করোনায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতা ও দায়

৭ এপ্রিল, ২০২০

-ডা. মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

আমার ইন্টার্নশীপ শুরু হয়েছিল ১৫ মে, ২০১২ সালে। স্থানঃ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। পরিচালকের রুম থেকে শপথ নেওয়ার পর আমাদেরকে যার যার পদায়নকৃত ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার শুরু হয়েছিল সার্জারী দিয়ে। সার্জারী ২৪। আমাদের সময় লোকে একনামে চিনত ঐ ওয়ার্ডটিকে। আলাদা একটা নাম ছিল। নাম ছিল রয়েল ওয়ার্ড। সেই স্মৃতি আমিও বলেছি, আজ অন্য একটা বিষয়ে লিখছি।

আমি ঠিক করেছিলাম আমি যতগুলো রোগীর ডেথ সার্টিফিকেট লিখব সেগুলোর হিসেব আমি রাখব। মে মাস পার হলো, জুনের শেষের দিকে চলে এসেছি। জুনের ৩০ আমার জন্মদিন। ঠিক সেদিন আমি প্রথম ডেথ সার্টিফিকেট লিখলাম। গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে গিয়ে এক মহিলা প্রায় ৬০ শতাংশ বার্ন নিয়ে এসেছিলেন। নাম মনে আছে আমার। নাম ছিল নাসিমা। সার্জারিতে তুলনামূলক রোগী কম মারা যেত।

এরপর মেডিসিন শুরু হলো। চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। মেডিসিন এডমিশনের প্রথম নাইট ডিউটিতেই প্রায় ১০০ প্লাস রোগী ভর্তি হলো। সারাদিনে সবমিলিয়ে ১৬৭। বলে রাখা ভালো দিন যখন শুরু হয় ওয়ার্ডে বেড ফাঁকা ছিল ৮টা। ৮ টা বেড সকাল ৯টাতেই পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

আমার মেডিসিনের প্রথম নাইটে আমাকে ৩ টা ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হলো।

প্রথমজন সিওপিডির রোগী। ভীষণ শ্বাসকষ্ট নিয়ে এসেছে। আমি নতুন ইন্টার্ন, মানুষের প্রতি আমার ভীষণ মায়া। আমি এদিক সেদিক ছুটছি, রোগীটাকে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য। ওদিকে পেছনে আরও চারজন রোগী এসে গেছে। আমি অক্সিজেন খুঁজে পাচ্ছি না। আমি কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। একটা ইসিজি করানো, ঐ মুহূর্তে সুগার দেখা সহ নানা বিষয়ের কিছুই করতে পারছিলাম না। কারণ সিস্টাররা ব্যস্ত, ওয়ার্ড বয়রা ব্যস্ত। আগেও যেসব রোগী এসেছে তাদেরকে মেডিসিন দিয়ে শেষ করতে পারেনি। ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা নেই।

আমি ঘামছি। আমি নিশ্চিত আর দু এক মিনিটের ভেতরে রোগীটা মারা যাবে, হলো তাই।

পরে জানতে পারলাম, একটা নির্দিষ্টসংখ্যক রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার পর আর কাউকে দেওয়া যায় না, লাইন না থাকার জন্য। সেই সংখ্যাটা ১০ এর বেশি না। ১৬৭ জন রোগী ভর্তি। সবার অক্সিজেন লাগে না, যাদের লাগে সংখ্যাটা ৪০-৫০ এর কম ছিল না। কিন্তু ১০ জনের বেশি দেওয়া যাবে না। আমি এরপর ঘুরে ঘুরে যাদের অক্সিজেন লাগানো আছে, তাদেরকে দেখে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলাম, এই মুহূর্তে কার বেশি প্রয়োজন নেই। সিনিয়র একজন ভাইয়া ছিল, এসব পাগলামি বাদ দে। ওদিকে দেখ, কী অবস্থা। আমি ইন্টার্ন বেশি কিছু বুঝি না, ভাইয়ারা বোঝালেন কীভাবে দ্রুত কাজ করতে হয়। আমি কাজ করতে পারছিলাম না।

ভেন্টিলেটর মেশিন বাদ দেন, আপনার আশেপাশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে তো?

আমি আপনাকে চমেকের ২০১২ সালের ঘটনা বলেছি। এখনো এরকমই থাকার কথা। কোনোদিন কেউ তো ভুলেও তাকাননি ওসব জায়গা কীভাবে চলে, কোনোদিন না,একদম কোনোদিন না, স্রেফ গালি দিয়ে চলে গেছেন, ভেবেছেন এভাবেই চলে যাবে? ভেবেছেন ৬০ শয্যার ওয়ার্ডে ১৭০ রোগী ভর্তি থাকলে, আপনার কী? ভেবেছেন, আপনি নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন? তাহলে আপনাকে করোনার দিনে স্বাগতম।

Fahmida Hoque Miti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কে পালিয়ে যাচ্ছে? পালানোর বুদ্ধিটিই বা কী?

Tue Apr 7 , 2020
০৭ এপ্রিল ২০২০: ডা. শুভদীপ চন্দ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বুঝলাম না- কোথায় কে পালিয়ে যাচ্ছে? এদেশে পালানোর বুদ্ধিটিই বা কী? গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে তেমন রোগী নেই। রোগীরা আসছেন কম। ট্রান্সপোর্টের অভাব বা করোনার ভয়- যে কারনেই হোক। একটি এলাকায় করোনা ঢুকলে সে হাসপাতালে থাকবেই- এরকম মানুষজন ভাবছে। তার উপর মাইকিং […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo