শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ হওয়া ২৪ লাখ টাকার পোশাক দুই বছরেও বিতরণ হয়নি। অথচ কাগজে-কলমে এসব পোশাক বিতরণ সম্পন্ন দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে কর্মচারীদের মধ্যে। অভিযোগ উঠেছে, বিতরণ না করেই সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, পোশাক বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়নি।

কর্মচারীদের বরাতে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ১৬ থেকে ২০তম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা প্রতিবছর ২ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের এক সেট ফুল সাফারি পাবেন। এছাড়া বছর শেষে কর্মচারীদের ১ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের একজোড়া জুতা, ১৫০ টাকা মূল্যের দুই সেট মোজা, ৩০০ টাকা মূল্যের একটি ছাতা, এক হাজার টাকা মূল্যের একটি ফুল সোয়েটার এবং ৬০০ টাকার একটি করে হাফ সোয়েটার দেওয়া হবে। অন্যদিকে নারী কর্মচারীদের ৫ হাজার টাকা মূল্যের দুটি জর্জেট ও দুটি সুতি শাড়ি, ১ হাজার ৮০০ টাকা দামের দুই জোড়া স্যান্ডেল, ৩০০ টাকার একটি ছাতা, শীতের পোশাক হিসাবে এক হাজার টাকার একটি সাধারণ মানের শাল চাদর, বর্ষাকালের জন্য ১ হাজার ৬০০ টাকা দামের একটি রেইনকোট ও অন্যান্য সামগ্রী দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী কর্মচারীরা আরও জানান, বিগত সরকারের আমলে কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পোশাক কেনার জন্য ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৯ টাকার টেন্ডার করেন। কার্যাদেশ পেয়ে এসব পোশাক সরবরাহ করে রাজশাহীর ডিসেন্ট টেইলার্স, নয়ন ট্রেডার্স ও নূর ট্রেডিং নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত সময়ে এসব পোশাক বুঝিয়ে দেওয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু কর্মচারীরা পোশাক পাননি।
যুগান্তরের বরাতে জানা যায়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী জানিয়েছেন- ২০২২-২৩ বছরে কয়েকজন কর্মচারীকে পোশাক কেনা বাবদ নামমাত্র কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাউকে পোশাক দেওয়া হয়নি। পোশাক দেওয়ার কথা বলে কর্মচারীদের ডেকে ডেকে স্বাক্ষর নেওয়া হলেও কেউ পোশাক পাননি। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কাউকে কিছুই দেওয়া হয়নি। মেডিকেল কলেজের নথিপত্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ১২৫ জন কর্মচারীকে পোশাক সরবরাহ করা হয়েছে। তালিকায় নাম রয়েছে তিনজন গাড়িচালক, ১০২ জন পুরুষ ও ২০ জন নারী কর্মীর নাম। এছাড়া ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের কাগজপত্রে ১১৯ জনকে পোশাক সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। এদের মধ্যে গাড়িচালক তিনজন, ৯৭ জন পুরুষ ও ১৯ জন নারী কর্মীর নাম রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কেউই পোশাক পাননি।
মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের গাড়িচালক আব্দুল হামিদ নিজের পোশাকেই গাড়ি চালান। তিনি জানান, কলেজ থেকে কোনো ধরনের পোশাক পাননি। অথচ স্টোর কিপারের তালিকায় দুই বছরে তাকে তিনটি ফুল সাফারি সেট দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
পোশাক বিতরণ না করে কাগজে-কলমে বিতরণ দেখানো প্রসঙ্গে মেডিকেল কলেজের স্টোর কিপার ফয়সাল হায়দার বলেন, আমার কাজ পোশাক বুঝে নেওয়া ও বিতরণ করা, আমি সেটি করেছি। আমার রেজিস্টারেও সেটি আছে। কর্মচারীরা পোশাক পায়নি কেন-এর জবাবে তিনি বলেন, এর বেশি আমি কিছু বলতে পারব না। পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম নূর ট্রেডিংয়ের মালিক হুমায়ুন ফরিদ বলেন, আমরা পোশাক সরবরাহ করেছি। তবে কী মালামাল দিয়েছি সেটা এখন মনে নেই। স্টোর কিপারকে বুঝিয়ে দিয়েছি। পোশাক দিয়েছি বলেই আমাদের কর্তৃপক্ষ বিল দিয়েছে। ডিসেন্ট টেইলার্সের মালিক এমদাদুল ইসলাম বলেন, আমি পোশাক সরবরাহ করিনি। তবে আমার লাইসেন্সে কেউ হয়তো দিয়ে থাকতে পারে। তারা মালামাল দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
মেডিকেল কলেজের সচিব তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, আমরা পোশাক বিতরণ করেছি। কর্মচারীরা কাগজে সই করে তা নিয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। পোশাক না পাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে পায়নি বলছে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসেন। পোশাক বিতরণের কোনো ছবি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ছবি তুলে রাখিনি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ফয়সাল আলম বলেন, যে সময়ের বিষয় তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে কর্মচারীদের পোশাক বিতরণের বিষয়ে কিছু অনিয়মের কথা আমিও শুনেছি। জানামতে, দুই বছর পরপর পোশাক দেওয়াটাও অনিয়ম। কারণ নীতিমালায় প্রতিবছরই দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। জানা গেছে, যে সময় পোশাক খাতে অনিয়ম হয়েছে তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন স্বাচিপ নেতা অধ্যাপক ডা. নওশাদ আলী। গত বছর ৫ আগস্টের পর তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। বিভিন্ন মামলায় আসামি হওয়ায় তিনি আত্মগোপনে আছেন। ফলে তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
