! হওয়াটাই মনে হয় স্বাভাবিক। আধুনিক যুগের এই উন্নত সার্জারির পিছনে এই ডাক্তারের মূল্যবান আবিষ্কার রয়েছে, যার সাথে সাথেই মৃত্যুর হার অনেক কমে গিয়েছিল। আর তার সাথে নতুন গবেষণার দ্বারও উম্মোচিত হয়ে গিয়েছিল।
আজ লিখছি এন্টিসেপটিক সার্জারির পথিকৃৎ এবং আধুনিক সার্জারির জনক ডাঃ জোসেফ লিস্টার (Joseph Lister) সম্পর্কে।
Joseph ListerÕs operating theater in the mid-1800s.
লিস্টারের জন্ম ব্রিটেনে ১৮২৭ সালে। তার বাবা বিখ্যাত পদার্থবিদ জোসেফ জ্যাকসন লিস্টার। তিনি যদিও আবার অপটিকাল মাইক্রোস্কোপের উন্নতি সাধনের জন্যই বেশি বিখ্যাত। লিস্টারের ইচ্ছা ছিল সার্জন হওয়ার। তাই ১৭ বছর বয়সে বাবা লিস্টারকে লন্ডন পাঠিয়ে দেন। তখনকার দিনে স্কটিশ সার্জন ডাঃ জেমস সাইম (James Syme)-এর কাছে কাজ শেখার স্বপ্ন প্রায় সকল উঠতি সার্জনরাই দেখতেন। লন্ডনে ৯ বছর পড়াশোনা করার পর সাইমের সাথে দেখা করে লিস্টার তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ করলেন। সাইমের পরিচালিত হাসপাতাল ছিল এডিনবার্গে। তাঁর অধীনে ৭ বছর কাজ শিখে অনেকটাই ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন।
এই কয় বছরে সাইমের মেয়ে এগনেসকে ভাল লেগে যায় লিস্টারের। আর ওদিকে সাইম বা এগনেসেরও আপত্তি ছিল না বলে তাঁদের বিয়েটাও হয়ে যায়। হানিমুনে তাঁরা তিনমাস কাটিয়েছেন ফ্রান্স এবং জার্মানিতে। তবে মজার ব্যাপার হলো, সেই ঘোরাঘুরি ছিল সেখানকার বড় বড় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসপাতালে! এগনেস কিন্তু মোটেও বিরক্ত হননি, বরং মুগ্ধ হয়েছিলেন। (তাই বলে সবার ক্ষেত্রে এমন কিন্তু নাও হতে পারে!) ফলস্বরূপ তিনি লিস্টারকে আজীবন তার গবেষণায় সাহায্য করেছেন। এমনকি ১৮৯৩ সালে এগনেসের মৃত্যুর পর লিস্টার আর তার কাজে ফিরে আসেননি, অবসর নিয়েছিলেন!
যাই হোক, বিয়ের পর গ্লাসগোতে হাসপাতালের সার্জন হিসাবে যোগ দিলেন লিস্টার। এডিনবার্গ আর গ্লাসগো, দুই জায়গার হাসপাতালেই তিনি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে ব্যথিত হলেন- অপারেশনের পর বেশিরভাগ রোগীর কপালেই জুটছে মৃত্যু। তিনি এসব মৃত্যুর কারণ ভেবে বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
তখন অধিকাংশই রোগীই আসতো Fracture (হাড়ভাঙা) নিয়ে। এটা মূলত দুই রকমের- Simple (সরল) এবং Compound (যৌগিক)। আরেকটু বুঝিয়ে বলতে গেলে-
Simple Fracture:  হাড় ভেঙে যায়, কিন্তু উপরের চামড়ার কোন ক্ষতি হয় না। তাই শুধু প্লাস্টার করে দিলেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাড় জোড়া লেগে যায়। এতে প্রায় সব রোগীই ভাল হয়ে যেত, আর মৃত্যুর হারও ছিল কম।
Compound Fracture: হাড় ভেঙে চামড়া ভেদ করে বাইরে চলে আসে। ফলে হাড়কে ঠিক জায়গায় বসাতে হয়, আবার ছিড়ে যাওয়া চামড়াও সেলাই করতে হয়। এই অপারেশনের পর তখন ৫০% রোগীই মারা যেত।
কিন্তু কেন এমন হয়? অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লিস্টার ভেবে বের করলেন, নিশ্চয়ই অপারেশনের পর এমন কিছু ঘটছে যার জন্য রোগী মারা যাচ্ছে। এমনই এক সময়ে তিনি তখন ম্যাগাজিনে ফ্রান্সের বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের আবিষ্কারের কথা পড়লেন। পাস্তুর লিখেছিলেন, বাতাসে এক ধরনের জীবাণু আছে যা খাবারকে পচিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন রোগের সাথে এই জীবাণুদের সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
লিস্টার আবারও ভাবতে বসলেন। Compound fracture-এ কী কী হয়? ছেড়া চামড়া সেলাই করার কয়েকদিনের মধ্যেই সেই জায়গা একটু ফুলে ওঠে। এরপর আস্তে আস্তে ফোলা জায়গাটা লাল হয়। সেখানে পুঁজ জমে আর রোগী ব্যাথায় ও জ্বরে কাহিল হয়ে পড়ে। (এখন আমরা জানি, এটা Infection-এর জন্য হয়) এই অবস্থার পর অধিকাংশ রোগীই মারা যায়।
পাস্তুরের মতবাদ অনুযায়ী, বাতাসের জীবাণু বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং খাবারকে পচিয়ে দিতে পারে। তাহলে এরাই হয়তো ক্ষতস্থানকেও পচিয়ে দিতে পারে। লিস্টার বুঝলেন, Compound Fracture-এ ক্ষতস্থান বাতাসের সংস্পর্শে আসে, তাই চামড়া সেলাই করার পরেও পচন ধরছে। কিন্তু Simple fracture-এ ক্ষতস্থান বাতাসের সংস্পর্শেই আসে না, তাই ভাল হয়ে যায়।
কিন্তু সম্পূর্ণ বায়ুশূন্য অবস্থায় তো আর অস্ত্রোপচার করা সম্ভব না। তাহলে বাতাস ছাড়াও অন্যান্য আর কী কী জিনিস ক্ষতস্থানকে দূষিত করতে পারে? লিস্টারের মনে পড়ে গেল হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার কথা। তখনকার দিনে খারাপ-বাতাসকে (Miasma) সর্বরোগের উৎস বলে মনে করা হতো। তাই হাসপাতালে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না রেখে যথাসম্ভব বদ্ধ করে রাখা হতো। আবার একসাথে সব রোগীকে পাশাপাশি রাখা হতো বলে অবাধ সংক্রমণেরও সুযোগ ছিল। ওদিকে হাত ধোয়ার প্রচলনও ছিল না। তাই ময়লা হাতেই সার্জারি করা হতো। সাথে ময়লা কোট আর বহুলব্যবহৃত অপরিষ্কার যন্ত্রপাতি তো আছেই!
অবশ্য হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক Ignaz Semmelweiss এর আগেই “Puerperal fever”-এর কারণ নিয়ে গবেষণা করে ওয়ার্ড এবং ওটির পরিচ্ছন্নতা ও ডাক্তারদের হাত ধোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সকলকে জানান। কিন্তু প্রচন্ডভাবে অপদস্থ হন এবং ১৮৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন (বিস্তারিত আমরা অন্য একদিন জানবো)।
যাই হোক, লিস্টার ক্ষতস্থান, হাত, গাউন এবং আশেপাশের সবকিছু জীবাণুমুক্ত করে একটা পরীক্ষা চালাতে চাইলেন। কিন্তু হাতের এবং গাউনের জীবাণু কী উপায়ে ধ্বংস করবেন? পাস্তুর ৩টা উপায়ের কথা লিখেছিলেন- Filtration (ছাঁকন), exposure to heat (তাপ প্রয়োগ), or exposure to chemical solutions (রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার), যার প্রথম দুইটি স্বাভাবিকভাবেই তিনি মানবদেহের উপর প্রয়োগ করতে চাননি। তাই লিস্টার ৩নং উপায় বেঁছে নিলেন, অর্থাৎ কেমিকেল সলিউশন।
তখনকার দিনে কার্বলিক এসিড (বা, ফেনল) খুব ব্যবহার হচ্ছিল, মূলত নর্দমার দুর্গন্ধ দূর করার জন্য। লিস্টার খেয়াল করলেন যে এটি দেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়, কারণ যেসব মাটিতে এটা দেওয়া হচ্ছে তাতে আবার পরে পশুচারণও করা হচ্ছে। তাই তিনি এটাই ব্যবহার করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন।
১২ আগস্ট, ১৮৬৫ সাল। ছোট্ট ছেলে James Greenlee  গ্লাসগোর রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে Compound fracture নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। ৩৮ বছর বয়সী লিস্টার তাঁর নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী একটা পরিষ্কার করে ধোয়া কোট পড়লেন। নিজের হাত-পা , অপারেশনের যন্ত্রপাতি ও ক্ষতস্থান অপারেশনের আগে ও পরে কার্বলিক এসিডে ধুয়ে নিলেন। পরিষ্কার প্লাস্টার লাগালেন। অবাক হয়ে দেখলেন যে ক্ষতস্থানে একটুও পুঁজ জমলো না। ছয় সপ্তাহেই ছেলেটি সম্পূর্ণ ভাল হয়ে বাড়ি চলে গেল।
এই সফলতার পর তিনি এই পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু করলেন। যন্ত্রপাতি, প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ, সবকিছুই কার্বলিক এসিডে ডুবিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলেন। অপারেশনের সময়ও এটা স্প্রেয়ারের সাহায্যে ছিটানো হতো (পরে অবশ্য স্প্রেয়ারের ব্যবহার বন্ধ করে দেন। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে নয়, বরং দূষিত পদার্থ থেকে সরাসরি ক্ষতস্থানে ঢোকে)। পরিচ্ছন্নতার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “Listerism”. দুই বছরে হাসপাতালে তাঁর রোগীদের মৃত্যুর হার ৫০% থেকে কমে ১৫% হয়ে গেল।
নতুন আবিষ্কারের বিবরণ দিয়ে তিনি ১৮৬৭ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত “The Lancet” (বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল)-এ এই সম্পর্কে পর্যায়ক্রমে ৬টি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। কিন্তু অন্য সব আবিষ্কারের মতই, অপারেশনে তাঁর নতুন প্রক্রিয়ার এই মতবাদকে কেউ সমর্থন করলো না। অনেকে অবজ্ঞা-উপহাস করলো। অনেকে প্রমাণ দেখেও স্রেফ গোঁড়ামির জন্য মানতে চাইলো না।
তবে ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশের সার্জনরা তার আবিষ্কার কাজে লাগাতে লাগলেন এবং এতে সর্বত্রই মৃত্যুহার অনেক কমে আসলো। জার্মানি, মিউনিক, আমেরিকা, সব জায়গা থেকেই সফলতার খবর এলো। ১৫-২০ বছরের মধ্যেই চারদিকে জয়জয়কার ছড়িয়ে পড়লো। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়ে গেলো।
(তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে Dr. William Stewart Halstead কার্বলিক এসিড দিয়ে হাত ধোয়ার বদলে রাবারের গ্লাভস ব্যবহারের প্রচলন করেন। কেননা, কার্বলিক এসিডের জন্য চামড়ার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর তাঁর একজন নার্সের এমনটাই হয়েছিল।)
এন্টিসেপটিক এবং স্টেরিলাইজেশন ব্যবহারের এক নতুন দিগন্ত দেখা যায় বিংশ শতাব্দির প্রথম দিক থেকেই। ডাক্তাররা সাদা এপ্রোন পড়া শুরু করেন এবং হাসপাতালের বেডে সাদা চাদর ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকেই। সাথে ওটি টেবিলের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া হয়। সেই ধারা এখন পর্যন্ত চলে এসেছে। এখনো সার্জনরা জীবাণুমুক্ত গাউন, হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক পড়েন। কারো সংক্রামক কোন রোগ থাকলে তাঁকে ওটিতে ঢুকতে দেয়া হয় না। এছাড়াও, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করে বাতাসকে বিশুদ্ধ রাখা হয়।
১৮৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করলেও কিন্তু লন্ডনবাসী তাঁর দিক-নির্দেশনা ছাড়া অপারেশন করতো না। ১৯০২ সালে রাজ্যাভিষেকের মাত্র দুইদিন আগে ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড-এর এপেন্ডিসেকটমি করতে হয়। লিস্টারের পরামর্শ অনুযায়ী সার্জারি করে রাজা ভাল হয়ে ওঠেন। পরে তিনি লিস্টারকে স্টেরিলাইজেশনের ক্ষেত্রে তাঁর অসমান্য অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান এবং ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মান প্রদান করেন।
১৮৯৫ সালে লর্ড কেলভিনের পর তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। কোন ডাক্তারের পক্ষে এই সম্মান তখন বিরল। এছাড়া প্রচুর দেশি এবং আন্তর্জাতিক সম্মান তিনি লাভ করেছেন, যা বলে শেষ করা যাবে না। তার সম্মানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিং থেকে শুরু করে ব্যাকটেরিয়ার Genus পর্যন্ত নামকরণ করা হয়েছে!
তিনি হয়তো নতুন কোন ওষুধ আবিষ্কার করেননি, কিন্তু তার গবেষণার ফলে সার্জারির দুনিয়ায় যেন আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। মাত্র ১২০ বছর আগেও কিন্তু এমনটা ছিল না। অপারেশনের পর রোগী বেঁচে গেলে সবাই অবাক হয়ে যেত। লিস্টারের এই গবেষণার ফলে মৃত্যুর যুদ্ধক্ষেত্র সত্যিকারের আরোগ্যকেন্দ্রে রূপ নিতে পেরেছে!
ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ।
আদিবা তাসনিম
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ ২০১২-১৩

যোবায়ের মোমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে "দ্রুততম সময়ের" মধ্যে ১০,০০০ ডাক্তার নিয়োগের উদ্যেগ -স্বাস্থ্যমন্ত্রী

Fri Aug 4 , 2017
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন এবং বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানিয়েছেন বলেন ‘দ্রুততম সময়ের’ মধ্যে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রথমে তিন হাজার এবং পরে পর্যায়ক্রমে আরও […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo