দেশ-বিদেশ, ডাক্তারী ও কিছু কথা || পর্ব-৩

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৫ আগষ্ট ২০২০, বুধবার

ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস. (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান।

আজকে একটু নিজের কথা বলি। আমি দেশ ছেড়েছি ২০১২ তে। তার আগে গাইনী-অবসে তিনটি সরকারি হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে এফ সি পি এস ট্রেইনিং এর জন্য।

মেডিক্যাল কলেজে যখন ওয়ার্ড প্লেসমেন্ট হতো, সবচেয়ে বিরক্ত লাগতো গাইনী ওয়ার্ড। মনে হতো চিৎকার চেঁচামেচি ছাড়া এখানে আছে কী! কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে ইন্টার্নশিপ এর সময় আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো গাইনী ওয়ার্ড। ইন্টার্নিশিপ এর পর ঢাকায় ট্রেনিং শুরু করলাম, গাইনি-অবসেই। আমি শুনেছি গাইনী ওয়ার্ডে নাকি অনেক হিংসা, কাড়াকাড়ি। আমার ভাগ্য হয়তো ভালই ছিলো, আমি পেয়েছি প্রিয় সহকর্মী, বন্ধু, বড়বোন, মেন্টর। অত্যন্ত কষ্টকর সেই দিনগুলো শুধু তাদের জন্যই মধুর স্মৃতি হয়ে আছে।

তবে কিছু কিছু ব্যাপার তখনও আমাকে ভাবাতো। আমাদের ট্রেইনিং এর সিস্টেম। অনারারীর মত অমানবিক প্রথার কথা তো বাদই দিলাম। আমাদের ট্রেইনিং টা পুরোটাই পানিতে ফেলে সাঁতার শিখানোর মত। নিশ্চয়ই শুনে অবাক হচ্ছেন! এ আবার কেমন কথা! পানিতে নেমেই তো সাঁতার শিখতে হবে। তবে এ শেখা অনেকটাই খাবি খেতে খেতে শেখার মতো। দেখে শিখো, না হয় ঠেকে শিখো।

ঠেকে শেখার কিছু ভালো দিক আছে, মানুষ নাকি তা কখনো ভুলেনা। ট্রেইনিং এর সময় আমার হাতে একজন রোগীর ‘uterine inversion’ হয়, যা আমি এর আগে শুধু বইয়ের পাতায় দেখেছি, সিনিয়রদের আপ্রাণ চেষ্টায়, আল্লাহর রহমতে রোগীর জীবন আর জড়ায়ু দুইই রক্ষা পায়। আমার ট্রেইনিং পিরিয়ডের অনেক কিছুই আমি ভুলে গেছি, এটা কিন্তু ভুলিনাই। আমরা ডামির উপর কিছু প্র‍্যাক্টিস করিনা, এজন্য আমাদের জড়তা কম। যে দেশেই যাই, আমার মনে হয়েছে আমাদের ডাক্তারদের ক্লিনিক্যাল আই ভালো। কিন্তু ‘life is too short to learn from own mistakes.’ আমার কথা না, একজন ভারতীয় কন্সাল্ট্যান্ট এর কথা।

আমাদের ইউনিফর্ম কোন গাইডলাইন নাই, যা আমরা মানবো। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের রেফারেন্স থাকে, কোন ম্যাডাম কি পছন্দ করেন তার উপর। লেবার ইন্ডাকশন, সুচার ম্যাটেরিয়ালস, সিজারিয়ান এর আগে পরের রোগীর ব্যাবস্থা, ক্যাথেটার কতক্ষণ থাকবে, এন্টিবায়োটিক কখন পাবে, মুখে কখন খাবে, নির্ভর করে সিনিয়র ডাক্তারের পছন্দের উপর। অবশ্যই সিনিয়র ডাক্তাররা না জেনে বলেননা। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা ঠিক কোন নিয়ম অনুযায়ী আমল করবেন, জানা থাকলে কতই না ভালো হত!

আমাদের সরকারি হাসপাতালের সমস্যার তো অন্ত নাই। অসংখ্য রোগী, দক্ষ মিডওয়াইফ/নার্সের অভাব, তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের উৎপাত ও দুর্নীতি, পর্যাপ্ত ওষুধ পত্রের অভাব, সময়মতো ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট না পাওয়া, চাইলে এই লিস্টে আরো অনেক কিছু যুক্ত করা যাবে। ডাক্তাররা যে এতো সমস্যার মধ্যে কাজ করেন রোগীরা অনেক ক্ষেত্রেই বোঝেনা। আমাদের কমিউনিকেশন এ দুর্বলতা তো আছেই। তার উপর যদি আমাদের ইউনিফর্ম কোন গাইডলাইন না থাকে, আমরা দ্বিধায় ভুগতে বাধ্য। আমি খুব আশা করি আমাদের সিনিয়র ডাক্তাররা এক হয়ে প্রতিটা ম্যানেজমেন্ট এর জন্য ন্যাশনাল গাইডলাইন তৈরি করবেন, যা হবে আমাদের দেশের জন্য, যেমন উন্নত দেশগুলোতে আছে।

কর্পোরেট হাসপাতালে আমি কাজ করিনি, শুধু রোগী হয়ে গিয়েছি। আমার প্রথম ডেলিভারি হয় স্কয়ার হাস্পাতালে। আমি যেদিন প্রথম ডা. নার্গিস ফাতেমা ম্যাডামের চেম্বারে যাই, ঘিয়া রঙের জামদানী শাড়ী পরা অনিন্দ্য সুন্দর একজন মানুষ হেসে, সালাম দিয়ে রোগী দেখা শুরু করলেন, এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে ছিলো নতুন। উনি জানতেন না, আমি ডাক্তার আর জানার পর উনার আন্তরিকতা কমেনি, বেড়েছে। আমার ডেলিভারির দিন দুর্ভাগ্যবশত উনি দেশের বাইরে ছিলেন। অন্য দু’জন ডাক্তার খুবই যত্নের সাথে আমার ডেলিভারি করান, এক মুহুর্তের জন্য কেউ আমাকে সিজারিয়ানের জন্য কাউন্সেলিং করেননি বরং সাহস দিয়েছেন। স্কয়ারের লেবার রুমের সাথে আমি আমার কানাডার ডেলিভারি রুমের কোন পার্থক্য পাইনি।

তবে গাইনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারছিলাম কতটা আন্তরিকতার সাথে উনারা আমার লেবার ফলো আপ করছেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। একজন সাধারণ রোগী এমনকি অন্য ডিপার্টমেন্টের কোন ডাক্তারকেও যদি একটু বুঝিয়ে বলা না হয়, অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। সেখানে হঠাৎ করে যদি কোন ইমারজেন্সি হয়, যেটা প্রসূতি মায়ের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক, রোগী ভুল বুঝতে পারেন। আমার বোন যখন ডেলিভারির জন্য আমার পরামর্শ চায়, আমি সরাসরি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। ওর অভিজ্ঞতাও একই হাসপাতালে খুব ভালো, কয়েকজন অত্যন্ত দরদী ডাক্তারের জন্য।

চিকিৎসা সেবা যে একটা পণ্য, তাতে কারো নিশ্চয়ই কোন সন্দেহ নাই। মানুষ যেমন অনলাইন কেনাকাটার জন্য আগে রিভিউ দেখে, মুভি দেখার আগে রিভিউ পড়ে, ডাক্তার বা হাসপাতালে যাওয়ার আগেও তাই করে। একই পণ্য যেমন কেউ 5★ আবার কেউ 1★ দেয়, ডাক্তারের ব্যাপারটাও তাই। আমি তাই কারো কথা শুনে অবাক হইনা। তবে সোস্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে কারো দূর্নাম করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়। এভাবে চলতে দেয়া উচিত না।

যাই হোক, যা শুরুতে বলছিলাম, ২০১২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী আমি দেশ ছাড়ি ওমানের উদ্দেশ্যে। আমরা ৭ জন ডাক্তার ছিলাম ওই ফ্লাইটে। ওমানের রাজধানী মাস্কাট এ নেমেই প্রচন্ড গরমে অস্থির হই, বিকালে বেড়াতে যাই, মাত্রা কর্ণিশে। অসাধারণ সুন্দর সমুদ্র দেখে মুগ্ধ হই, সাথে রং বেরংয়ের জিনিসের পশরা নিয়ে পাশেই আছে “সউক”। কিন্তু সবকিছুর উপর পোস্টিংয়ের অনিশ্চয়তা, নতুন দেশ, নতুন ভাষা সবই বিরক্ত লাগছিলো। পরদিন পোস্টিং হয় দূরের সালালাহ শহরে, ওমানের একটি বড় শহর। এখানে তখনও কাউকে চিনিনা, খাবার দাবারের দুরবস্থা আর সব কিছুতেই মনে হত আতরের গন্ধ পেতাম। এরমধ্যে মেয়ে আর হাসব্যান্ড জ্বরে পড়াতে একটা ধাক্কা খেলাম, জীবন দূর্বিষহ মনে হচ্ছিলো। তখনও হাসপাতালে জয়েন করিনি, তাই বুঝিনি আরও ধাক্কা খাওয়া বাকি আছে।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনা হাসপাতাল থেকে - পর্ব ১৩ | করোনা জয়ী হতে মনোবল ধরে রাখুন

Thu Aug 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ আগস্ট, ২০২০, বৃহস্পতিবার প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার একাদশ ব্যাচ, শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল বলা হয়ে থাকে যাদের বডি ইমিউনিটি ভাল তাদের উপসর্গ আসে না, উপসর্গ থাকলেও তেমন কাহিল করতে পারে না৷ তাই বডি ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য ফেসবুকীয় পথ্য সেবনে আমরা চিকিৎসক হয়েও বাধ্য […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo