“কুর্মিটোলায় আমার আব্বা ভালো আছেন”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, রবিবার, ৩১ মে, ২০২০

 

[কোভিড-১৯ আক্রান্ত পিতাকে নিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আছেন আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ডা. করিমুল ইসলাম। জানিয়েছেন সেখানের অভিজ্ঞতা।]

 

আমার আব্বা গত ৬দিন ধরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সাথে এটেন্ডেন্ট হিসেবে আমি আছি। আলহামদুলিল্লাহ আব্বা অনেক ভালো আছেন আগের চেয়ে। এই পোস্টটা আরো পরে লেখার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হলো এখনই লেখা দরকার।

 

গত ছয়দিনে, প্রতিদিন কনসালটেন্ট আর মেডিকেল অফিসার স্যাররা তিনবার হাসপাতালে রাউন্ড দিতে এসেছেন। মুবিন স্যার, দীপংকর স্যার, এনাম স্যার, মোস্তাফিল স্যারদের ডিউটি চলে এখন। উনারা প্রতিদিন যতটুকু সম্ভব সময় নিয়ে সব রোগী দেখছেন। নির্দিষ্ট সময় পর পর নার্সরা এসে সব ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। রাতে আলাদা করে সব রোগীকে জিজ্ঞাসা করছেন কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা।

সময় মতো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ৩/৪ ঘন্টা পর সুইপার এসে জীবানুনাশক মিশ্রিত পানি দিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করে যাচ্ছেন। দুই দিন পর পর দুইজন সাইকিয়াট্রির স্যার এসে কাউন্সেলিং করে যাচ্ছেন, মানসিক শক্তি ধরে রাখার জন্য।

 

ছোটখাটো কিছু যে অব্যবস্থাপনা যে হচ্ছে না, এমন না। কিন্তু সেটা কোথায় নাই বলেন? তার মধ্যে এত এত পেশেন্ট লোডের মধ্যে PPE পরে সবাই কাজ করছেন। এখানে যারা কাজ করছেন নিজেদের ১০০% দিয়েই করছেন রোগীদের জন্যে। অনেকেই ইতোমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দিচ্ছেন।

 

গত কয়েকদিনে বেশ কিছু পোস্ট দেখেছি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো নিয়ে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সমস্যা যতটা না সেই ডাক্তার বা নার্সের, তার চেয়ে বেশি রোগী এবং তার সাথের মানুষজনের আনরিয়েলিস্টিক এক্সপেক্টশনের জন্য। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে একটা এক্সেপশনাল সময়ের মধ্যে যাচ্ছি আমরা। পান থেকে চুন খসলেই অস্থির হওয়া যাবেনা। লক্ষ্য রাখতে হবে পানটা যেন ঠিক থাকে।

 

অনেকেই বলছেন ডাক্তারদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করতে বাট এখন এত অল্প সময়ে সেটার ব্যবস্থা করতে যে লজিস্টিক সাপোর্ট আর টাকা লাগবে, সেটা জোগাড় করা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর চেয়ে আমরা সব হাসপাতালেই ডাক্তারদেরকে এবং তার পরিবারদেরকে প্রায়োরিটি দিচ্ছি না কেন? কুর্মিটোলায় অনেক অনেক ভি.আই.পি রোগী আছেন। কিন্তু ডাক্তার কিংবা তার পরিবারের কারো প্রতি সবারই একটা বিশেষ নজর থাকে। সব হাসপাতালেই এটা হচ্ছে না কেন?

 

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, রোগীর সাথে যিনি থাকবেন তাকে একটু মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বুঝতে হবে কোনটা জরুরি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় অক্সিজেন সিলিন্ডার চেঞ্জ করা নিয়ে। রোগীর লোকের মনে হতে থাকে আমার রোগী বুঝি মরে গেল অক্সিজেন আনতে আনতে৷ ওয়ার্ডবয়রাও সারাক্ষণ ব্যাস্ত, সিলিন্ডার রেডি করতে করতে৷ এইজন্য মিটার কিভাবে পড়তে হয় সেটা শিখে নিতে হবে।

 

সবার এত ব্যাস্ততা দেখে কাউকে বিরক্ত না করে নিজেই সিলিন্ডার খোলা লাগানো শিখে নিয়েছি। গতকাল অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে গেছি। ওয়ার্ডবয় নেই, নিজেই লাগাতে যাচ্ছি – এনাম স্যার এসে নিজের হাতে সেট করে দিলেন সেটা৷ নাসির স্যার, মুবিন স্যার, মারুফ স্যার, মাসুম স্যার সারাক্ষণ খোঁজ রাখছেন আব্বার অবস্থা নিয়ে৷ আব্বার জন্য ডাক্তার কমিউনিটি থেকে যত সহযোগীতা পেয়েছি এই ঋণ পরিশোধ করা যাবেনা।

 

CMH থেকে রাজ্জাক স্যার, রেজা স্যার, সাদিয়া ম্যাডাম প্রতিদিন কল দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন আব্বার৷ We the dreamers এর ইলিয়াস ভাই, ক্যাম্পাসের বড় ভাইদের সাথে অনেক অনেকবার কনসাল্ট করেছি ছোটখাটো ডিটেইল্স নিয়ে আব্বার ট্রিটমেন্টের। আমার ব্যাচমেট মোবারক ভাই, তানভীর, মুক্তি, ফার্সিম, মিথিলা এত কিছু করেছে আমার আর আব্বার জন্য গত কয়েকদিনে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে খালি একটা দোয়াই করছি, যতটুকু পেয়েছি তার চেয়ে বেশি যেন জুনিয়রদের জন্য করতে পারি।

 

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ টার্ম আমাদের সবার জানা উচিত – ‘Intellectualization’। রোগী মারা যাওয়ার পর আমাদের মাথায় এনালাইসিস আসতে থাকে এইটা ভুল ছিল ওইটা ভুল ছিল। এই ওষুধ না দিলে বোধ হয় রোগী বেঁচে যেত, ওই ওষুধ দিলে হয়তো সুস্থ হয়ে যেত। আমরা তখন ব্লেম গেইম খেলতে থাকি। ডাক্তারদের মধ্যেই এই ট্রেইটটা বেশি। আপনারা সবাই ধৈর্য্য ধরুন। এই বিপদের সময়ে যারা জান-প্রান দিয়ে কাজ করছে এসব লেখালেখি করে তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েন না আল্লাহর ওয়াস্তে। খারাপ কিছু হওয়ার আগেই প্ল্যান করুন, সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ করে রাখুন ইন কেইস খারাপ কিছু হলে কোথায় কি করবেন। আমাদের এই ভাঙা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটাই ভালো জিনিস হচ্ছে, অনেক অসাধারণ সব ডাক্তাররা আছেন, বিপদে যাদের সবসময় পাশে পাবেন। শুধু সঠিক সময়ে যোগাযোগ করতে হবে আপনাকে।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে শুরু হলো করোনা টেস্ট কার্যক্রম

Sun May 31 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ,৩১ মে ২০২০, রবিবার: উত্তরবঙ্গে প্রথম বেসরকারি পিসিআর ল্যাব  হিসেবে কার্যক্রম শুরু হলো বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রাফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে। করোনা টেস্ট সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিসিআর ল্যাবে কোভিড-১৯ টেস্টের অনুমতি দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এবার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে চালু হলো পিসিআর ল্যাব। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo