চার দফা দাবির গ্রহণযোগ্যতা, প্রয়োজনীয়তা এবং প্রশ্ন

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৭ নভেম্বর ২০২০, শনিবার 

প্ল্যাটফর্ম ডিবেট টিম আয়োজিত ‘যুক্তিকথন’ অনুষ্ঠানের এবারের আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল বর্তমান সময়ের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বহুল আলোচিত বিষয় “মেডিকেল শিক্ষার্থীদের চার দফা- গ্রহণযোগ্যতা, প্রয়োজনীয়তা এবং প্রশ্ন”।

মায়মুনা মুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সুরাইয়া বীথি, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মোঃ রাফসান, নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মোঃ আসিফ হাসান, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মোঃ সাইদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে প্রথমেই চারদফা দাবি নিয়ে আলোচনা শুরু করা হয়। দাবি গুলো হলঃ

১. করোনাকালীন সময়ে ঝুঁকি নিয়ে সেকেন্ড ওয়েভ এর মহামারীর মধ্যে প্রফ নয়।

২. সেশনজট নিরসন করে যথা সময়ে কোর্স সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

৩. প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোয় করোনায় কার্যক্রম বন্ধ থাকাকালীন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৬০ মাসের অতিরিক্ত বেতন নেওয়া যাবে না।

৪. করোনাকালীন শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিতে রাজী নয়, বন্ড সই দিয়ে কোনো পরীক্ষা নয় এবং কোনো শিক্ষার্থী প্রফ দিতে এসে করোনায় আক্রান্ত হলে এর দায়ভার কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।

প্রথম দাবি অনুযায়ী করোনার ২য় ওয়েভে প্রফ নয় তাহলে তারা কখন প্রফ চাচ্ছেন প্রশ্ন করা হলে উত্তরে বলা হয়, “২য় ওয়েভে প্রফ দিতে চাচ্ছি না মানে এই নয় যে আমরা পরীক্ষা দিতে চাচ্ছি না।অনেকে ভাবতে পারেন যে পরিক্ষাভীতির জন্য দিতে চাচ্ছি না বা অটোপাশ চাচ্ছি ধারণাটি সঠিক নয়। আমরা চাচ্ছি যে করেনার এই প্রকোপটা কমলে তখন দেয়া যেতে পারে।”

বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

দ্বিতীয় দাবী ছিল সেশনজট নিরসন করে যথা সময়ে কোর্স সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।সেশনজট দূরীকরণে অনেকেই অনলাইন ক্লাস নেয়ার কথা বলছে, এর ব্যখ্যায় শিক্ষার্থীরা যুক্তি দেন,আমাদের দীর্ঘ শিক্ষাব্যবস্থা ইন্টার্নি সহ ৬ বছর। আমাদের এই প্রফ মে তে হওয়ার কথা ছিল, অলরেডি ৬ মাস লস। ডিসেম্বরে হলে তখন ৮ মাস হবে। এই যে সাড়ে ছয় মাসের মতো সময় লস হচ্ছে সাথে কারো যদি করোনা হয় তখন তার আরো ছয় মাস লস তাই সেশনজট যাতে না হয় সে জন্য পরবর্তী ফেজের ক্লাস শুরু হোক সেটা চাচ্ছি।”

তৃতীয় দফাতে বলা ৬০ মাসের বেশি বেতন নয় বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলে, অতিথির মধ্যে থেকে একজন জানান,এমবিবিএস ও বিডিএস ৬০ মাস ও পুরাতন কারিকুলাম অনুযায়ী বিডিএস ৪৮ মাসের বেতন দেয়ার কথা প্রজ্ঞাপনে থাকলেও অনেক বেসরকারী মেডিকেল কলেজ মার্চ থেকেই বেতন নেয়ার জন্য নোটিশ দিচ্ছে। করেনাকালীন অনেকের জন্য এটা হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা। ক্লাস না হলেও বেতন দিতে হচ্ছে। আমরা যদি করোনার এই আট মাস বেতন দিই ৬০ মাসের কারিকুলাম অনুযায়ী আমরা কিন্তু ৬০ মাসে মেডিকেল এখন আর শেষ করতে পারবো না কেননা ইতোমধ্যেই আমরা ৬-৮ মাস পিছিয়ে পড়েছি তাহলে বাড়তি বেতনগুলো নেয়া প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নীতিবিরোধী। আর আমাদের দাবিটা সেখানেই।”

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে প্রশ্ন করা হয়, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরীক্ষা ও ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি কিভাবে কার্যকর করা যেতে পারে?
উপস্থিত অতিথির মধ্য থেকে উত্তর আসে, “এটা অনলাইনে ছোট ভাইভার মাধ্যমে নেয়া যেতে পারে। অন্যান্য দেশে সব কিছুই অনলাইন ভিত্তিক হচ্ছে।”

স্লোগানরত অবস্থায় শিক্ষার্থীরা

আন্দোলনের শুরুটা কীভাবে প্রশ্ন করলে, সুরাইয়া বিথী বলেন, “আসলে এই আন্দোলন বা এমন কিছু করার কোনো পরিকল্পনাই আমাদের ছিল না। যখন মার্চে করোনা ভাইরাস আসে, সারা বাংলাদেশ লকডাউনে চলে যায়। দেখতে দেখতে যখন আমরা ৮ মাসে পা দেই তখনই কিন্তু আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। এভাবে আর কতদিন! বাংলাদেশে যেহেতু অনেক জায়গায় অনেক কিছু খুলে দেয়া হচ্ছে, অনলাইনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কেন মেডিকেলের শিক্ষা ব্যবস্থা পিছিয়ে থাকবে? যেহেতু আমরা সবাই জানি মেডিকেল প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া অন্যান্য সেক্টরের তুলনায়। যদি একজন রেগুলার মেডিকেল শিক্ষার্থী রেগুলার শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী পড়ে যায় তারপরও কিন্তু তার কোর্স শেষ করতে সাড়ে ৬ বছরের মত সময় লাগে। ইতিমধ্যেই আমাদের ৮ মাস পেরিয়ে গেছে এবং জানি না এরকম অবস্থায় আমাদের আরও কতদিন থাকতে হবে। এইজন্যই আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম যে আর কতদিন! আমাদের একটা সলিউশন দরকার। আর সেই চিন্তা ভাবনা থেকেই আমরা সারা বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীরা, এমবিবিএস এবং ডেন্টাল শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়েছি। আমরা ৪ দফা দাবি দিয়ে স্মারকলিপি ও এগুলোর ব্যাখাও দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ডীন স্যার ,স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আর বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন এই ৪ টা জায়গায় আমাদের স্মারকলিপি গুলো জমা দেই এবং স্যারদের সাথে কথা বলে আমরা বুঝানোর চেষ্টা করি যে আমাদের দাবি গুলো কি এবং কেন? আর কেনই বা আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছি। বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টর গুলোও কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সব জায়গায় ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে। সারা বাংলাদেশে এত সুন্দর ভাবে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেয়ার জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। ”

দাবিগুলো নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন ভুল তথ্য প্রচার করা হচ্ছে এ বিষয়ে সাইদুল ইসলাম বলেন, “মিডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বলা হচ্ছে আমরা অটো পাশ চাচ্ছি। পরীক্ষা ভীতি বা পরীক্ষা না দিয়ে ডাক্তার হতে চাচ্ছি। প্রথমেই বলব আমরা যারা আন্দোলন করছি তারা ১ম, ২য় ও ৩য় পেশাগত পরীক্ষার্থী আর আমরা বেসিক বিষয়গুলো পড়ছি সেটা ৪র্থ পেশাগত পরীক্ষার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। ৪র্থ বা ফাইনাল বর্ষেই মূলত পুরোপুরি প্রস্তুতি নেওয়া হয় চিকিৎসক হওয়ার। সুতরাং সেখানে কোন ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। আমরা কোন অটো পাশ চাচ্ছি না। আমরা আমাদের প্রফটাকে নিরাপদ করতে চাচ্ছি। পরীক্ষা দিতে গিয়ে যদি কেউ আক্রান্ত হয় বা মারা যায় তার দায়ভার কে নিবে! আমরা এরই মধ্যে ৮ মাস পিছিয়ে গিয়েছি। প্রফ দিতে গিয়ে আক্রান্ত হলে আরও ৬ মাস পিছিয়ে যেতে হবে। প্রায় দেড় বছরের জন্য পিছিয়ে যেতে হবে।”

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা

এতদিনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পর সিনিয়রদের থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন জানতে চাইলে আসিফ হাসান বলেন, এই মাসের শুরু থেকেই আমরা আন্দোলন শুরু করি। এরই মধ্যে আমরা বিএমএ, বিএমডিসি, ডিন অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি আর তার জন্য অনেক সিনিয়ররাই আমাদের অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে এবং তাদের সহযোগিতাতেই আমরা আমাদের দাবিগুলো সর্বাধিক জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি।

আপনাদের আন্দোলনের অগ্রগতি কেমন?
এ বিষয়ে মোঃ রাফসান বলেন, “আমারা ডীন স্যারের নিকট স্মারকলিপি দিয়েছি। প্রথমে কিছু মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল, তারা ভেবেছিল আমাদের দাবিটা অটোপ্রমোশন নিয়ে। কিন্তু আমাদের দাবি অটোপ্রমোশন নিয়ে না। তারপর আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমরা যৌক্তিক কারণে এই দাবিগুলো করি। যেহেতু আপনারা আমাদের গার্ডিয়ান সেহেতু আমাদের এই বিষয় গুলা কন্সিডারেসনে নেন। উনারা বলেছেন হ্যাঁ তোমাদের দাবি অবশ্যই যৌক্তিক। কিন্তু এই বিষয়ে একা ডিসিশন নিতে পারবো না। ডিফরেন্ট স্টেকহোল্ডার আছে, বিএমডিসি আছে, ডিজি হেলথ আছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় আছে, কর্তৃপক্ষ আছে। উনারা সবাই মিলে ৮ তারিখে একটি জুম মিটিং করবেন। এখন হয়ত জুম মিটিং এর উপর ভিত্তি করে একটা ফাইনাল ডিসিশন হবে।”

যদি এই ডিসেম্বরে প্রফ না হয়, পরবর্তীতে যখন মার্চ বা এপ্রিল এ নেওয়া হবে এক্ষেত্রে সেশন জট কিভাবে পূরণ হবে? সেশন জট কি থেকেই যাচ্ছে না?
প্রশ্নের উত্তরে আসিফ হাসান বলেন, “এখন যে দুর্যোগ চলছে সেটা বিশ্বব্যাপী। আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এখন ক্ষতিটা যেন আমাদের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি না হয় এজন্যই এ দ্বিতীয় দাবিটি রাখা। এক্ষেত্রে সবারই এ ৩-৪ মাস একটু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। সব দিক থেকেই আমাদের দাবীটি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।”

শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন কর্মসূচি

অনেকে বলেছে করোনার ভয় পাচ্ছো তাহলে মেডিকেলে পড়তে এসেছো কেন? বিষয়টি আলোকপাত করে মোঃ রাফসান বলেন, “হ্যাঁ, আমরা মেডিকেলে পড়তে এসেছি মানুষকে সেবা করার জন্য। কিন্তু এই মেডিকেলে পড়া অবস্থায় যদি আমাদের জীবন চলে যায় তাহলে আমরা মানুষের সেবা করব কিভাবে? আশা করছি, ডিসিশনটা আমাদের পক্ষেই হবে। ভার্সিটির ক্লাস গুলো যদি লাইভ নেয়া হয় তাহলে সেইটা লো রিস্ক। কিন্তু সেখানে যদি আমাদের ক্লাস টা লাইভ নেয়া হয় তাহলে কিন্তু আমাদের বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সেখানে বিভিন্ন করোনা আক্রান্ত রোগীরা উপস্থিত থাকে যা আমাদের জন্য খুব বেশি রিস্ক বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের তুলনায়। ডাক্তাররাও ফ্রন্ট লাইনে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের স্যালুট জানাই তারা আমাদের জন্য অনেক কিছু করছেন। তারা প্রোপার প্রোটেকশন উইজ করছেন। কিন্তু আমরা যখন যাব ক্লাসে, কলেজে, হল এ- আমাদের প্রোপার প্রোটেকশন থাকবে না। আমাদের মেডিকেলের স্ট্রাকচার গুলোতে স্যোশাল ডিসটেন্স মেনে ক্লাস সম্ভব না। আমরা স্যারদের সাথে কথা বলেছি এবং তারা সত্যিই পজিটিভ এবং বলেছেন আমাদের জন্য যা প্রয়োজনীয় তাই ডিসিশন নিবেন। তারা ৮ তারিখে সেই ডিসিশনই নিবেন যা আমাদের জন্য ভালো হবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে বিভিন্নভাবে তাদের দাবিগুলোর যুক্তিদিয়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলেন। সর্বশেষে, তারা আশা রাখছেন ৮ তারিখ তাদের পক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট নোটিশ আসবে।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য কথন

Sat Nov 7 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৭ নভেম্বর, শনিবার, ২০২০ একজন ডায়াবেটিস রোগীর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের অন্যতম চাবিকাঠি হলো নিয়মানুবর্তিতা। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে তার প্রতিদিনের খাবার, ঔষুধ ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। এই সতর্কতাই তাকে অন্য অনেকের চেয়ে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তবে নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo