উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট অধ্যাপক ডা. গোপাল শংকর দে

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন ২০২০, রবিবার

ডা. সাঈদ এনাম
সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।

কেনো জানি স্যার আমাকে (ডিএমসি-কে-৫২) আর ডা. জলধি রায়কে (ডিএমসি-কে-৫৩) ‘কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। জলধি আমাদের ঢাকা মেডিকেলের এক বছরের জুনিয়র।

জলধি যখন কোর্সে চান্স পায়, তখন আমাকে ফোনে আমতা আমতা করে বলছিলো, “সাঈদ ভাই কেমন হবে সিলেটে?”। আমি কেবল একটি কথাই বললাম, “চিন্তা করোনা এখানে অধ্যাপক গোপাল স্যার আছেন”।

স্যার আমাকে মনে হয় একটু বেশিই ভালোবাসতেন। সেই ২০০৮ সালের পোস্ট গ্রাজুয়েশন ক্লাসের প্রথম দিন থেকে পিকনিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এগুলোতে একটু আমি কম আগ্রহী থাকতাম। কিন্তু স্যার প্রোগ্রামের আগেই বলতেন, “চলে আসবা”। যেতাম এবং কর্কশ গলায় গানও গাওয়ার চেষ্টা করতাম।

স্যার আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছেন সাইকিয়াট্রির খুটিনাটি কিছু বিষয়। স্যার শিখাতেন গল্পে গল্পে। এসেই একটা সিনারিও, এন্টার টু দি মাইন্ড ওব দা পেশেন্ট। তারপর কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের দু’একটি কবিতা আবৃত্তি হতো। কবি গুরুর কিছু কবিতা আমার ছিলো মুখস্থ। স্যার ঘুরে ফেরে দেখতাম সেগুলোই আবৃত্তি করতেন৷ আমিও গুনগুন দু’ একলাইন ধরতাম।

“বিদায় অভিশাপ” থেকে প্রায়শই ১০/১২ লাইন আবৃত্তি করতেন স্যার।

শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক কত পবিত্র ও মধুর হতে পারে, সেটা যারা অধ্যাপক শংকর স্যারের ছাত্র একমাত্র তারাই বলতে পারবেন। দুর্গাপূজায় স্যারের বাসায় দুপুরের আহার ছিলো আমাদের প্রতি বছরের কাঙ্ক্ষিত ভুরিভোজ। খাবারের চেয়ে গল্পগুজবেই কাটতো সারাটা দুপুর। আবার যখন ডিপার্টমেন্টের পিকনিক, স্যার হয়ে যেতেন “নিষ্পাপ শিশু”।

গত বছর আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের সায়েন্টফিক সেমিনারে স্পিকার প্রেজেন্টার হিসেবে অংশগ্রহনের মেইল যেদিন পেলাম, স্যার কে প্রথমে ফোন দিলাম। স্যার বললেন, “সাবাস, রাঙিয়ে আসবে।”

পোলান্ডে গেলাম ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এর সেমিনারে। প্রায় ১৪ হাজার সাইকিয়াট্রিস্টের উপস্থিতিতে সরগরম সেমিনার। শত শত প্রেজেন্টেশন। সেখানেও স্পিকার প্রেসেন্টার হিসেবে যাত্রা। স্যারের কাছ থেকে ব্রিফ নিলাম, কিভাবে উপস্থাপন করবো। স্যার ব্রিফ করে বললেন, “যাও আমার আশির্বাদ আছে সবসময়”।

স্যারের উৎসাহে কানাডা, জাপান, স্পেন আরো কত শত দেশের সায়েন্টিফিক সেমিনারে অংশ নেবার আমন্ত্রণ জমে আছে ই-মেইল ইনবক্সে। বেঁচে থাকলে  হয়তো যাবো কোভিড-১৯ এরপর।

আগামী ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এর সায়েন্টিফিক সেমিনার। নিউজিল্যান্ড বিশ্বের একমাত্র কোভিড-১৯ মুক্ত দেশ। মুলত নিউজিল্যান্ড দেখার জন্যে সেখানের সেমিনারে অংশগ্রহনের ইচ্ছা। ‘স্পিকার প্রেজেন্টার’ হিসেবে থাকার জন্যে এবস্ট্রাকট জমা দিয়েছি মাস দুয়েক আগে। অনেকটা রথ দেখা কলা বেঁচা।

গত সপ্তাহে মেইল এসছে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন থেকে৷ স্যারের আশির্বাদ নেওয়া হয়নি এখনো….।

৬/৭ দিন আগে হঠাৎ শুনলাম আমার শ্রদ্ধেয় স্যার কোভিড-১৯ স্যার আক্রান্ত। চীকন একটা ভয় সেদিন থেকেই কাঁটার মতো বুকের মধ্যে বিঁধেছিলো।

রোববার স্যারের স্ত্রী আমাদের মাতৃতুল্য ‘ম্যাডামের’ সাথে দেখা করলাম ওসমানিতে হাসপাতালের কোভিড স্যাম্পল কালেকশন কর্নারে। তিনি কোভিড এর জন্যে স্যাম্পল দিতে আসছিলেন।

ম্যাডাম আমাকে খুব চিনেন। মুখে মাস্ক ছিলো, তাও দূর থেকে ম্যাডাম আমাকে দেখে চিনলেন ঠিকই। প্রায়ই স্যারের বাসায় যেতাম, এজন্যেই হয়তো ঠাহর করতে পেরেছিলেন।

কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে কথাবার্তা বললাম। নিজেকে শক্ত রেখে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শান্তনা দিলাম, শান্তনা নিলাম। ম্যাডাম কে বললাম, “ইনশাআল্লাহ ম্যাডাম, দেখবেন কিচ্ছু হবেনা”।

আমার অধ্যাপক ডা. গোপাল শংকর দে’স্যার আই সি ইউ তে চিকিৎসাধীন। আমি অপেক্ষায় আছি স্যারের আশির্বাদ নিতে। আমার প্রানপ্রিয় স্যার সুস্থ হয়ে আসবেনই আর আমি কদমবুচি করে আমার নিউজিল্যান্ডের সেমিনারে যাবার কথাটা স্যার’কে পাড়বো। বলবো স্যার, আপনিও চলেন আমার সাথে, সেখানে করোনা ভাইরাস নাই। আর স্যার সেটা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবেন, “গুড মাই বয়, আমার আশির্বাদ আছে সবসময়।”

কিছু দুঃসংবাদ হৃদয় নিতে পারবে না বলে মস্তিষ্ক শুনতে পায়না। রাব্বুল আলামীন এর কাছে আমার স্যারের আত্মার প্রশান্তি কামনা করি।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

লাইফ ইন লকডাউন, ডে এইটি ওয়ান

Sun Jun 28 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন ২০২০, রবিবার ডা. শুভদীপ চন্দ একটি মেয়ে কখনো বর্তমানে থাকে না। সে ব্যস্ত- অতীত নিয়ে, নয় ভবিষ্যত নিয়ে। নেক্সট ইয়ার, নেক্সট মান্থ, নেক্সট ডে, নেক্সট মিনিট। কখনো কখনো নেক্সট সেকেন্ড! ফলতো তার মা মারা যাওয়ার আগে যখন তার বাবা আরেকটি বিয়ে করলেন সে শুধু শোক সাগরেই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo