পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮শে জুন, ২০২০, রবিবার

লেখা: মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ

একটা ফুটবল টিমের জন্য কিছু সদস্য বাছাই করা হলো। টিমের কোচ সদস্যদেরকে ডেকে এনে কে কেমন পারফর্ম করতে পারে তার একটা ধারণা নিজের মাথায় সেট করলেন। টিমের সদস্য রহিমকে দেখে তার কাছে মনে হলো, সে খুবই পরিশ্রমী বালক এবং খেলায় ভালো করতে পারবে। দলের অন্য সদস্য করিমকে দেখে তার মনে হলো, সে একটু মোটা এবং অলস; তাকে দিয়ে ভালো কিছু হবেনা।

তার পরেরদিন থেকে ফুটবলের ট্রেইনিং শুরু হলো। কোচ করিমকে বেশি বেশি সময় দেয়, তাকে সাহস দেয়, সে ভুল করলেও কোনরকম বিরক্ত হয়না, তাকে উৎসাহিত করে। অপরদিকে, রহিমকে কোচ কোন এক্সট্রা সময় দেয়না, সে অল্প ভুল করলেই তার প্রতি ক্ষেপে যায়, বিরক্ত হয়। এতে হলো কি, করিমের ফুটবলের স্কিলগুলো দিন দিন আরো বেড়ে যেতে লাগলো, সে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া শুরু করলো,তার ভুলের পরিমান কমতে লাগলো। সে তার কোচকে একজন ভালো মনের মানুষ ভাবা শুরু করলো। অন্যদিকে, রহিম বকা খেয়ে খেয়ে নিজেকে অযোগ্য ভাবতে লাগলো, তার আজকাল এই ট্রেইনিং ক্লাসগুলো আর ভালো লাগেনা; তাই সে মাঝে মাঝে যায়না ট্রেনিংয়ে।

কোচ দেখলো যে করিম আসলেই অনেক ভালো করে ফেলছে খেলায়, যেখানে রহিমের কোন পাত্তাই নেই! কোচ মনে মনে বেজায় খুশি। তার ধারণাই তাহলে সঠিক হলো!

ব্যাপারটা একটু অন্যরকমও হতে পারতো। রহিমকে যদি বেশি সময় দেয়া হতো, উৎসাহ-সাহস দেয়া যেতো; সেও তাহলে হয়তো ভালো করতো। শুধুমাত্র কোচের করিমকে ভালোর চোখে দেখাটাই ওকে অনেকদূর নিয়ে গিয়েছে।

এইযে একজনের চোখে অন্যজনকে ভালোভাবে দেখা, তার ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু কল্পনা করা-এটা অন্য ব্যাক্তিটির জীবনে পজিটিভ প্রভাব ফেলে, ব্যাক্তি কাজ করার উৎসাহ পায় এবং পরবর্তীতে এগিয়ে যায়। একে বলা হয় প্যগ্মালিওন ইফেক্ট অথবা রোসেন্থাল ইফেক্ট। এই বিষয়ে বলা হয়ে থাকে-যত বেশি এক্সপেক্টেশন, তত বেশি পারফর্ম্যান্স। তার মানে হলো, আপনার চোখে অন্য একজনকে ভালো হিসেবে দেখলে, ভালো কথা বললে, তাকে উৎসাহিত করলে সেটা সেই মানুষটার কাজেও ভালো প্রভাব ফেলে, আবার সেই মানুষটার আপনার প্রতিও ভালো ব্যাবহার প্রকাশ পায়, একটা চেইন/সাইকেল এর মতো।

পিগম্যালিয়ন টার্মটা এসেছে গ্রীক মিথোলজি থেকে। একজন মূর্তি খোদাইকারক ছিলেন, যার নাম পিগম্যালিয়ন। তিনি একটা নারী মূর্তি তৈরি করার পর তাঁর কাছে মূর্তিটাকে এতই ভালো লাগে যে, নিজের বানানো মূর্তিরই প্রেমে পড়ে যান! লোকটা তাঁদের গ্রীক দেবী ভেনাস (প্রেমের দেবী) এর কাছে প্রার্থনা করেন, যাতে মূর্তির দেহে প্রাণ আসে। তাঁর ভালোবাসা ও চাওয়া এতই প্রকট ছিলো যে, দেবী ভেনাস মূর্তিকে পরবর্তীতে নারীতে রূপ দেন। সেখান থেকেই এসেছে পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট নামটি।

1963 সালে হার্ভার্ড সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোসেন্থাল তার ল্যাবরেটরিতে একটা মজাদার পরীক্ষা করেন। অনেকগুলো সাধারণ মানের ইঁদুর তিনি দুইটা গ্রুপের তার কিছু ছাত্রদের মাঝে ভাগ করে দেন। এক গ্রুপকে বলেন, তোমাদের ইঁদুরগুলো বুদ্ধিমান, এদেরকে আরো ট্রেনিং করাও, এরা ভালো করবে।

অপর টিমকে বলেন, তোমাদের ইঁদুরগুলো নেহাতই গাধা, দেখো এদের কিছু শেখাতে পারো কিনা। তার কথাটা কিন্তু মিথ্যে ছিলো! কারণ দুটো গ্রুপেই একইমানের ইঁদুর ছিল। কিছুদিন পর দেখা গেলো, বুদ্ধিমান বলা টিমের ইঁদুরগুলো আসলেই গাধা বলা ইঁদুর থেকে ভালো পারফরম্যান্স করেছে।পজিটিভ কথা ও চিন্তাভাবনা এমনকি ইঁদুরের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে।

রোসেন্থাল ক্ষান্ত হলেন না ইঁদুরের উপর এক্সপেরিমেন্ট করেই! তিনি এবার মানুষের উপর তার তত্ত্বকে খাটানোর জন্য একটা স্কুলে গেলেন। তিনি শিক্ষকদের বললেন যে স্টুডেন্টদের একটা আইকিউ টেস্ট নিতে চান। শিক্ষকরা বললেন তাকে যে তাদের ক্লাসের কিছু স্টুডেন্ট খুবই ভালো, বাকিরা এভারেজ মানের।

আইকিউ টেস্ট নিয়ে অবশেষে দেখা গেলো, আসলেই যাদের উপর টিচাররা ভরসা করেছিলেন, তাদের রেজাল্ট অন্যদের থেকে ভালো হয়েছে। তিনি একই পরীক্ষা ছয়মাস পর আবার করেন স্কুলে, তখনো দেখেন যে যাদের কথা আগে বলা হয়েছিলো তারাই বেশি ভালো করেছে। এই এক্সপেরিমেন্ট থেকে বোঝা গিয়েছিলো যে, শিক্ষকদের আচরণ ও চিন্তাভাবনা, ছাত্র-ছাত্রীকে উৎসাহ দেয়া-এগুলো একটা স্টুডেন্টকে ভালো রেজাল্ট পেতে খুবই সাহায্য করে।

মনে আছে টিমের অন্য সদস্য রহিমের কথা বলেছিলাম শুরুতে। তার প্রতি খারাপ ব্যাবহার তাকে আরো নিরুৎসাহিত করেছে, নিজেকে অযোগ্য ভাবছে সে, কোন কাজেই ভালো লাগা কাজ করছেনা। একে আমরা বলি গোলেম ইফেক্ট। একজন মানুষের নেগেটিভ চিন্তা যখন অন্য মানুষের প্রতি থাকলে সেই মানুষটিও কাজে উৎসাহ হারাবে, তার পারফর্ম্যান্স কমে যাবে, কাজের মনোযোগে ঘাটতি দেখা দেবে।

আমাদের জীবনে দুটো ইফেক্টই সমভাবে থাকবে।আপনাকে আশেপাশের সবাই পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট দেখাবেনা, কেউ কেউ গোলেম ইফেক্ট ও দেখাবে। এর জন্য,সবথেকে ভালো পন্থা হলো- নিজেকে পিগম্যালিয়ন করুন। আপনি নিজেই নিজেকে উৎসাহ দেবার জন্য,পজিটিভ ফিল করানোর জন্য যথেষ্ট। একটা লক্ষ্য থাকা, কাজ করার প্রেরণা ও ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার মাধ্যমেই সম্ভব পজিটিভিটি গড়ে তোলা। নিজেকে পজিটিভ, সুচিন্তিত এবং কর্মঠ মানুষ দিয়ে ঘিরে রাখলেও পিগম্যালিয়ন ইফেক্টকে দারুণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।

Tahsin Labiba Tanha

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ময়মনসিংহে প্রথম সন্তান জন্মের ৩৯ দিন পর দ্বিতীয় জমজ সন্তানের জন্ম

Sun Jun 28 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন, ২০২০, রবিবার বাংলাদেশে এই প্রথম জমজ সন্তানের দুইজনের জন্মের সময়ের ব্যবধান ৩৯ দিন। বিস্ময়কর এই জমজ সন্তানের জন্ম হয় ডা. শিলা সেনের অধীনে। সাধারণত জমজ শিশুদের জন্মের ব্যবধান স্বাভাবিক ডেলিভারিতে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। বলা হয়, ১৫ মিনিটের মধ্যে হলে ভালো, না হলে ২য় শিশুর ক্ষতি […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo