করোনা জয়ের অভিজ্ঞতা, হাসপাতাল থেকে ফিরে

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ এপ্রিল, ২০২০, মঙ্গলবার:

ফাইজ নাফিয়া রহমান

৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর দ্বিধায় পড়ে গেছিলাম কোথা থেকে ট্রিটমেন্ট নিব। আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) এর একজন ডাক্তার বলল আপনার যেহেতু তেমন কোন লক্ষণ নেই তাই আপনি বাড়িতে থেকেই ট্রিটমেন্ট নিতে পারেন। বাসায় বয়স্ক বাবা-মা আর ছোট ভাগ্নে থাকায় তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম হসপিটাল এর সার্ভিস যতই খারাপ হোক হসপিটালেই যাব। আইইডিসিআর এ আমার এ সিদ্ধান্তের কথা জানতেই ওরা আমাকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের নাম্বার দিল। কল দিলাম এম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য। রাত ১০.০০ টার দিকে এম্বুলেন্সে করে রওনা দিলাম হসপিটালের উদ্দেশ্যে। রাত ১১.৩০ টার দিকে পৌঁছলাম। আমাকে রুম এ পাঠানোর আগেই এক ডাক্তার আমার সব বিস্তারিত নিয়ে নিলেন।
হসপিটালে ছিলাম ১০ দিন। এই ১০ দিনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ফেসবুক খুললেই অনেক কিছু দেখা যায়- যেমন: ছেলে করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে, আবার করোনা আক্রান্ত বাবার লাশ নিতে অস্বীকৃতি। এই রকম নিউজে যখন ফেসবুকের নিউজফিড ভর্তি ঠিক তখনি এই হসপিটালে আমার চোখের সামনে পৃথিবী তার অন্য রূপ মেলে ধরলো। সেই পৃথিবী ভালোবাসার। একে অপরের পাশে থাকার। তাইতো কোভিড-১৯ পজিটিভ স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য, সাহস যোগানোর জন্য সুস্থ স্বামীও এ হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। অসুস্থ মা-বাবাকে সেবা করার জন্য নিজের লাইফ রিস্ক নিয়ে মেয়েও থেকে গেছে হসপিটালে। ২৪ ঘন্টা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত প্রিয়জনেদের সেবা করে যাচ্ছে তারা।

“হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়।” কিন্তু যারা বইতে পারে তাদের জন্যই আছে উত্তম প্রতিদান। আর সেই প্রতিদান আসে পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে। আর তাই আল্লাহর অশেষ রহমতে আর মেহেরবানীতে আমি চলে আসার দিন পর্যন্ত এই মহান হৃদয়ের অধিকারী মানুষদের কোভিড-১৯ নেগেটিভ ছিল। এতো নেতিবাচক খবরের ভীড়ে এই রকম ভালোবাসা, বিশ্বাস আর সাহসিকতার গল্পগুলো অল্প হলেও নতুন করে বাঁচতে, নতুন করে ভাবতে শেখায়।

আরো এক কেস দেখলাম, কোভিড-১৯ শুধু জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্টতেই থেমে নেই। এটা আসে বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে। আমি যখন আইইডিসিআর এ জানালাম আমার তো জ্বর কাশি শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই, যে গলা ব্যথা ছিল ঐটাও এন্টিবায়োটিক নেয়ার পর অনেকটাই কমে গেছে। গত ১৯ দিন আমি আর আমার পরিবারের কেউ ঘরের বাহিরে যাই নি। আমার কীভাবে পজিটিভ আসলো! আমার প্রশ্নের উত্তরটা ছিল এই রকম যে- দেশের প্রায় ৮০% লোকের পজিটিভ আসবে যদি টেস্ট করানো হয়, কিন্তু এদের কোন লক্ষণ নেই। ভাইরাসটা ওদের আক্রান্ত করে ঠিকই, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই রোগী ভালোও হয়ে যায়। হসপিটালেও তার নমুনা দেখলাম কয়েকটা। পুরান ঢাকার দুইটা ফ্যামিলির সাথে পরিচয় হয়েছে..

১। লোকটি হসপিটালে এডমিট হয় কোভিড-১৯ পজিটিভ সব লক্ষন নিয়ে। পরিবারের অন্যান্যদেরকেউ যখন টেস্ট করানো হলো তখন দেখা গেল উনার স্ত্রী ও এক ছেলের পজিটিভ কিন্তু বাকি দুই ছেলের নেগেটিভ। আর আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পজিটিভ স্ত্রী আর ছেলের কোন সিম্পটমস ছিল না, আর এখন পর্যন্ত নেই। ওরা চাইলেই ঘরে বসেই ট্রিটমেন্ট নিতে পারতো কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে এতোটাই নিম্নমানের যে বাসার বাড়িওয়ালা ওদের বাসা থেকে বের করে দেয়াতে হসপিটালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছে। যায় হোক লোকটি এখন পুরোপুরি সুস্থ। আশা করি ২-৩ দিনের মধ্যে পুরো ফ্যামিলি রিলিজ পেয়ে যাবে।

২। আমার দেখা পুরান ঢাকার ২ নাম্বার ফ্যামিলির কথা বলি। এই আঙ্কেল (বয়স আুমানিক ৬৫+) এর পজিটিভ ধরা পড়ে শুধুমাত্র ডায়রিয়া লক্ষণ নিয়ে। দুদিন পর উনার স্ত্রী ভর্তি হলো করোনার সব লক্ষণ নিয়ে। এর দুদিন পর উনাদের ছেলে ভর্তি হল শুধুমাত্র কাশি নিয়ে।যদিও একইসাথে ছিল তারপরও ছেলের বউ আর ওদের ছেলে-মেয়েদের নেগেটিভ ছিল। আমি আসার দিন দেখে আসছি আঙ্কেল অনেকটাই সুস্থ আর আন্টিরও জ্বর চলে গেছে, শুধু হালকা শ্বাসকষ্ট আছে। ওইটাও চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। হতেই পারে পরের সপ্তাহে হয়তো এই ফ্যামিলিও রিলিজ পেয়ে যাবে।

আরো একটা ঘটনা বলি যারা আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নিয়ে ভয়ে আছেন তাদের জন্য, এক ভাইয়া করোনা পজিটিভ নিয়ে ভর্তি হয় ৫ এপ্রিল। অবস্থা অনেক খারাপ থাকায় উনাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। উনার ভাষ্যমতে আইসিইউতে ২৪ ঘন্টা নার্স থাকে (এই ইনফরমেশন তাদের জন্য যারা ভাবেন নার্সরা শুধু ঘুমাইতেছে দেশের এই ক্রাইসিস মোমেন্টে)। যাই হোক উনি করোনার সাথে আইসিইউতে ৩ দিন ফাইট করে নরমাল ওয়ার্ডে চলে আসেন ৯ এপ্রিল। হয়তো গতকাল উনার রিলিজ হয়ে গেছে।

আমি হসপিটালের যে ফ্লোরে ছিলাম সেখানে বেশিরভাগের অবস্থাই অনেক স্ট্যাবল ছিল। এই ১০ দিনে আমি মৃত্যু দেখেছি দুইজনের। আল্লাহ যেন উনাদের সহ আরো যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সবাইকে কবরের আযাব মাফ করেন এবং বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি, আমিন।

এবার আসি ডাক্তারদের নিয়ে। এই ১০ দিনের এমন একটা দিনও ছিলো না যেদিন ডাক্তাররা ভিজিটে আসেন নি। প্রতিদিন দুইবার করে রাউন্ড দিয়ে গেছেন। রোগীদের সাহস দিয়ে গেছেন। রোগীদের কথা শুনেছেন, সেই হিসেবে প্রয়োজনীয় অ্যাডভাইস দিয়েছেন। যে রোগের কোনো মেডিসিন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নাই, সেখানে আর কতোটুকুইবা করবে ডাক্তাররা! আমাকে রিলিজ দেয়ার আগের দিন এক ডাক্তার আমাদের বলেছিল “আপনারা রিলিজ নিয়ে চলে যাবেন আর আমরা এখানে অ্যাডমিট হব!” কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের সব ডাক্তার-নার্সদের সবারই স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিল আইইডিসিআর। কারণ ওরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই বলতেছি ডাক্তার-নার্সদের সম্মান করতে না পারেন এটলিস্ট গালি দিয়েন না।

একবার শুধু ভেবে দেখুন বর্তমান আক্রান্তের সংখ্যা এখনো ২ হাজার (পোস্ট লিখার দিন পর্যন্ত) এর মধ্যে আছে, আর এখনি যদি সব ডাক্তার-নার্সরা অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে আমেরিকা, স্পেন, ইতালির মতো অবস্থা হলে কে আপনাকে ট্রিটমেন্ট দিবে? সৈনিক ছাড়া তো আর যুদ্ধ করা যায় না। আর এই করোনা যুদ্ধের আসল সৈনিক তো এরাই, ডাক্তার, নার্স!

সবশেষে এই হসপিটাল নিয়ে কিছু বলবো। এই ১০দিন ৩ বেলা নিয়মিত খাবার-ঔষধ পেয়েছি। আগেই বলে রাখি এটা সরকারি হসপিটাল, তাই আইসোলেশন রুমের কথা মাথাতেও আনবেন না। ভিটামিন-সি সাপ্লিমেন্টারী দরকার হলে বাইরে থেকে কিনে হসপিটালে ঢুকবেন। একদমই ভাবতে যাবেন না যে এইগুলো হসপিটাল প্রোভাইড করবে! হসপিটাল অনেক পরিস্কার, কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে অনেক নোংরা। তাই পরিস্কার মর্ম আমরা বুঝি না। এইখানে গিয়ে বুঝতে পারছি যে জাতি ফ্ল্যাশ করতে পারেনা, সেই জাতিকে আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টাইন বুঝাতে আরো ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। মাথায় রাখবেন সরকারি হাসপাতালে এক ওয়ার্ডে ৬ টা বেড এর জন্য একটা টয়লেট। তাই নিজের নোংরাগুলো নিজে পরিস্কার করে ফেললে তো কোনো দোষের কিছু নেই। অন্তত আমি দেখিনা। ক্লিনারের জন্য ফেলে রাখার কী দরকার রে ভাই! ওরাও তো মানুষ, ওদেরোতো জানের ভয় আছে নাকি!

যাদের আইইডিসিআর নিয়ে অনেক অভিযোগ,
আমি আইইডিসিআর থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি, আইইডিসিআরের সহযোগিতাতেই এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পেরেছি। পরের সপ্তাহে আমার আরেকটা টেস্ট করাবে আর ঐটা নেগেটিভ আসলেই বন্ধ রুম থেকেও মুক্তি পাব। সেই দিনের আশায় আছি।

উপরের সবকিছুই আমি এই ১০ দিনে যা দেখেছি যা বুঝেছি, যা অনুভব করেছি তার বহি:প্রকাশ মাত্র! সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত। সাবধানে থাকবেন। যেহেতু এই রোগের কোনো মেডিসিন নেই, তাই একমাত্র উপায় হলো নিজের ইমিয়্যুন সিস্টেম বুস্ট করা। করোনাকে ভয় না পেয়ে ইমিয়্যুন সিস্টেমকে কাজে লাগান। আর যদি এতটুকু সিম্পটমস আপনার মধ্যে দেখা দেয়, লুকোছাপা না করে দয়াকরে টেস্ট করান, ট্রিটমেন্ট নেন। আশা করি আল্লাহর দয়ায় ভালো হয়ে যাবেন। আজাইরা কারনে সিম্পটমস লুকিয়ে আশেপাশের মানুষদের আর ডাক্তারদের সংক্রমিত কইরেন না। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন আর আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখুন। নিজের ভালো থাকাটা যেমন জরুরী তেমনি আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখাটাও আমাদের নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। আর সবসময় পরম করুনাময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, দেখবেন উনি ঠিকই আমাদের আলোর পথ, আশার পথ দেখাবেন।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

আজ বিকাল ৪টা থেকে বগুড়া জেলা লকডাউন ঘোষণা

Tue Apr 21 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০ কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে আজ বিকাল ৪ টা থেকে বগুড়া জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ২১শে এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির একটি সভায় বগুড়া জেলার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহামদ এ ঘোষণা দেন। ২১ এপ্রিল বিকাল ৪ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo