টিকা সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য প্রচার রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন উদ্যোগ

রোগ প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধই উত্তম। তাই বিশ্বব্যাপী রোগ প্রতিরোধের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট একটি টিকা একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। রোগ প্রতিষেধক টিকা গত ১০০ বছরে অসংখ্য মানুষের জীবনরক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। রোগ প্রতিষেধক টিকা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। আজ থেকে মাত্র ৫০ বছর আগেও হাম, রুবেলা, মাম্পস রোগে আক্রান্ত হয়ে ২ মিলিয়নেরও বেশি শিশু মারা যেত। কিন্তু ১৯৭১ সালে হামের টিকা আবিস্কার ও এর বহুল ব্যবহার প্রচলিত হওয়ার পর এই মৃত্যুর হার প্রায় ৮০ শতাংশ হ্রাস পায়।

টিকা আবিষ্কারের সময় থেকেই এই নতুন পথ নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গা জুড়ে টিকা-বিরোধী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তারা বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিতেন, যেমন রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা দেয়া। ব্রিটিশ টিকা-বিরোধী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম টেব যুক্তরাষ্ট্র সফর করার পর সেখানেও এই ধরনের সংগঠন গড়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক কালে টিকা-বিরোধী ব্যক্তিত্বদের মাঝে গবেষকরাও আছেন। অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড নামে এক গবেষক ১৯৯৮ সালে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে দাবি করেন এমএমআর (হাম, রুবেলা, মাম্পস) ভ্যাকসিনের সাথে অটিজম এবং পেটের অসুখের সম্পর্ক রয়েছে। যেটিতে তিনি এক ভুল তথ্য উপস্থাপন করেন যাতে তিনি দাবি করেন । পরবর্তীতে তার ঐ গবেষণা ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হয় এবং তার মেডিকেল ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়।

ক্ষতি আগেই হয়ে যায়; তার ঐ দাবির পর টিকা নেয়া শিশুর সংখ্যা কমে আসে। শুধুমাত্র ব্রিটেনেই ২০০৪ সালে এক লক্ষ শিশু কম টিকা নেয়। এর ফলে সে দেশে হামের প্রকোপ বেড়ে যায়।

বিগত কয়েক বছরে কিছু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিরোধী চক্র সামাজিক মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষেধক এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন ভুল তথ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে চলেছে। যার ফলাফল স্বরুপ আমেরিকার ৩১ টি প্রদেশে এই বছর এ পর্যন্ত ১২৩৪জন হামের রোগী সনাক্ত করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিনগুণ এবং ১৯৯২ সালের পর সবচেয়ে বেশি। শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি ইউরোপের যে দেশগুলো কিছুদিন আগেও হামমুক্ত ছিল তাদের কয়েকটি দেশেও হাম আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।

নতুন করে রোগের প্রাদুর্ভাব প্রমাণ করে এই অঞ্চলে হাম রোগের টিকা নেওয়া শিশুর সংখ্যা কম ছিল। টিকার ব্যাপারে মানুষের মনোভাব জানার জন্য বিশ্বে এযা বতকালের সবচেয়ে বড় জরিপে দেখা যাচ্ছে অনেক অঞ্চলে টিকা সম্পর্কে মানুষের আস্থা একেবারেই কম। বিশ্বের ১৪০টি দেশের এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষের ওপর জরিপটি চালায় যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলকাম ট্রাস্ট। এই গবেষনায় দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় ৯৮% মানুষ টিকা দেওয়াতে বিশ্বাস করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে দশটি বিষয়কে বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বর্ণনা করছে, তার একটি হচ্ছে টিকা দেয়ার ব্যাপারে মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।

এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরী ও ভুল তথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে সামাজিক মাধ্যম “ফেসবুক” এর সাথে নতুন পার্টনারশীপ এ আবদ্ধ হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম তাদের ব্যবহারকারীদের ভ্যাক্সিন বিষয়ক যে কোন জিজ্ঞাসায় সরাসরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত তথ্য সরবারহ করবে বা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ভ্যাক্সিন বিষয়ক এমন রিসার্চগুলোর লিঙ্ক দেখাবে। এতে করে ব্যবহারকারীগণ সঠিক তথ্যগুলো জানতে পারবে। ফেসবুকের পরবর্তী আপডেট থেকে এই সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে। এছাড়াও অন্যান্য কিছু সামাজিক মাধ্যম এই বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউটিউব ইতিমধ্যেই ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমের বিরোধীতা করে এমন বিজ্ঞাপন ও ভিডিও সরিয়ে ফেলেছে। আমাজন ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমের বিরোধীতা করে তৈরি ডকুমেন্টারিগুলো ডিলিট করে ফেলেছে ।

সঠিক সময়ে টিকা পাওয়া শিশুর জন্মগত অধিকার। তাই বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৯ সাল থেকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে ৭টি মারাত্মক রোগ হতে রক্ষা করার জন্য ১ বছরের কম বয়সী সকল শিশুদের টিকা দিয়ে আসছে। এছাড়াও নবজাতককে ধনুষ্টংকারের হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৫-৪৯ বছর বয়সী সকল মহিলাকে সময়সূচি অনুযায়ী ৫ ডোজ টিটি টিকা দেয়া হচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে এমআর টিকা অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়াও ২০১৩ সাল থেকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে উল্লিখিত ৯টি সংক্রামক রোগের পাশাপাশি নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন সংযোজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজই আপনার শিশুকে টিকা দিন। শিশু জন্মের ১৫-১৮ মাসের মধ্যে হাম ও রুবেলার দুই ডোজ টিকা নিশ্চিত করুন। আসুন সবাই মিলে হাম রোগমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

তথ্যসূত্র: https://www.cnbc.com

প্ল্যাটফর্ম ফিচার:
মোস্তাফিজুর রহমান
খুলনা মেডিকেল কলেজ

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত

Thu Sep 12 , 2019
গত ১১ তারিখ,২০১৯, সোমবার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে “Entrepreneurship for Sustainable Economic Growth” শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো কর্মশালা। উক্ত কর্মশালাটি আয়োজিত হয় প্ল্যাটফর্ম অফ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটি, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ফর পিচ, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেন্টার এবং ইকোনমিক্স ক্লাবের যৌথ উদ্যোগে। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাপান, হংকং, ইউকে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo