রাশিয়ার দ্বৈত-ভেক্টর করোনা ভ্যাকসিনটি দৈত্যের মতই শক্তিশালী – ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার  

ডা. খোন্দকার মেহেদী আকরাম
এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।

সকল সমালোচনা এবং সন্দেহকে পেছনে ফেলে রাশিয়া অবশেষে তাদের করোনা ভ্যাকসিনের ফেইজ- ১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল ৪ সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য দি ল্যানসেট জার্নালে। তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল খুবই আশাব্যঞ্জক।

রাশিয়ার মস্কো শহরে অবস্থিত বিখ্যাত গ্যামালিয়া ইন্সটিটিউট এই ডুয়েল বা দ্বৈত ভেক্টরের করোনা ভ্যাকসিনটি আবিষ্কার করেছে এবং নাম দিয়েছে স্পুটনিক-৫। এযাবৎ উদ্ভাবিত যতগুলো করোনা ভ্যাকসিন তৈরী হয়েছে তার ভেতরে গ্যামালিয়াই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা ভ্যাকসিন তৈরীতে একটির পরিবর্তে দুইটি হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করেছে। ২১ দিনের ব্যবধানে দেয়া দুই ডোজের ভ্যাকসিনে প্রথম ডোজে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাড-২৬ নামক বিরল প্রজাতির অ্যাডিনোভাইরাস এবং দ্বিতীয় ডোজে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারন অ্যাড-৫ জাতের অ্যাডিনোভাইরাস। ডিএনএ রিকম্বিনেন্ট টেকনোলজির মাধ্যমে এই অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টরগুলির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে নোভেল করোনাভাইরাসের একটি জিন, যা করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরীতে সক্ষম। এই স্পাইক প্রোটিনটিই শরীরে করোনাভাইরাসের বিপরীতে ইমিউন রেসপন্স ঘটিয়ে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

একই ধরনের অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর পদ্ধতিতে চীনের ক্যানসিনোবায়ো এবং অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১ ভ্যাকসিন দুটি তৈরী করা হয়েছে। এ ধরনের অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিনগুলোর একটা বড় সমস্যা হচ্ছে এন্টি- ভেক্টর ইমিউনিটি। অ্যাডিনোভাইরাস খুব সাধারণ একটা ভাইরাস এবং এটা প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে ঠান্ডা সর্দি- জ্বর করে থাকে। আর এ কারণেই আমাদের শরীরে অনেক ক্ষেত্রেই এই ভাইরাসটির বিপরীতে ইমিউনিটি বা এন্টিবডি তৈরী হয়ে থাকে। কারো শরীরে যদি ভ্যাকসিন দেয়ার আগেই অ্যাডিনোভাইরাসের বিপরীতে এন্টিবডি টাইটার ২০০ এর বেশী হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা অনেকটাই হ্রাস পেতে পারে। এরকম সম্ভাব্য সমস্যা এড়ানোর জন্যই কিন্তু অক্সফোর্ড মানুষের অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার না করে ব্যবহার করেছে শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস। শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাসের বিপরীতে মানবদেহে কোন রকম ইমিউনিটি নাই বললেই চলে। পরীক্ষায় মাত্র এক শতাংশ মানুষের শরীরে শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাসের বিপরীতে এন্টিবডি পাওয়া গিয়েছে (ল্যানসেট, ২০ জুলাই)। অন্যদিকে, ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিনটি পড়েছে বেকায়দায়। বোকার মত ভেক্টর হিসেবে তারা ব্যবহার করেছে হিউম্যান বা মানুষের অ্যাডিনোভাইরাসের খুবই কমন বা পরিচিত একটি প্রজাতি অ্যাড-৫, যার বিপরীতে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের শরীরেই এন্টিবডি পাওয়া যায় (ল্যানসেট, ২২ মে)। অতএব, ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিনটির কার্যকারীতার হার নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়ে গেছে।

ওদিকে চতুর রাশিয়া হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার করলেও, এক্ষেত্রে তারা বেছে নিয়েছে বিরল প্রজাতির অ্যাডিনোভাইরাস (অ্যাড-২৬); যার বিপরীতে আমাদের শরীরে ইমিউনিটি খুবই কম। আর এর ফলেই স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটির কার্যকরীতায় এন্টি- ভেক্টর ইমিউনিটি তেমন কোন বিরুপ প্রভাব ফেলবে না। গ্যামালিয়া ইন্সটিটিউট ১৮ জুন থেকে শুরু করে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৭৬ জন ভলান্টিয়ারের উপর তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায় এবং তার পূর্ণ ফলাফল প্রকাশ করে ল্যানসেট জার্নালে ১ মাসের ভেতরই। এ থেকেই বোঝা যায় তাদের ট্রায়ালের ফলাফল কতোটা যথার্থ ও নির্ভুল ছিল। এত দ্রুত সময়ে ল্যানসেটের মত জার্নালে ফলাফল প্রকাশ করা চারটে খানি কথা নয়!

ট্রায়ালে স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটির যে দুইটি ফর্মুলেশন পরীক্ষা করা হয়েছে:

একটি হিমায়িত এবং আরেকটি লাইপোফিলাইজড পাউডার। এই দুটো ফর্মুলেশনই বেশ ভাল কাজ করেছে এবং প্রথম ডোজ টিকা দেয়ার ২৮ দিনের ভেতরেই শতভাগ ভ্যাকসিন গ্রহীতার রক্তে পর্যাপ্ত করোনাভাইরাস নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরী করেছে, যার পরিমাণ ছিল কনভালেসেন্ট প্লাজমায় থাকা এন্টিবডির সমান। শুধু তাই নয়, দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার পরে সবার শরীরেই টি-সেল (CD4+ এবং CD8+) রেসপন্স ঘটেছে যেখানে টি- সেলগুলো ভাইরাস নিরোধক ইন্টারফেরন- গামা তৈরী করেছে ১০ গুনেরও বেশী (ল্যানসেট, ৪ সেপ্টেম্বর)। এ থেকে বলা যায় যে স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটি অত্যাধিক কার্যকরী এবং সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দিতে সক্ষম।

এছাড়াও গ্যামালিয়ার দাবী হচ্ছে যেহেতু তারা তাদের ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ডোজ এবং বুস্টার ডোজে দুই ধরনের ভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করছে, সেহেতু তাদের ভ্যাকসিনটি অক্সফোর্ড বা ক্যানসিনোবায়োর ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশী শক্তিশালী ইমিউন রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম।

রাশিয়ার ভ্যাকসিনে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মত কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হয়েছে। যেমন-

  • ভ্যাকসিন পরবর্তী গা ব্যথা,
  • জ্বর,
  • মাথাব্যথা,
  • টিকার স্থানে ব্যথা ইত্যাদি।

তবে ভ্যাকসিনটি তেমন কোন মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃস্টি করেনি।

রাশিয়া এখন তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশে প্রায় ৩০- ৪০ হাজার ভলান্টিয়ারের উপর। এই শেষ ধাপের ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হলে স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটি হতে পারে প্রকৃতই একটি শক্তিশালী করোনা ভ্যাকসিন।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ৩৫ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ১৯৫০ জন

Sun Sep 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১,৯৫০ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন আরো ৩৫ জন এবং আরোগ্য লাভ করেছেন ১,৬৬১ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ৩,২৩,৫৬৫ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ৪,৪৪৭ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ২,১৭,৮৫২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo