একজন তরুণ ডাক্তারের কান্না কেউ শোনে না; কেন?

৪ মে ২০২০, সোমবার

ইন্টার্নশিপ শেষ করার সাথে এমবিবিএস ডাক্তারটি যখন বেকার হয়ে যায়, কেউ তার অসহায়ত্ব বোঝে না৷ এমবিবিএস পাশ করেও বাসা থেকে টাকা নেয়ার বেদনা, শুধু একটা বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার চাকরির জন্যে পাগলের মতো এ দ্বারে ও দ্বারে ঘোরার সময়গুলোতে কে পাশে থাকে?

ক্লিনিকে “খ্যাপ” নামক ডিউটিতে যখন স্টোর রুমে ডাক্তারকে থাকতে দেয়, মালিকপক্ষের নানা দুর্ব্যবহার, অযাচিত অনৈতিক চাপে যখন মনে মনে আর কখনও খ্যাপ মারতে আসব না বলা ডাক্তারটি টানা ২৪ ঘণ্টা ডিউটি শেষে ২০০০ টাকা, ১ ঘণ্টায় ৮৩.৩৩ টাকা হাতে পায় তখন তার দীর্ঘশ্বাস কেউ শোনে না। দু-তিন মাসের টাকা যখন আটকে রাখে, হঠাৎ একদিন আমাদের আর ডাক্তার লাগবে না বলে দেয়, ডাক্তারটির শূন্য দৃষ্টি কার দৃষ্টিতে পড়েছে?

করোনা আসার সাথে সাথে গণহারে প্রাইভেট হসপিটালগুলো থেকে তরুণ ডাক্তারদের ছাটাই করে দেওয়া হলো যখন, হঠাৎ কর্মহীন হয়ে যাওয়া সে ডাক্তারগুলোর গুমরে কেঁদে ওঠা ক’জন দেখেছে?

বিভিন্ন জায়গায় যে স্যালারি ৫০-৬০% এ নেমে এলো, ডাক্তারটির দুশ্চিন্তার কালোমেঘে ছেয়ে যাওয়া চেহারাটি কার চোখে পড়েছে? “তোমার বাড়ি ভাড়া কয় টাকা কমেছে? গ্যাস বিল কারেন্ট বিল কয় টাকা কমেছে? বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয় টাকা কমেছে?”–এসব প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করেছে?

সন্তান বড় হয়েছে এবার সংসার তো একটু দেখবে। অন্তত বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্নীয়দের তো ঈদে ভালো কিছু উপহার দেবে। যে তরুণ ডাক্তারটি বড় পরিবার-আত্নীয়দের ঈদের উপহার দিয়ে খুশি করতে গিয়ে টাকা ধার করে ফেলে তার বুকের পাথরের ওজনটা কে মেপেছে?

পাশ করে বেরুতে না বেরুতেই শুরু হয়ে যায়, আপনার সন্তান এখন কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ? কীসের ডাক্তার? ও সিম্পল এমবিবিএস? ৬ বছর পড়াশোনা করার পর আবার ৪/৫ বছরের কোর্সে ঢোকার জন্যে মাসের পর মাস প্রস্তুতি। কোচিং-এ ভর্তি, আবার বই কেনা, দিন-রাত চেয়ার-টেবিলে বসে থাকা…নিজের ইন্টার্নশিপে জমানো ২৫০০০ টাকা যখন কোচিং-এ দিতে হলো সেদিন তার চোখের জল লুকানোটা কারও চোখে পড়েছে?

বিসিএস না পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশান? পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশান না বিসিএস? সরকারি ডাক্তার না হলে সমাজে আবার দাম নেই। বেসরকারিতে মালিকপক্ষ দু’আনার সম্মান দিতে চায় না। আবার অসম্ভব রকমের কাঠখড় পুড়িয়ে সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা পাওয়ার পর গ্রামে পাতি নেতাদের উপদ্রব, পান থেকে চুন খসলেই জনগণের মারমুখী আচরণ–তার এ জ্বালা নিভে কীভাবে তা কে জানতে চায়?

একবার এফসিপিএস পার্ট ওয়ান দিতে লাগে ১১০০০ টাকা, রেসিডেন্সি/ডিপ্লোমা কোয়ালিফাইং এক্সাম দিতে ৪-৫০০০ টাকা। এমআরসিপি পার্ট ওয়ানের জন্যে ৭০০০০-৮০০০০ টাকা। একজন তরুণ চিকিৎসকের জন্যে শুধু একটা পরীক্ষার জন্যে ১১০০০ টাকা দিয়ে ফর্ম ফিল আপ করার বেদনা কে বোঝে? তাও সে পরীক্ষা ১০০ জন দিলে পাশ করে ২/৩/৪/৫/৭ জন। তাও সে পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করতে অর্থ ইনকামের সব চিন্তা মাটিচাপা দিয়ে একটানা চেয়ার টেবিলে বসে থাকতে হয় তাকে। ছোট বাচ্চা থাকলে দরজা লক করে পড়তে হয়। “আম্মু/আব্বু দরজা খোলো” বললেও খোলা যায় না; কোলে নেয়া যায় না, নিলে যে আর নামবে না। এভাবে কতোবার পরীক্ষা দিতে থাকার পর যে খুব সৌভাগ্যবান হলে একটা ডিগ্রি করার সুযোগ ঘটে তা কে বোঝে? শুধু চান্স পেলেই কি হলো? সেখানে ফেইল করে/কোর্স আউট হয়ে কতো মানুষের জীবনটা নির্জীব হয়ে যায় তা কে বোঝে?

অনারারি ডিউটি নামে বর্বর প্রথায় বছরের পর বছর বিনা বেতনে খেটে যাওয়া তরুণ চিকিৎসকটিকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, তোমার সংসার কীভাবে চলে। তুমি কীভাবে খাও? কীভাবে পরো? এতোকিছু সামলে আবার কীভাবেই বা অবিশ্বাস্য কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হও? কেউ জিজ্ঞেস করে না তোমার পরিবারকে তুমি দিনে কয় ঘণ্টা সময় দাও? তুমি যখন বের হও তখনও তোমার সন্তান ঘুমে, তুমি ফেরার সময়েও সে ঘুমে? তোমার সন্তানকে পিতৃ/মাতৃস্নেহ থেকে যে বঞ্চিত রাখছো তোমার কান্না পায় না? তুমি দিনের পর দিন ৩-৪ ঘণ্টা করে ঘুমাও তোমার অসুখ করে না? তুমি যে বছরে একটা দিন ট্যুরে যাও না, তোমার একঘেঁয়েমি আসে না?

তরুণ ডাক্তারগুলো কেন হয় ডিপ্রেশান, না হয় এংজাইটি না হয় স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের রোগী হয়ে যায়, কেউ গবেষণা করে না কেন?

একজন তরুণ ডাক্তার তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকালটা কী চাপা আর্তনাদ নিয়ে কাটিয়ে দেয় তা কেউ দেখেও দেখে না কেন?

ডা. মারুফ রায়হান খান

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

রাস্তায় মৃতদেহ এবং সামাজিক মাধ্যমে দায়িত্বশীলতা

Mon May 4 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ মে ২০২০, সোমবার নানান মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে রোগীর অবস্থা শোচনীয়। রাস্তায় মানুষ মারা যাচ্ছে। সন্দেহ বেশি করোনার দিকে। সারা বছর এভাবে বহু লোক রাস্তায় মারা যায়। ফেরিঘাটে মারা যাওয়া শিশুর কথা খবরে এসেছে। অনেকের খবর আসে না। এটিই আমাদের প্রতিদিনের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র। আজকে করোনায় বা করোনা আক্রান্ত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo