পর্ন আসক্তির স্নায়ুবিদ্যা: লজ্জা নয় বরং জানা উচিত

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ জুন, ২০২০, শনিবার

মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ

পৃথিবীতে বর্তমানে অনেকগুলো ভয়ংকর নেশার মাঝে অন্যতম হলো নিয়মিত/অনিয়মিত পর্ণগ্রাফি দেখা। নীলছবির দুনিয়া একবারের জন্যও টেনে নেয়নি মানুষকে, এমন ঘটনাই বলতে গেলে খুব কম আছে। বুঝতে সবারই অনেক দেরী হয়ে যায় যে, এটা আমাদের সমাজের প্রতিটা মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা প্রত্যেকেই জীবনের কখনো না কখনো এই পথে পা বাড়িয়েছি কিংবা অন্য কারো মুখে এটা নিয়ে শুনেছি। পর্ণগ্রাফি আমাদের সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে বেড়ানো টপিকগুলোর মাঝে ২৫ শতাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে। আমাদের চাওয়া পাওয়ার উপর ভিত্তি করে যারা পর্ণব্যাবসায়ের সাথে জড়িত, তারাও একে পরিবর্তিত করে যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। আমাদের ব্রেইনের সুপার স্টিমুলাস হিসেবে কাজ করে এই এডিকশনটি। কিছু নিউরোট্রান্সমিটার আছে যারা এই খারাপ নেশাটার জন্য দায়ী।

ডোপামিন হলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার, যা পর্ণ দেখার সময় প্রচুর পরিমানে মানুষের ব্রেইনে নির্গত হতে থাকে। এটা ব্যক্তির মাঝে একধরনের ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে আসে। তাছাড়া সেরোটনিন কাজ করে,যেটা আমাদের মুড কে ভালো রাখতে সাহায্য করে থাকে, এটা আমাদের মন ভালো এবং স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া অক্সিটোসিন নামের এক ধরনের হরমোন ক্ষরিত হয়, একে বলা হয় কুডল/সংযুক্তি হরমোন, এটা ব্যক্তিকে পর্ণ দেখার সময় মনে করায় সে কোন সঙ্গীর সাথে আছে।

ব্রেইনে যখন ডোপামিনের বন্যা শুরু হয়, মানুষ তার দুঃখবোধগুলো/খারাপ স্মৃতিগুলো একেবারেই ভুলে যায়, ভালো ভালো স্মৃতিগুলো তার মনে পড়তে থাকে একে একে। একটা কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করে এই ডোপামিন মানুষের শরীরে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আমাদের শরীরের ভেতরেই নেশা এনে দিতে পারে এমন দ্রব্য দেয়া আছে, মানুষ চাইলেই ডোপামিনের ক্ষরণে চলে যায় তার চিন্তাভাবনার জগৎ থেকে অনেকটা দূরে। ডোপামিনকে তাই মাঝে মাঝে কোকেইন এর সাথে তুলনা করা হয়। কারণ ব্রেইনের স্ক্যান করে দেখা গেছে যে, কোকেইন এডিক্টেড একজন ব্যাক্তির ব্রেইনে যেমন ছবি পাওয়া যায়, ডোপামিন এডিক্টেড ব্যক্তির ও একইরকম স্ক্যান (ব্রেইনের সাইজ, শেইপ) পাওয়া যায়। তাই পর্ণগ্রাফির নেশাটা অনেকটা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির কোকেইন (নেশাদ্রব্য) নেয়ার মতোই।

অক্সিটোসিন গর্ভবতী মায়ের শরীরে প্রচুর পরিমানে ক্ষরণ হয়। বাচ্চা জন্মাবার পর বাচ্চার সাথে একটা সম্পর্ক তৈরিতে অক্সিটোসিন কাজ করে থাকে। মানুষ যখন নরমাল সেক্সুয়াল একটিভিটিতে থাকে, তখন তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে সাহায্য করে এই হরমোন, তখনও প্রচুর হরমোন নিসৃত হয়। আবার অক্সিটোসিন আরো বেশি বেশি ডোপামিনকে ক্ষরণ করতে সাহায্য করে থাকে।

অতিরিক্ত পরিমানে এই নিউরোট্রান্সমিটার ক্ষরিত হওয়ার কারণে এর একটিভ সাইটগুলো কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়। ফলে ডোপামিনের রিলিজ হওয়া ও কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। তাই পর্ণ এডিক্টরা আগে যে নীলছবি দেখে নিজেদের ব্রেইনকে সন্তুষ্ট করতে পারত, সেটা আর আগের মতো পারেনা। তখন সে আরো ভয়ানক কিছুর দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করে, যাতে তার ডোপামিন লেভেলটা বাড়তে পারে। একে আমরা ডোপামিন টলারেন্স বলে থাকি।

উচ্চ মাত্রায় ডোপামিন ক্ষরিত হলে আমাদের ব্রেইনের মাঝে ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে আসতে পারে।আমাদের ব্রেইনের সামনের অংশ প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে (মস্তিষ্কের একটা অংশ) এ ক্ষতিটা মূলত হতে পারে। এতে ব্যক্তির চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন হয়, যার কারনে বিকলাঙ্গ চিন্তাভাবনা জন্মাতে পারে। ব্রেইনের সামনের অংশটা মানুষের চিন্তাভাবনা, ডিসিশন নেবার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রেইনের এই অংশ মানুষকে বলে, “এটা করো না, খারাপ কাজ, তোমার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে”। কিন্তু এই জায়গাটায় ওলট পালট হলে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারেনা।

ডোপামিনের বন্যা ব্রেইনের একস্থান থেকে অন্যস্থানে তথ্য পরিবহনের ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু ব্রেইনের নিউরোপ্লাসটিসিটির ক্ষমতা আছে, নিউরণগুলো তাদের গতিপথ সবসময় পরিবর্তন করছে। তাই এই নিউরণগুলোকে আবার স্বাভাবিক করে ফেলতে আমাদের ব্রেইন সক্ষম বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। আগামী দশ বছর পর হয়তো আমাদের ব্রেইন স্ক্যানিং করার ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পাবে, একটা স্ক্যান দেখেই হয়তো নিউরোলজিস্ট/সায়েন্টিস্টরা বলতে পারবে ব্রেইনের কোন জায়গা ডেপেলপড আর কোন জায়গা ডেভেলপড না, একটা মানুষ কি হ্যাপি নাকি ডিপ্রেশনে আছে, মানুষটা কি ভাবছে কিংবা তার চিন্তাধারা কেমন।

স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, পরামর্শ- এই ভয়াবহ সমস্যাটাকে কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হয়।নিজেরা জানি, সচেতন হই, অন্যকে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করি। এভাবেই আমাদের সবার প্রচেষ্টায় গড়ে উঠবে একটা সুস্থ ও সুন্দর মনের সমাজ।

Fahmida Hoque Miti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ৩৪ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৩৫০৪ জন

Sat Jun 27 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০ গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩,৫০৪ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন আরো ৩৪ জন, আরোগ্য লাভ করেছেন ১,১৮৫ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ১,৩৩,৯৭৮ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ১,৬৯৫ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ৫৪,৩১৮ জন। দুপুর ০২.৩০ ঘটিকায় […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo