লাইফ ইন লকডাউন, ডে ফোর্টি সেভেন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ মে ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

একসময় ভেবেছিলাম দেশে মহামারি লেগে যাবে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হবে। সদর হাসপাতাল থেকে ফ্রি ঔষধ বিলোবে। সারাদিন স্বাস্থ্য বর্তিকা নিয়ে মাইকিং হবে। পৌরসভা থেকে ঘরে ঘরে ঔষধ যাবে। ভীড়ের চাপে ভেঙ্গে পড়বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। রোগীর জন্য বেড থাকবে না, মেঝে থাকবে না, বারান্দা থাকবে না। সর্বত্র শুধু রোগী আর রোগী। কেউ কাশছে, কেউ কাতরাচ্ছে, কেউ বমি করছে। আসার পরই ক্যানুলা করা হবে আর স্যালাইন ঝুলানো হবে। ডাক্তার নার্সরা দম ফেলার ফুসরত পাবেন না। হাসপাতালের সামনে খাটিয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সিজনাল ব্যবসায়ীরা। প্রশাসন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকবে। মানুষ মারা যাবে অগুনিত। কবরস্থান শ্মশানে জায়গা হবে না। আকাশ ভর্তি থাকবে চীল শকুনে।

এরকম কিছুই হয় নি। আমার মনেহচ্ছে এরকম টুকটুক করেই আমরা জিতে যাব। ভাইরাসকে ফাঁকি দিয়ে আমরা বের হবো, ভীড় জমাবো, উৎসব করবো। সীমিত পরিসরে জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকবো।

আমরা গ্রামে আসার তিনমাসের মধ্যেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। তারপর প্রায় আড়াই মাস হয়ে যাচ্ছে। সে প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মধুচন্দ্রিমা যত কম সময়ই থাক, তার ঔজ্জ্বল্য সবসময় বেশি। প্রথম হেলথ কমপ্লেক্স এ পোস্টিং পেয়ে দেখলাম কল্পনা আর বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা- আলাদা ঘর নেই, চেয়ার টেবিল নেই, এমনকি রোগীও নেই। যারা আসেন তারা ঠিক চিকিৎসা নিতে আসেন না। ঔষধ নিতে আসেন। তেমন পরীক্ষা নীরিক্ষা হয় না, যা হয় সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। টেকনিশিয়ানরা দক্ষ নন। এর কাজ ও, ওর কাজ ঔ- গেটিস দিয়ে চলছে। যার দায়িত্ব ভেষজ গাছ রক্ষণাবেক্ষণে সে বসে আছে টিকিট কাউন্টারে, যার টিকিট কাউন্টারে থাকার কথা সে অমুক তমুক নিয়ন্ত্রণ কক্ষে, যিনি অমুক তমুক নিয়ন্ত্রক তিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন। এসইসিএমও, সিনিয়র স্টাফ নার্স, ফার্মাসিস্ট- অনেকেই চিকিৎসা দেন। আমাদের কাজ মারামারি করে আসলে ইনজুরি নোট নিয়ে রাখা। আর খারাপ কেস গুলো যেগুলো তারা রেফার করবেন সেগুলো দেখা।

হাসপাতালে অসংখ্য ঘর। ভাল ঘরগুলোয় কেরানিরা ফাইল পত্র নিয়ে বসে থাকেন। কোনো কোনো ঘর স্বতন্ত্র প্রজেক্টের জন্য বরাদ্দ। তারা সারাদিন লিখেন। মাঝে-মাঝে মনেহয় উনারা ইতিহাসবিদ অথবা ঔপন্যাসিক। এমনকি কোভিড সময়েও তাদের পিপিই-মাস্ক-গ্লাভস পরে লিখতে দেখেছি।

তসলিমা নাসরিন একবার রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ র সাথে ঝিনাইদহ যান কবিতা উৎসবে যোগ দিতে। তাদের তখন ডিভোর্স হয়ে গেছে। যাত্রাপথে পাশাপাশি বাসে বসে তারা সমসাময়িক কবিতা রাজনীতি জীবন নিয়ে আলাপ করছিলেন। রুদ্র ভরা চোখে তার নতুন ভালোবাসার গল্প বলছিলেন। মেয়েটির নাম- শিমুল। শিমুলকে নিয়ে লেখা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছিলেন তসলিমাকে। তসলিমা চোখে কপট আগ্রহ নিয়ে ‘তারপর তারপর’ বলছিলেন, আর রুদ্র’র চোখে ফোটা শত শিমুল দেখে আড়ালে নিজের চোখের জল গোপন করছিলেন। ঢাকায় ফিরে ইন্দিরা রোডের রুদ্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সকালে তিনি রিকশার খোঁজে বের হোন। সে সময় ঢাকার রাস্তায় একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার যে ছবি তিনি এঁকেছেন তা আমি অনুভব করি বহুবার। সব স্মৃতি যেন পিছনে দৌড়াচ্ছে ধরবে বলে। তিনি গা বাছিয়ে ছুটছেন। নিজের থেকে নিজে পালানো।

যখন খুব বেশি পালাতে চাই, কাউকে ভুলে থাকতে চাই, কোনো সময়কে মুছে দিতে চাই- এ গল্পটি খুব মনে পড়ে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বড়ভাইয়ের কোভিড পজিটিভ এসেছে। এ মানুষটাকে আমি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করি। তিনদিন জ্বরে ভুগে আজ টেস্ট করিয়েছিলেন। ফোন দিই নি। কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি তাই। নতুন কিছু আর কী বলবো যে ফোন দিব! আজকের পরে বহু প্রজন্ম হয়তো বুঝবেই না কত ভয় কত দুশ্চিন্তা কত মনখারাপ নিয়ে আমরা এ সময়টায় বেঁচে ছিলাম…।

করোনা নিয়ে যতই দেখছি মনে হচ্ছে এক বইয়ের মলাট যেন উল্টেপাল্টে ভাল ভাবে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছিলাম বইটির সব জেনে গেছি। অথচ এখনো বেদনাবিধুর অনেক শব্দ আবিষ্কার করা বাকি। এখনো মূল বই পড়া বাকি!

আজ অনেকদিন পর ছাদে গেলাম। রাতের আকাশ দেখে আলাদা করে ভাবতে হয় না। কালো আকাশে কালো সময় আপনিই ভেসে উঠে। এক মা তার হারানো সন্তান খুঁজতে ছুটে বেড়িয়েছিলেন আকাশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা। তার মাতৃস্তন ছিলকে পড়েছিলো পথে পথে। তা দিয়ে গ্রীক দেবতারা তৈরি করেছিলেন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ।

যে দুর্ভাগ্যের গল্প দিয়ে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড তৈরি আমরা তার সামান্য অংশবিশেষ। কোথাও হারানোর ভয়, কোথাও স্বপ্নভঙ্গের ব্যাথা, আর কোথাও ভয়ঙ্কর ভীড়ে প্রচণ্ড একাকীত্ব- এ নিয়েই জীবন!

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পালিত হলো পবিত্র ইদ উল ফিতর, হলো না কোনো ইদ জামাত

Sun May 24 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ মে ২০২০, রবিবার করোনা পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদযাপন করা হচ্ছে পবিত্র ইদ উল ফিতর। আজ (রোববার) ইদ উদযাপন করছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও আরও বেশ কিছু দেশে ইদ উদযাপন হচ্ছে আজ। তবে এবারের ইদের আমেজ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo