আরেকটি মহামারীর দিকেঃ চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে “এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, বৃহস্পতিবার

ডা. আদনান মান্নান
সহযোগী অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং মা ও শিশু হাসপাতালের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে “এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স” তথা এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল এবং আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ এর শুরু পর্যন্ত আসা এক হাজার নিউমোনিয়া রোগীদের ৭০ ভাগের মধ্যেই দেখা গেছে অন্তত একটি এন্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশী এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা দেখা গেছে নবজাতক, শিশু ও তরুণদের মাঝে। প্রতি চারজন নিউমোনিয়া আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে তিনজনের শরীরেই মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তথা তিনটি বা তার অধিক এন্টিবায়োটিক অকার্যকর দেখা গেছে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে এই হার অনেক বেশী। সম্প্রতি এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল “প্লস ওয়ান” থেকে। মূলত কাজটি ছিল আমার মাস্টার্সের থিসিস ছাত্রী আফরোজা আকতার তন্বী’র। সহযোগী তত্বাবধায়ক ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক মাহবুব হাসান এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাহিদ সুলতানা ও নবজাতক নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (এনআইসিইউ) পরিচালক ডা. ওয়াজির আহমদ। এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা বর্তমান বিশ্বে একটি ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য সমস্যা। ব্যাকটেরিয়া তথা অণুজীবের বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা যত কমে যাবে তত বেশী এইসব জীবাণুর সংক্রমণ বেড়ে যাবে, এর চিকিৎসার উপায় বা প্রতিষেধক কমে যাবে ও সংক্রমণ মারাত্মক আঁকার ধারণ করবে। উক্ত গবেষণায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ক্লেবসিয়েলা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাধিক ব্যবহৃত ২০ টি এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যবেক্ষন করা হয়।

কি পাওয়া গেল?

১. এতে ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সেফুরিক্সিম, সেফিক্সিম, সেফটেক্সিম ও সেফটাজিডিম গোত্রের এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে।

২. গবেষণার নয় ভাগ নিউমোনিয়া আক্রান্ত নবজাতক ও শিশুর শরীরে কোন এন্টিবায়োটিকই কাজ করেনি।

৩. মোট সাত শতাংশ রোগীর শরীরে দেখা গেছে কোন এন্টিবায়োটিকই কাজ করছে না। অর্থাৎ সুপারবাগ তৈরি হয়েছে।

৪. পিসিআর, জিন সিকুয়েন্সিং ও বায়োইনফরমেটিক্স পদ্ধতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক অকার্যকারিতার জন্য কোন কোন জিনগুলো দায়ী তা অনুসন্ধান করে দেখা হয় এবং নিউ দিল্লি মেটালো বিটা লেক্টামেজ (এনডিএম-১) জিনটির উপস্থিতি সর্বাধিক হারে (৭০%) পরিলক্ষিত হয়, এর পরেই রয়েছে ইউজিই, এসএইচভি জিন। এই জিন ইতিপূর্বে ভারত, কানাডা, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের রোগীদের জীবাণুর মাঝে পাওয়া যায়। এছাড়াও চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোগীদের মাঝে এনডিএম-১ এবং এসএইচভি জিনের গঠনে কিছু নতুন ধরনের ভিন্নতা (মিউটেশন) পরলক্ষিত হয়। যার জন্য হয়তবা জীবনযাপনের প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান দায়ী। এই মিউটেশন হয়তবা ব্যাকটেরিয়ার এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে।

৫. হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বিপুল সংখ্যক রোগী এন্টিবায়োটিক অকার্যকর ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। হাসপাতালের বেসিন থেকে পানি, নালার পানি, বিছানার চাদর, দেয়ালের বিভিন্ন নমুনা’তে উক্ত এন্টিবায়টিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী এমন একাধিক জিন চিহ্নিত করা হয়।

কেন এমন হচ্ছে?

১। এন্টিবায়োটিক এর অতিরিক্ত কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার শরীরে অণুজীবগুলোকে এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা তৈরি করে এবং পরবর্তিতে এই এন্টিবায়োটিক উক্ত ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারায়। ফলশ্রুতিতে উক্ত রোগে আক্রান্তদের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর কোন প্রতিষেধক বা চিকিৎসার উপায় থাকেনা। এছাড়াও একাধিক এন্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা তীব্র সংক্রমণের দিকে রোগীকে ধাবিত করে।
২। এছাড়াও এধরনের অণুজীব মা থেকে শিশুতে প্রবাহিত হতে পারে।
৩। পোল্ট্রি ও গবাদি পশুকে অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ কিংবা
৪। অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক এর ব্যবহার এই অকার্যকারিতা সৃষ্টি করছে
৫। হাসপাতাল থেকে।

কোন কোন এলাকায় বেশি মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স রোগী?
গবেষণার আরেকটি অংশে “এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ম্যাপিং” তথা এন্টিবায়োটিক কোন কোন অংশে বেশী তা চিহ্নিত করা হয়। এতে দেখা যায় শহরাঞ্চলে সিটি কর্পোরেশন এলাকাগুলোর মধ্যে, আগ্রাবাদ, ডবল্মুরিং, পাচলাইশ, হালিশহর, বায়েজিদ ও বাকলিয়া এলাকায় এবং গ্রামে সীতাকুণ্ড, পটিয়া, হাটহাজারী ও চন্দনাইশ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী একাধিক এন্টিবায়োটিক অকার্যকর এরকম রোগীর সংখ্যা বেশি। এর কারণ হতে পারে এসব এলাকায় ফার্মেসির সংখ্যা বেশি এবং উক্ত ফার্মেসিগুলোতে অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে এন্টিবায়োটিক বিক্রি।

কি করা দরকার?
ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের সবগুলো হাসপাতাল এবং পুরো দেশব্যাপী আরও ব্যাপক আকারে গবেষণাটি প্রয়োজন। উল্লেখ্য, এন্টিবায়োটিক ব্যবহার ও অননুমোদিত বিক্রির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়নি। চট্টগ্রামে এই মুহূর্তে প্রায় ছয় হাজার ফার্মেসি রয়েছে যার মধ্যে অর্ধেকই সরকারী লাইসেন্সবিহীন।

পাশে কারা ছিলেন?
এই গবেষণার অর্থায়ন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা দপ্তর এবং সহায়তায় ছিল ডিজিজ বায়োলজি এন্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ চিটাগাং। দেশে ফেরার পর আমার প্রথম গবেষণা শিক্ষার্থীর কাজ প্লস ওয়ান এ প্রকাশিত হল। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছিলাম আমার জন্য এটা কিন্তু স্বপ্ন ছিল। আমরা বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশের জন্য এবং বাংলাদেশের সমস্যা নিয়েই কাজ করি।

গবেষণা পত্রের লিংকঃ https://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371%2Fjournal.pon

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

৯ম বর্ষে পদার্পণ করলো প্ল্যাটফর্ম অব মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটি

Mon Sep 27 , 2021
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, সোমবার  দেখতে দেখতে অষ্টম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এসে পৌঁছালো দেশের চিকিৎসক ও মেডিকেল ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্ল্যাটফর্ম অব মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটি। ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় প্ল্যাটফর্মের। প্ল্যাটফর্মের গোড়াপত্তনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে তিনি হলেন ডা. মহিবুর হোসেন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo