কোভিড দূর্ভোগ আর ভালবাসার ঋণ

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২ জুলাই ২০২০, বৃহঃস্পতিবার
ডা. সালমা আক্তার 
৩২ তম ব্যাচ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ   

পরম করুণাময়ের কৃপায় বেঁচে ফিরেছি। এখন আমি জানি, কোভিড -১৯ এক অবর্ণনীয় দূর্ভোগের নাম। প্রতিটি কোষে কোষে কষ্টের সুতীব্র যন্ত্রণার নাম। কোন শব্দে এই কষ্টের বর্ণনা করা সম্ভব না।

প্রবল জ্বরে কোভিড জোনের আইসোলেশন রুমে একা ছিলাম। কখনও ক্ষীণ স্বরে নার্সদের ডাকতে থাকতাম, বাইরে থেকে প্রায়ই সাড়া মিলতো না। প্রায়ই ‘কোড ব্লু’ শুনতাম, বুঝতে পারতাম কোন কোভিড রোগী দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন।

এই হাত দিয়েই অগণিত রোগীর কোভিড স্যাম্পল কালেক্ট করেছি। অথচ কোভিড আক্রান্ত হয়ে, আমি যেন এক ভীতিকর বস্তুতে পরিণত হয়েছি। কোভিড ইউনিটে কর্মরত ভিনদেশী চিকিৎসকরা সবাই আমার পরিচিত। ওনাদের কেউ কেউ আমার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কুশল জিজ্ঞেস করতেন, ফেসশিল্ডের আড়ালে তাঁদের খুব অচেনা মনে হতো।

মুখের ঘা, অরুচির জন্য হসপিটালের খাবার মুখে দিতে পারতাম না। প্রতিদিন হসপিটাল ডিউটি শেষে, আমার হাসবেন্ড ঘরে তৈরী খাবার নিয়ে আসতো, কিছু সময় থাকতো। এই একাকী প্রবাসে, রুগ্ন স্ত্রীর জন্য এটি ছিল আশীর্বাদ। গত দুই সপ্তাহ ধরে, দুটো ফুসফুসে নিউমোনিয়া; সাথে লুস মোশন, ডিহাইড্রেশনও আছে। সমস্ত মুখের ভেতর ঘা, আর আছে শ্বাসকষ্ট। এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত কেবলই আল্লাহর কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছি আর ক্ষমা প্রার্থনা করেছি। বেঁচে থাকার প্রাণান্ত সংগ্রাম করেছি।

এক রাতে কোন এক তীব্র জ্বরের সময়, প্রায় অচেতন হয়ে ডেলিরিয়ামে চলে গেলাম। মনে পড়ে, জিহবা আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। দোয়া পড়ার চেষ্টা করতে করতে মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতরের প্রাণপাখি বুঝি এখনই উড়ে চলে যাবে। ঠিক কতক্ষণ পর জানিনা, সহসা চেনা একজন ফিলিপিনো নার্সের ডাক শুনতে পেলাম (একসময় আমার সাথে দীর্ঘদিন ওয়ার্ডে কাজ করেছে)। ও আমাকে ডেকে বলছে,

“ডক্টর, তুমি অক্সিজেন মাস্ক রিমুভ করেছ কেন? স্যাচুরেশন কমছে। তোমার অনেক জ্বর, আইভি প্যারাসিটামল শুরু করেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। অক্সিজেন নাও।”

কখন মাস্ক রিমুভ করেছি, নিজেই জানি না। কেবল মনে হচ্ছিলো, মাস্ক ভর্তি অক্সিজেন, কিন্তু আমার দুটো ফুসফুসে কোন কিছুই নিতে পারছেনা। কেবল ভয়াবহ যন্ত্রণা! মৃত্যুকষ্ট খুব কঠোর আর কঠিন বলেই শুনেছি। যেন সেই কষ্টের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। ওষুুুুধের কতটা ভূমিকা ছিল জানি না। শুধু জানি, এক অলৌকিক মহাশক্তি আমাকে এ পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো।

ধীরে ধীরে একসময় জ্বর নেমে গেল। তৃতীয় সপ্তাহে হসপিটাল থেকে ছুটি পেলাম। এই অদৃশ্য কোভিড এর দাপটে সমস্ত শরীর ভঙ্গুর, শ্বাসকষ্ট ও প্রচন্ড দূূূূূর্বলতা; এখনও লড়ছি।  তবু ভাবতেই চোখ জলমগ্ন হয়, আমি এখনও বেঁচে আছি। পরম করুুুুণাময়ের কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞতা। স্বদেশে, প্রবাসে আমার স্বজন-পরিজন , বন্ধুমহল, সিনিয়র জুনিয়র, আত্মীয় -অনাত্মীয়, অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে, ভালবাসা আর প্রার্থনার আকাশচুম্বী ঋণ। এ জগতে ভালবাসারই প্রাচুর্য। সকলের দেওয়া সহানুভূতি, সাহস আর দোয়ার বরকতে সৃষ্টিকর্তা এই অধমের প্রাণভিক্ষা দিয়েছেন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর প্রার্থনা।

সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর মিছিল, চেনা অচেনা সহস্র জনের মৃত্যু, বুকের ভেতরে দুঃখের দামামা। এর মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি অমূল্য কিছু হীরকখণ্ড। মেধাবী চিকিৎসকদের এই হারিয়ে যাওয়ার শূণ্যতা, কত শতাব্দীতে পূর্ণ হবে জানি না। সকল শহীদ করোনা -যোদ্ধাদের ওপাড়ে চির শান্তিতে রাখুন মহান সৃষ্টিকর্তা।

পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে উঠুক এই প্রার্থনা করি।

Tasnim Sanjana Kabir Khan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কুমিল্লায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা

Thu Jul 2 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২ জুলাই, ২০২০, বৃহস্পতিবার গত ২৪ ঘন্টায় কুমিল্লায় নতুন করে আরও ১৩৭ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। কুমিল্লা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এইসব তথ্য জানা যায়। সিভিল সার্জন সূত্র থেকে জানা যায়, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৬ জন, আদর্শ সদর উপজেলায় ৮ জন, বরুড়া উপজেলায় […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo