রক্তের “ফুল”!

ডা. আশরাফুল হক
ট্রান্সফিউশন মেডিসিন স্পেশালিস্ট
Cord blood banking 3

নিকটাত্মীয়ের বাচ্চা হবার সংবাদে গিয়ে ভালো মন্দ দেখে শুনে ফিরে আসার সময় নাভিদের মনে খচখচ করতে লাগলো। তার নিজের বাচ্চার চিকিৎসা নিয়ে আলাপের সময় ডাক্তার সাহেব এক অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। অভিনব, কারণ নাভিদ আগে কখনো এমন চিকিৎসার কথা শোনেনি। কেউ বলেনি। মূল থিমটা হলো, বাচ্চার নিজের শরীরের স্টেম সেল পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে নিজের শরীরে প্রতিস্থাপন করা। স্টেম সেল কি? কোথায় পাবে? বাচ্চার শরীরে? কিভাবে রক্ত নিবে? কতদিন এই রক্ত রাখা যায়? কার্যকর থাকে? বাচ্চার রক্ত নিলে দুর্বল হয়ে পড়বে না? শিলা-নাভিদের ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে স্মিত হেসে ডাক্তার সাহেব শুরু করলেন –
এই জীবনে কত রকমের ফুল দেখেছেন? নিশ্চয়ই বহু রকমের। নানান রঙের ফুল। ঘ্রাণ ভিন্ন, কোনোটার ঘ্রাণ নেই। কোনোটার কাঁটা আছে। কোনোটা দুর্লভ, সহজে ফোটে না। কোনোটা সব জায়গায় হয় না। আবার আছে নানান ব্যবহার – প্রেমের ফুল, বিয়ের ফুল, অভ্যর্থনা, সংবর্ধনায় ফুল। শহীদ মিনারের ফুল। কোনটা সবচে দামি?
এমন সিরিয়াস চিকিৎসা বিষয়ক আলাপে ফুল নিয়ে এসব কথাবার্তায় ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েছে শিলা।

উনি বলে চলেছেন। সবদিক বিবেচনায় সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে আরাধ্য, বিশেষ করে আপনাদের জন্য – সে হলো গর্ভের ফুল! ফুল বললে হয়তো ভুল হয়, কিন্তু প্রচলিত কথার সূত্রে একে গর্ভের ফুলই বলা হয়। বাবা মায়ের শুক্রাণু-ডিম্বানুর মিলনে যে কোষের উৎপত্তি, তা থেকেই ভ্রূণ ও গর্ভের ফুল তৈরি হয়। মায়ের জরায়ুর ভিতরে জরায়ুর গায়ে ফুল আঁকড়ে থাকে। ভ্রূণ বড় হতে থাকে জরায়ুর ভিতর। বাচ্চা তার সমস্ত পুষ্টি পায় ফুলের মাধ্যমে। ফুল ও বাচ্চার যোগাযোগ রক্ষা করে নাড়ি বা নাভিরজ্জু (umbilical cord)। গর্ভের ফুলের বিশেষত্ব হলো এখানে প্রচুর স্টেম সেল থাকে। সেই যে প্রথম দুটি কোষ থেকে বাচ্চার চোখ মুখ হাত পা বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হচ্ছে, তা এই স্টেম সেল থেকেই। একই কোষ, বিভিন্ন ধরনের কোষ উৎপাদনের বিস্ময়কর ক্ষমতা সম্পন্ন।
নাভিদ সাহেব, আপনাদের বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় এই স্টেম সেল গর্ভের ফুল (প্লাসেন্টা) ও নাড়ি/নাভিরজ্জু ( umbilical cord) থেকেই পাওয়া যাবে। বাচ্চার শরীরের জন্য সবচে উপযোগী এই রক্ত বাচ্চার শরীর থেকে নিতে হবে না। এজন্য গর্ভের ফুলই যথেষ্ট। বলুন তো, ফুলটি দামি কিনা?

“সবচেয়ে দামি ডাক্তার সাহেব, সবচে দামি, এর চেয়ে দামি ফুল আর হতে পারে না। এ আমার বাবুর জন্য শ্রেষ্ঠ ফুল, সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে উপহার!”, শিলার চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ। মনের গহীনে চেপে রাখা হাহাকার বাঁধভাঙা অশ্রুজলে স্বস্তি হয়ে ঝরে পড়ছে। দু’কুল ছাপানো নদী যেমন বয়ে আনে পলিমাটি।

আর হ্যাঁ, এই ফুলটি যেন সবচেয়ে কার্যকর হয় সেজন্য আপনাদের কিছু প্রস্তুতি দরকার আছে। আপনার বাচ্চার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারের জন্য কিছু প্রস্তুতি তো নিতে হবে, পারবেন না আপা?
পারবো, অবশ্যই পারবো। পারতে আমাকে হবেই। চোখের জলে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় মায়ের পবিত্র চেহারা দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না।

এই নিন, এটা পড়ে দেখবেন। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে আবার আসবেন।
লিফলেট টা হাতে নিয়ে ভিজিট ও কাউন্সেলিং ফি দিয়ে বেরিয়ে এলো নাভিদ-শিলা। পড়তে শুরু করলো –

কর্ড ব্লাড নিয়ে গবেষণা প্রতিনিয়ত হচ্ছে,সেই গবেষণার আলোকে –

কারা কর্ড ব্লাড দিতে পারবে/কাদের কর্ড ব্লাড বেশি কাজের?

১। মায়ের বয়সঃ
গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণত ২৫-৩৫ বছর, এই বয়সটাই বেশি কার্যকর সন্তান ধারণের জন্য। আর তাই এই বয়সটাই বেশি ভালো কর্ড ব্লাড দাতার জন্য।

২। গর্ভধারণ সংখ্যাঃ
প্রথম বাচ্চার গর্ভধারণে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে ২য়,৩য়,৪র্থ বাচ্চার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা কমে যায়।

৩। গর্ভকালীন শারীরিক অবস্থাঃ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকা,
রক্তে সুগারের পরিমাণ ঠিক থাকা,
মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকা,
খিঁচুনির ঝুঁকি না থাকা/ পূর্ববর্তী খিঁচুনির ইতিহাস না থাকা বাঞ্ছনীয়।

কোন পদ্ধিতিতে কর্ড ব্লাড কালেকশন বেশি কার্যকরী?

গবেষণায় দেখা গেছে সিজারের মাধ্যমে কর্ড ব্লাডের পরিমাণ বেশি সংগ্রহ করা যায় স্বাভাবিক ডেলিভারির চেয়ে। আবার স্বাভাবিক ডেলিভারিতে Total nucleated cell(যা দিয়ে কর্ড ব্লাডের কর্মক্ষমতা দেখা যায়) বেশি থাকে সিজারের চেয়ে। কর্ড ব্লাড বাচ্চা বের হবার পর জরায়ুর সাথে লেগে থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করা যায় আবার আলাদা করে ফেলার পরও যায়।জরায়ুর সাথে লেগে থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করতে পারলে তাতে পরিমাণ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মায়ের এবং বাচ্চার কোন অবস্থার কারণে কর্ড সংগ্রহের পরও সরক্ষণ করা উচিত নয়?

১। ডেলিভারির ১২ ঘণ্টা আগে জরায়ুর পর্দা ছিঁড়ে গেলে।
২। মায়ের জ্বর হলে। শরীরের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি থাকলে।
৩। খুব দ্রুত প্লাসেন্টা বের হয়ে গেলে।
৩। Dystocia, Pre-eclampsia, abruptio placenta ইত্যাদি Medical condition থাকলে।
৪। APGAR score কম থাকলে(১ম মিনিটে ৭ এর নিচে, ৫ম মিনিটে ৫ এর নিচে)
৫। বাচ্চার ওজন ২৫০০ গ্রামের কম হলে।
৬। জন্মগত ত্রুটি থাকলে।

ল্যাবরেটরি রিপোর্ট কেমন থাকলে কর্ড ফেলে দিতে হয়?

১। সেলের পরিমাণ কম থাকলে
২। কর্ড ব্লাড ব্যাগের ওজন ৮০ গ্রামের কম হলে।
৩। কর্ড ব্লাড ব্যাগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে।
৪। কর্ড ব্লাড সংগ্রহের সময় জীবাণু আক্রান্ত হলে।

সোনালী সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

পরিবর্তনের ধারায় পথ দেখিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা

Sun Sep 23 , 2018
সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিভাগের জারিকৃত এক নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের প্রধানগণ (UHFPO – Upazilla Health and Family Planning Officer) উদ্বুদ্ধ হয়ে ৩৬ তম বিসিএসে সহকারী সার্জন পদে সদ্য নিযুক্ত মেডিকেল অফিসারদের বরণ করে প্রশংসিত হয়েছেন। বিগত অনেক বছর ধরেই নবনিযুক্ত এসকল সরকারি কর্মকর্তাগণ অনেকটা নিরবে তাঁদের কর্মস্থলে যোগ দিতেন। এলাকার গণ্যমান্য […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo