করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা ।। ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২০ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার 

ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম
সহযোগী অধ্যাপক, ইপিডেমিওলজি
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী
(এনসিডিসি), স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর

বিশ্বব্যাপী মোট ১৬৫ টি ভ্যাকসিন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং এর মধ্যে ৩১ টি ভ্যাকসিন মানব শরীরে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। মানুষের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে ভ্যাকসিন গুলোকে বিভিন্ন গবেষণা এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তবে আগামী বছরের মধ্যে বিজ্ঞানীরা একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।

সার্স-কোভ-২ জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু হয় এ বছরের জানুয়ারী মাসে। মানব শরীরে সফল ট্রায়াল শুরু হয়েছিল মার্চ মাসে, কিন্ত এই যাত্রা ছিল অনিশ্চিত। কিছু ভ্যাকসিন পরীক্ষা অকার্যকর হয়েছে এবং বাকিরা কোনো সন্তোষজনক ফলাফল না দিয়েই পরীক্ষা শেষ করেছে। তবে কিছু ভ্যাকসিন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে কার্যকর এন্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে।

ভাইরাল ইমিউনলোজি বিশেষজ্ঞ জানিয়া সামাটাকি বলেছেন,

“খুব দ্রুত কার্যকরি সার্স কোভ-২ ভ্যাকসিন হয়তো আবিষ্কৃত হয়ে যাবে।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর প্রধান বৈজ্ঞানিক সৌম্য স্বামিনাথান গত সপ্তাহে এক ব্রিফিং এ বলেন,

“আগামী বছরের শেষ নাগাদ প্রায় ২ বিলিয়ন কার্যকরী ভ্যাক্সিনের সরবরাহ থাকবে। তবে সেটা সারা পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশেরও কম মানুষের জন্য প্রযোজ্য। ভবিষ্যতে যে ভ্যাকসিন গুলো আসবে হয়ত তা দীর্ঘ্য মেয়াদী ইমিউনিটি দেবে না।”

ফসি একটি সাম্প্রতিক ইন্টারভিউতে বলেছেন,

“যদি এটা অন্যান্য করোনা ভাইরাসের মত হয় যেগুলো ঠাণ্ডা কাশি সৃষ্টি করে, তাহলে হয়ত আমাদের প্রতি বছর এর জন্য এই টিকা’র বুস্টার শট দিতে হতে পারে।”

ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পাশাপাশি কোনো ব্যক্তির মধ্যে সার্স-কোভ-২ এর এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, এই বিষয়টি খুঁজে বের করা মহামারি দমন করার জন্য জরুরি।

এযাবতকালে যে ক’টি ভ্যাক্সিন নিয়ে জোর আলোচনা চলছে সেগুলোর সাথে অল্প করে হলেও পরিচিত হওয়া দরকার।

মর্ডানা, যুক্তরাষ্ট্র
মর্ডানার ভ্যাকসিন ম্যাসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) এর উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা মানব শরীরে ভাইরাল প্রোটিন তৈরী করতে সক্ষম। কোনো সংক্রামক রোগের জন্য কখনো কোনো এমআরএনএ ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়নি এবং মর্ডানা কোন পণ্য বাজারেও আনেনি। তবে এই ভ্যাকসিনের সমর্থকেরা বলেছে যে, প্রচলিত ভ্যাকসিনের চেয়ে এই ভ্যাকসিন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা সহজ হবে। ন্যাশনাল হেলথ ইন্সটিটিউটের সাথে করা এক পরীক্ষায় দেখা গেছে এই ভ্যাকসিন বানরের শরীরে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরী করেছে। মার্চে কোম্পানিটি প্রথম মানব শরীরে এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করে যা আশার আলো দেখায়। দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষে তারা ২৭ শে জুলাই তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু করে। সর্বশেষ ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৯ টি বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের উপর করা হবে। ১১ ই আগস্ট সরকার ঘোষণা দেয় যে, ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হলে ১০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য দেড় বিলিয়ন ডলার অর্থ দিবে সরকার।

এস্ট্রোজেনেকা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাজ্য এই ভ্যাকসিনটি শিম্পাঞ্জির দেহে অবস্থিত এডেনো ভাইরাস (ChAdOx1) থেকে তৈরী করা হয়েছে। বানরের উপর একটি পরীক্ষায় এটি আশানুরূপ সাফল্য দেখিয়েছে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রোজেক্টে ১.২ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা প্রদান করে। তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ প্রমাণ করে যে তাদের ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং কোনো গুরুতর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মতো এটি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরী করে। এই ভ্যাকসিন টি বর্তমানে ইংল্যান্ড ও ভারতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় একত্রিত ধাপের পরীক্ষায় আছে এবং ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় আছে। এই বৃহৎ আকারের পরীক্ষাতে সফল হলে এস্ট্রোজেনেকা অক্টোবরের মধ্যে অতি দ্রুত ভ্যাকসিনটি বাজারে আনতে পারবে বলে জানিয়েছে। অনুমোদন পেলে কোম্পানি টি ২ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারবে।

সাইনোভ্যাক, চীন
চীনা বেসরকারী কোম্পানী সাইনোভ্যাক বায়োটেক করোনা ভ্যাক নামক একটি নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে। জুনে কোম্পানীটি ঘোষণা দেয় যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ৭৪৩ জন স্বেচ্ছাসেবকের ওপর ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা করা হয়, যেখানে গুরুতর কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এবং তাদের শরীরে এন্টিবডি পাওয়া গিয়েছে। তারপর সাইনোভ্যাক জুলাই মাসে ব্রাজিল এবং ইন্দোনেশিয়াতে তাদের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু করে। ব্রাজিলে এটি ৯ হাজার স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মাঝে পরীক্ষা করা হবে, কেননা এরাই করোনা আক্রান্ত মানুষের সবচেয়ে কাছে থাকে। ইন্দোনেশিয়াতে ১৬২০ জন মানুষের উপর এটি পরীক্ষা করা হবে।

স্পুটনিক ৫, রাশিয়া
আগস্টের ১ তারিখ রাশিয়া ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা সম্পন্ন করে। সকল স্বেচ্ছাসেবকেরা সুস্থ আছেন এবং তাদের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি মিলেছে। ১২ ই আগস্ট ২০০০ মানুষের উপর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়েছে যেখানে মধ্যপ্রাচ্য ( আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব) ল্যাটিন আমেরিকা (ব্রাজিল ম্যাক্সিকো)- এর স্বেচ্ছাসেবকও থাকবে। ১১ ই আগষ্ট রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সার্টিফিকেট পায় স্পুটনিক ৫। ধারণা করা হচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসেই বৃহৎ আকারে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করা যাবে।

দেশীয় ভ্যাকসিন কোন দৌড়ে নেই এখনো, তবে কান্নাকাটিতে ইতোমধ্যেই অনেকের মন কেড়েছে। বাংলাদেশে এই ভ্যাক্সিন ট্রায়াল এর শুরুতেই যেভাবে আলোচনা হয়েছে, পরবর্তীতে গ্লোব বায়োটেক এর ভ্যাক্সিন কোথায় কি অবস্থায় আছে তার খবর কেউ জানলে জানাবেন। শুনেছিলাম বোধহয় ডিসেম্বর নাগাদ এটা বাজারে আনবেন তারা। এবারে প্রশ্ন হলো এই ট্রায়ালে বাংলাদেশ অংশ নিবে কিনা? প্রথমদিকে যখন চায়না ভ্যাকসিন এর ট্রায়াল এর কথা বলা হলো, তখন অনেক বোদ্ধা রে রে রে করে উঠলেন। বলা হলো বাংলাদেশের জনগণকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। আবার যখন এই ভ্যাকসিন গুলোর ট্রায়াল পর্যবেক্ষণ ও যাচাই বাছাই এর জন্য বিলম্ব হচ্ছে সবাই হতাশায় বুক চাপড়াচ্ছে।

আসলে এই করোনা ভ্যাকসিন শুধু রোগ প্রতিরোধী উপাদান না, এটা বিশ্বরাজনীতির ও পররাষ্ট্রনীতির অংশ- এটা মাথায় রেখে পদক্ষেপ নিলে জনগণের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে। বুঝে শুনে দেখে ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আর অবশ্যই দেশের প্রচলিত ভ্যাকসিন এর প্রয়োগ ও গবেষণা সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা মেনেই তা করা বাঞ্ছনীয়। পরে যেন কপাল চাপড়ে গাইতে না হয়,

“যা চাই তা ভুল করে চাই,
যা পাই তা চাই না”

Md. Nafiul Islam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ডা. শুভাগত চৌধুরীর স্বাস্থ্যবার্তা: সু অভ্যাসে মিলায় সুখ

Thu Aug 20 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২০ আগস্ট, ২০২০, বৃহস্পতিবার মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস হচ্ছে নিয়মিত, অবিরত এবং ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কোন কাজ করা অথবা কোন কথা বলা। সু অভ্যাস বলতে বুঝায় ভালো অভ্যাস। এই ভালো অভ্যাস, ভালো কাজ, ভালো চিন্তা – মানুষের মনকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখে। এমন কিছু সু অভ্যাস গড়ে তুলতে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo