লাইফ ইন লকডাউন, ডে এইটি ওয়ান

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

একটি মেয়ে কখনো বর্তমানে থাকে না। সে ব্যস্ত- অতীত নিয়ে, নয় ভবিষ্যত নিয়ে। নেক্সট ইয়ার, নেক্সট মান্থ, নেক্সট ডে, নেক্সট মিনিট। কখনো কখনো নেক্সট সেকেন্ড!

ফলতো তার মা মারা যাওয়ার আগে যখন তার বাবা আরেকটি বিয়ে করলেন সে শুধু শোক সাগরেই ভাসছিলো না, একধরনের একাকীত্ব আর অনিশ্চয়তা তাকে চেপে ধরছিলো। তখন সে প্রথম ম্যাসেজ পাঠানো শুরু করলো। শুরুতে দুই তিন চার, তারপর বাড়তে বাড়তে পঞ্চাশ একশো ছাড়ালো। সে প্রায় তার সবকিছু বলছিলো। ওপাশ থেকে উত্তরও আসছিল দ্রুত। একসময় তার উত্তর তার জন্য নেশাদ্রব্য হয়ে দাঁড়ালো।

প্রতিটি সুযোগে প্রতিটি অবসরে সে তার ম্যাসেজ খুঁজতো। সকালে ব্রেকফাস্টের ফাঁকে, ক্লাসে, ওয়ার্ডে, পড়তে বসে, বান্ধবীদের সাথে আড্ডায়, বই পড়ার ফাঁকে, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর..। তার ভয় কোনো রিপ্লাই যেন ভুলে চোখ এড়িয়ে না যায়! কখনো কখনো সে পুরনো ম্যাসেজগুলোই রিভিশন দিতো। সমান আগ্রহ সহ। তখন তার দুই সিম, কিন্তু এক সিমকে সে ভুলতেই বসেছে। তখনো তার লেজে অনেক শিশু, কিন্তু তার খেলার আনন্দে মন নেই। তার সব লেখাই তাকে হাসাতো, মাঝেমাঝে বিব্রত করতো, কখনো কখনো বোকা বানাতো। তবে সবচেয়ে বেশি ভাবাতো। কি বলছে তা নিয়ে নয়, পরে কি নিয়ে বলাবে তা নিয়ে! জেতার নেশায় সে আগেও পড়েছে, এবার মজলো হারের নেশায়।

অথচ ছেলেটা প্রয়োজনীয় কিছু লিখতো না। প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য যেমন- ক্লাস কয়টায়, অমুক নোট, পরীক্ষা পাশের খবর- সম্ভবত তার কাছে ছিলই না। সে লিখতো গভীরতম বিষয় নিয়ে। যেমন- জীবন, সমুদ্র, আকাশ, রবীন্দ্রনাথ…। বোরিং গল্পগুলো যে তার ভাল লাগছে সে কথা সে কারো কাছে বলতে পারে নি।

তখন সে কেবল বুঝতে শুরু করেছে- তার জীবনটা স্থির সুন্দর শান্ত সরোবর নয়; বা ভবিষ্যৎ আর অতীতের মাঝে একটি সময় আছে যাকে ‘বর্তমান’ বলে। সে বর্তমানে এতো ঢেউ যে যেকোনো সময় তা ঝর্ণার রূপ নিতে জানে। সে বুঝলো তার ক্যানভাসে হলুদ সবুজ ছাড়াও আপেল রাঙা নাল রঙ আছে। যে রঙ তার অতি গোপন। একে সে ‘প্রেম’ বলে ধরে নি, কারন প্রেমে সে আগেও পড়েছে। কারো ডাকে ঘর ছেড়েছে, নির্দ্বিধায় হাতের শিরা কেটেছে, পুরো পৃথিবীকে পিঠ ঘুরিয়ে একজনকে পেতে চেয়েছে! এ ছেলের ক্ষেত্রে অমন ভাবনা তার একবারও আসে নি।

আজ প্রায় দশ বারো বছর পর মেয়েটি এখন ভাবে- ‘সিন্দুকে পুরে তালা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়া’ সম্পর্কে সে কী পেয়েছিল সেদিন? উত্তর তার- একটু খানি লিলুয়া বাতাস। যে বাতাস তাকে তার হারিয়ে ফেলা মূল্য ফিরিয়ে দিয়েছিল। মূল্য বেশি বা কম নয়, প্রকৃত মূল্য। সেখানে সৌন্দর্যের জন্য আলাদা স্কোর, মেধার জন্য আলাদা স্কোর, বাবার অঢেল সম্পদের জন্য আলাদা স্কোর- নেই। নেই- নিগেটিভ স্কোর, সম্ভাবনার স্কোর, আশংকার স্কোর।

দুইজনের মধ্যে যে ভালোবাসার সম্পর্ক সেখানে যার হাতে বালতি আছে সে ভালোবাসা তুলবে বালতি দিয়ে। যার হাতে মগ আছে সে তুলবে মগ দিয়ে। আর যার চামুচ সে তুলবে চামুচ দিয়ে। অন্যদিকে যে ভালোবাসায় দুই মানুষ অর্ধভেদ্য পর্দা দিয়ে আলাদা হয়ে আছে, যেখানে অভিস্রবণ- ব্যাপন- প্রশ্বেদন চলছে অনবরত- সেখানে তোলাতুলির প্রশ্ন নেই। উপহার নেই, স্মৃতি নেই, দায়িত্ব নেই, কাব্য কবিতা নেই, কিন্তু যা আছে ষোলোআনা। দুইজনের পাশাপাশি নীরবতার মধ্যে যে কথা হয় সেটি সর্বোত্তম কথা।

আজ এতো বছর পর সে শিখলো- ওই যে বলে না “দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু নেই, মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম”- কথাটি সঠিক নয়। মানুষ একবারই প্রেমে পড়ে। পরের প্রেমগুলোয় শুধু তার থেকে আচরণ ধার নিয়ে চলতে থাকে।

এখন মাঝরাত। বাইরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। একটানা ব্যাঙের ডাক। লাইটসব নিভিয়ে পুরো পাড়া ঘুমাচ্ছে। এখন চিঠি লেখার শ্রেষ্ঠ সময়। যে চিঠিগুলো প্রকাশ্যে পড়া যায় না, সাক্ষর বিহীন ও সংকেতে ভরপুর- সেগুলো সবচেয়ে কম পঠিত বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখতে হয়।

সব রিলেভ্যান্ট পৃষ্ঠার মাঝে এক দুই ইরিলেভ্যান্ট পৃষ্ঠা থাকে যা সবচেয়ে দামী! অন্তত দুইজনের কাছে তো বটেই- যে লুকিয়ে রাখলো এবং যে আসল মালিক- লিখেছিলো!

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

রোগীর জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে করোনাক্রান্ত ৫৩ দিন!

Sun Jun 28 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন ২০২০, রবিবার ডা. সিরাজুল হক অন্ধকার সুড়ঙ্গ শেষে আশার আলো। এখন অদৃশ্য অণুজীব করোনার বিশাল কুদৃশ্য মহা থাবার কালো কাল। ঘরবন্দি ভোরগুলি আগের মতন রৌদ্রকোজ্জল অনুভূতি বয়ে আনে না।আতংকিত মনে কম্পিত হাতে মোবাইল স্ক্রিন স্ক্রল বা  টিভি রিমোট চাপলেই ধাক্কা খেতে হয় মহামূল্যবান কারো না কারো […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo