ব্রয়লার মুরগিতে প্রাণঘাতী ‘ই আল্বার্টি’ ব্যাকটেরিয়া: আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ

রবিবার, ০৪ মে, ২০২৫

‘ইনফেকশনে আক্রান্ত ব্রয়লার মুরগি, প্রাণঘাতী এ ইনফেকশন ছড়াতে পারে মানুষের মাঝেও’– শীর্ষক সংবাদ গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশি গবেষকরা দেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের বেশ কিছু দোকান থেকে মুরগি সংগ্রহ করে মাংসে ‘ই আল্বার্টি’ নামের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছে। এ ব্যাকটেরিয়া ই-কোলাই গোত্রভুক্ত।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড মাইক্রোবায়োলজিতে গত ২ মার্চ ‘অকারেন্স অ্যান্ড ক্রস কন্টিমিনেশন অব ই- আল্বার্টি ইন রিটেইল চিকেন আউটলেটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য। এই গবেষণায় কাজ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. জায়েদুল হাসান। তার সঙ্গী ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিশোর সস্মিথ উৎস, মো. ওহাব আলী, সুস্মিতা কর্মকার, ওসাকা মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ভেটেরিনারি সায়েন্সের সারদা প্রসাদ অবস্থি, ওসাকা প্রিফেকচার বিশ্ববিদ্যালযয়ের স্কুল অব লাইফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস চিহারু উয়ামা, ওসাকা মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির এশিয়ান হেলথ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের  নোরিতোশি হাতানাকা এবং সংক্রামক রোগের ওসাকা আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের শিনজি ইয়ামাসাকি এবং আতসুশি হিনেনোয়া।

তবে এ গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. জায়েদুল হাসান। বাংলা ট্রিবিউনের বরাতে এ বিষয় বিস্তারিত জানা গেছে। ড. জায়েদুল হাসান বলেছেন, ‘গবেষণাটি করা হয়েছে মানুষকে সচেতন করার জন্য, আতঙ্কিত করার জন্য নয়।’

জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়— ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে ময়মনসিংহের ৪টি উপজেলার ৬টি বাজারের ১৭টি খুচরা ব্রয়লার মুরগির দোকান থেকে ৬১টি মুরগি সংগ্রহ করা হয় সাধারণ প্রক্রিয়া করে। দোকানের কর্মচারীরাই মুরগিগুলো প্রক্রিয়া করে দেন, যেমনটি সবার ক্ষেত্রেই করা হয়। মুরগির মাংস, অন্ত্র এবং অন্যান্য অংশ আলাদা আলাদা ব্যাগে সংগ্রহ করা হয়। এরপর পরীক্ষাগারে ই-আল্বার্টি ব্যাকটেরিয়া শনাক্তের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অংশ পরীক্ষা করা হয়।

গবেষক ড. জায়েদুল হাসান বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল স্থানীয় বাজারে ফার্মের মুরগির মাংসে ‘ই আল্বার্টি’ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি আছে  কিনা। কারণ, জাপান এবং পশ্চিমা বিশ্বে সুপরিচিত ‘ই কোলাই’ ব্যাকটেরিয়ার মতোই আরেক ধরন ‘ই আল্বার্টি’ অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাংলাদেশে সবার প্রথম পাওয়া যায় ১৯৯১ সালে। তারপর এটা নিয়ে দেশে আর কোনও কাজ হয়নি। জাপানে আমাদের গবেষণা কাজের একটা বড় অংশ ছিল এটি। বাংলাদেশে এই ব্যাকটেরিয়ার অবস্থা কী, তা জানতে আমরা নমুনাগুলো স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করি। কারণ, এটি নিয়ে কোনও রিপোর্ট নেই। এই ধরনের ভ্যারিয়েন্টগুলো ডায়রিয়ার কারণ তো বটেই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কিডনি নষ্ট করে। সারা বিশ্বে মুরগির মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়ার  রিপোর্ট আছে।’

তিনি বলেন, ‘‘২০১৯ সালে আমরা কাজটি শুরু করি। প্রাথমিকভাবে আসলেই এই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব আছে কিনা, দেখার জন্য ‘সেফ ব্রয়লার’ থেকে কিছু মুরগি এবং স্থানীয় বাজার থেকে কিছু মুরগি সংগ্রহ করলাম। পরীক্ষা করার পর দুটি দোকানের মুরগিতে শনাক্ত করলাম। আমরা বুঝতে পারলাম যে, যে উৎস থেকে মুরগি আনা হচ্ছে বা যেখানেই রাখা হচ্ছে, কোনও না কোনও জায়গা থেকে এই দূষণের ঘটনা ঘটছে। তার ওপর ভিত্তি করে আমরা ময়মনসিংহের চারটি উপজেলার বাজারগুলোর ১৭টি দোকান থেকে ৬১টি মুরগি সংগ্রহ করি। এসব মুরগি ল্যাবে এনে পরীক্ষা করে দেখি যে, কিছু দোকানের মুরগিতে আছে, কয়েকটিতে নেই। তার মানে আমরা ধরে নিলাম এটা (ই আল্বার্টি)  আছে। মুরগিতে বিশেষ করে মুরগির মাংসে এই ব্যাকটেরিয়া থাকার কথা না, এই ব্যাকটেরিয়া কোনোভাবে মুরগিতে প্রবেশ করলে তা অন্ত্রে পাওয়া যেতে পারে। মুরগির মাংসে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি এটাই নির্দেশনা দেয় যে, মুরগির বিষ্ঠার সঙ্গে দূষণের ঘটনা ঘটেছে, অথবা মুরগি প্রক্রিয়া করার সময় ব্যবহৃত সরঞ্জাম, অথবা প্রক্রিয়া করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির মাধ্যমে দূষণটি হয়েছে। তখন আমরা আবারও মুরগি সংগ্রহ করি, একইসঙ্গে  যারা জবাই করেন, তাদের হাত থেকে সোয়াব সংগ্রহ করি। সেগুলো আবারও পুনরায় পরীক্ষা করি। দেখতে পাই যে, যেসব মাংসে ব্যাকটেরিয়াটি আছে, সেগুলোর প্রত্যেকটির বিষ্ঠায় সেগুলো আছে। এমনকি যারা জবাই করেন, তাদের হাতে এবং যে ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়, তাতেও আছে। মুরগি জবাই করে যেখানে ছেড়ে দেওয়া হয়, ওখানেও কিছু কিছু জায়গায় আছে।’

ড. জায়েদুল হাসান বলেন, ‘তাতেও কিন্তু আমরা বলতে পারি না যে, এসব সোর্স থেকে মুরগির মাংসে ব্যাকটেরিয়াটি এসেছে। সেজন্য আমরা আরেকটু অ্যাডভান্স লেভেলে কাজ করি। আমরা একই ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাকটেরিয়া ছড়াচ্ছে কিনা, সেটার অনুসন্ধান শুরু করলাম। আমাদের ধারণা ছিল, যে ব্যক্তি মুরগি প্রক্রিয়া করছেন তার কাছ থেকে মাংসে প্রবেশ করছে। এরপর হোল জিনোম সিকোয়েন্স করলাম। সেটা করার পর নিশ্চিত হলাম যে, কিছু কিছু দোকানের মাংসে, ছুরিতে এবং বিষ্ঠাতে যা আছে, একই ব্যক্তির কাছেও তা আছে। আমরা সোর্স ট্র্যাকিং করে বলতে পারি যে, মুরগির বিষ্ঠা থেকে এই দূষণটি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশের প্রাণ। আমাদের প্রোটিনের অন্যতম একটি উৎস। এই সেক্টরে কিন্তু একটা বড় শ্রমশক্তি জড়িত। এখন এত বড় শ্রমশক্তির চেষ্টার ফল যে মুরগি, সেটি খেয়ে যদি অসুস্থ হন, তাহলে সেটা আসলে দুঃখজনক। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে— এই পোল্ট্রির মাংসটি যেন নিরাপদ হয়েই মানুষের কাছে যায়। উন্নত বিশ্বে ই-আল্বার্টি’র বিচরণ বেড়ে যাচ্ছে, শঙ্কার জায়গা এখানেই।  আমাদের গবেষণার লক্ষ্য আতঙ্ক তৈরি করা না, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা না। আমাদের গবেষণা মানুষকে সচেতন করার জন্য।’

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দোকানগুলোতে মুরগি প্রক্রিয়া করার সময় বিষ্ঠা থেকে এই ব্যাকটেরিয়া মাংসের মধ্যে প্রবেশ করছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ ই-আল্বার্টি পাওয়া গেছে দোকানির কাছ থেকে, প্রাপ্ত নমুনায় যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রে করা ২০২১ সালের একটি গবেষণা থেকে অনেক বেশি। মুরগির বিষ্ঠায় ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ, আর মাংসে পাওয়া গেছে ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

প্ল্যাটফর্ম/এমইউএএস

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo