আপনার মৃত্যু সংবাদ মেনে নেবার মতো অনুভুতিশুন্য হতে পারিনি, স্যার

২৬ জুন ২০২০, শুক্রবার

ডা. মিনহাজুল হাসান
আবাসিক চিকিৎসক
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

শুধু হাসিমাখা মুখ আর সুন্দর চেহারার কারনে কেউ বিখ্যাত হতে পারেনা। শুধু স্মার্টনেসই কাউকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাও এনে দিতে পারেনা।

আবার কেবল রোগীর প্রতি দরদ থাকলেই চিকিৎসক হিসেবে নাম কেনা যায়না। সততা, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা একজন চিকিৎসকের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় গুণ, কিন্তু শুধু এইসব গুণ থাকলেই খুব ভাল কিংবা বিখ্যাত চিকিৎসক হওয়া যায়না। বিনয়, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুবৎসল আচরন, সহৃদয়তা – এইসব গুণ একজন চিকিৎসক কে তার ছাত্রছাত্রী, প্রশিক্ষণার্থী আর সহকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে বটে, কিন্তু কেবল এই সকল গুনাবলীর সমাবেশ একজন চিকিৎসককে মানুষের ভরসা আর আস্থার বাতিঘরে পরিনত করেনা।

কিন্তু যদি এই সমস্ত গুণাবলীর সমাবেশ একজন মানুষের মধ্যেই থাকে?
সেই মানুষ টা কতটা জনপ্রিয় হতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর গত বারো ঘন্টার ফেসবুকের নিউজফিড।
এত গুণের সমাহার যার মধ্যে ছিল, তাকে এক কথায় কি বলা যায়? ক্ষণজন্মা? ভাষাজ্ঞান যেহেতু খুব একটা ভাল নয়, তাই আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। শুভক্ষণে তিনি জন্মেছিলেন কিনা জানিনা, তবে দুনিয়া ছেড়ে গেলেন বড় অশুভ সময়ে। যিনি সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী, তিনি হয়তো তার প্রিয় বান্দাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবার জন্য এটাই ভাল সময় মনে করেছেন!

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’, সেই আঁধারে হারিয়ে গেলেন আমাদের প্রিয় বাবু স্যার!
নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়। হয় নাকি?
হ্যাঁ, হয়। খুব তাড়াতাড়িই মরে যেতে হয়। আলো গুলো একে একে এভাবেই নিভে যায়!

আক্ষরিক অর্থেই তিনি নক্ষত্র ছিলেন। চট্টগ্রামের অর্থোপডিক সার্জারির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে অর্থোপেডিশিয়ান দেখানোর প্রয়োজন হলে যে কারোরই তাঁর নামটিই প্রথমে মনে আসত।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হোক কিংবা মেট্রোপলিটন হাসপাতাল – নক্ষত্রের মতোই আলো ছড়াচ্ছিলেন। ছাত্রছাত্রী, ট্রেইনী, সহকর্মী কিংবা রোগী – সবার কাছেই ছিলেন দারুন ভরসার জায়গা। আলোকিত একজন মানুষ ছিলেন, তাঁর মোটামুটি কাছে যাওয়া মানুষ গুলোও সেই আলোর রোশনাই টের পেত। আলো ছড়ানো মানুষ ছিলেন যে!

মাত্র চার মাস তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। এই চার মাসে আমার টার্গেট ছিল যত বেশি সম্ভব তাঁর সাথে সময় কাটানো যায়। তাঁর সাথে কাজ করা সব জুনিয়রদের এই টার্গেটই থাকে সাধারণত। হাতের কাজের চেয়ে তাঁর কাছ থেকে বেশি শিক্ষণীয় ছিল মানবতা আর পজিটিভ দিকগুলো। সবকিছুকেই পজিটিভ ভাবে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। নানা অনিয়মের মধ্যে থেকেও নীতির সাথে আপোষ না করে সবকিছু ম্যানেজ করে কাজ চালিয়ে যাবার এক সহজাত দক্ষতা ছিল মানুষটার।

করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হাত উঁচিয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন – ফিরে এসে প্লাজমা দিবেন। এমন অদম্য মানুষটি কি নির্মম ভাবে পরাজিত হলেন করোনার কাছে!
চার মাসে তাঁকে কখনো রাগতে দেখিনি, দেখিনি মন খারাপ করতে। সবসময়ই হাসিখুশি, প্রাণবন্ত আর বন্ধুবৎসল। জ্ঞানে, গুণে, মানে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন, অথচ আমার সাথে, এবং সমস্ত ট্রেইনীদের সাথে তাঁর আচরণ ছিল নিতান্তই বন্ধুসুলভ।

অসম্ভব কাজ পাগল মানুষ ছিলেন। কেউ সাহায্য করবে – সেজন্য অপেক্ষা করতেন না। হয়তো ওটি টেবিলটা নোংরা হয়ে আছে, দেখা গেলো তিনি নিজেই সেটা পরিষ্কার করে ফেললেন – ওটি বয়রা করে দেবার জন্য অপেক্ষাই করলেন না! হয়তো ওটি বয়রা রোগী তুলতে দেরি করছে, দেখা গেলো তিনি নিজেই পাঁজাকোলা করে কোলে নিয়ে রোগীকে এনে ওটি টেবিলে শুইয়ে দিলেন!

এমন অমিত শক্তিধর মানুষটি করোনার কাছে হেরে গেলেন!
অর্থোপেডিক সার্জারিতে ‘বাংলা ওয়াশ’ নামে একটা কথা প্রচলিত আছে। বিশেষ করে রুটিন ওটি গুলোতে অপারেশনের জায়গাটা সাবান আর হেক্সিসক্রাব দিয়ে খুব ভাল করে ধুতে হয় অপারেশন শুরু করার আগে। সাধারণত ওয়ার্ড বয়রাই কাজটি করে। কিন্তু সমীর স্যার ভিন্ন ধাতুতে গড়া মানুষ। তাঁর ওটিতে বাংলা ওয়াশ দেবে সেই সাধ্য কার? বাংলা ওয়াশ থেকে শুরু করে অপারেশন এবং অপারেশনের পরে রোগী নামানো পর্যন্ত– তাঁর কাছ থেকে সবকিছুই শেখার মতো ছিল। সবকিছুতেই তিনি হাত লাগাতেন। একজন সত্যিকারের নেতার মতো।

এমন উদ্যমী মানুষটি এত তাড়াতাড়ি চির অবসরে চলে গেলেন!
ঠিক এমনই হাসিমাখা মুখ, এমন নিবেদিত প্রান কাজ পাগল মানুষ, এমন বিনয়ী, হৃদয়বান আর বন্ধুবৎসল সহকর্মী, এতোটা পরোপকারী চিকিৎসক কি চট্টগ্রাম শহরে সহসাই আরেকজন আসবেন?

এই প্রশ্নের উত্তর জানেন তিনিই, যিনি সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। এত মানুষের হৃদয় নিঙড়ানো দোয়া তিনি অগ্রাহ্য করলেন। মানুষটাকে ফিরিয়ে দিলেন না। হয়তো তাঁর প্রিয় বান্দার জন্য এরচেয়ে ভাল কিছু তিনি পরিকল্পনা করে রেখেছেন।

কিন্তু মন মানছে না। বুকের মধ্যে হাহাকার, প্রিয়জন হারানোর বেদনা। হাসিমাখা সুন্দর মুখটি চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছি না। জানিনা তাঁর পরিবারের কেমন লাগছে। আল্লাহ তাদের এই শোক সইবার শক্তি দিন।

প্রায় প্রতিদিনই চিকিৎসকদের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। অনুভুতি গুলো কেমন ভোতা হয়ে গেছে। এখন মনে হয় প্রতি দিনই আমাদের কেউ না কেউ মারা যাবে – এটাই স্বাভাবিক!

কিন্তু আপনার মৃত্যু সংবাদ মেনে নেবার মতো অনুভুতিশুন্য এখনো হতে পারিনি, স্যার।
আমার প্রিয় সমীরুল ইসলাম বাবু স্যার!

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

প্রিমেন্সট্রুয়াল সিন্ড্রোম - যা জানা প্রয়োজন

Fri Jun 26 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬ জুন, ২০২০, শুক্রবার মঈনুল ইসলাম চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ প্রতিমাসেই পৃথিবীর সকল প্রাপ্তবয়ষ্কা মেয়েদের পিরিয়ড নামক স্বাভাবিক এবং শারীরিক জটিল একটা প্রক্রিয়ার মাঝে দিয়ে যেতে হয়। পিরিয়ড/মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল পৃথিবীর খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলোর মাঝে অন্যতম। সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়, সাগড়ে ঢেউ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo