রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
চিকিৎসক না হয়েও নামের শেষে ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করে রংপুর নগরীতে রোগী দেখে আসছিলেন মোতালেব হোসেন রিপন নামের এক প্রতারক। একপর্যায়ে বিষয়টি জানাজানি হলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠায়।

সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আইনজীবী মিজানুর রহমানের সহায়তায় ভুয়া এজাহার এবং নথি তৈরি করে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয় রিপন। তবে ওই আইনজীবীর প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে নথিপত্র রংপুরের নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর। পরে বিষয়টি উচ্চ আদালতে জানানো হলে আসামির জামিন বাতিল এবং ভুয়া কাগজ জমা দেওয়ায় ওই আইনজীবীকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেন উচ্চ আদালত। এরপর সেই মামলার তদন্তে এজাহার জালসহ অভিনব এই প্রতারণা ও প্রতারক চক্রকে শনাক্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পুলিশের এই তদন্ত সংস্থার বরাতে জানা গেছে, প্রতারক চক্রের এই জালিয়াতি শুরু হয় ২০২০ সাল থেকে। দেশে যখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন রংপুর মহানগর এলাকায় প্রতারণার আখড়া খুলে বসে একটি চক্র। হিউম্যান কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে অনিবন্ধিত একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার খুলে নিজেকে এমবিবিএস পাস ও এফসিপিএস ডিগ্রিধারী দাবি করে রিপন চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে আসছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে রিপন এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মোস্তফা কামালসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে তারা জামিন আবেদন করলে রংপুর জজ আদালত রিপন এবং মোস্তফা কামাল ছাড়া বাকিদের জামিন মঞ্জুর করেন। এরপরই ঢাকার উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়ার জন্য শুরু হয় রিপন আর আইনজীবী মিজানুরের জালিয়াতি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রংপুর কারাগারে থাকাকালে ভুয়া চিকিৎসক রিপন তার সহযোগী মোস্তফা কামালকে জানায়, নিম্ন আদালত থেকে তাদের জামিন সম্ভব হবে না। এজন্য ঢাকার উচ্চ আদালত থেকে জামিন করাতে হবে। রিপনের পরিচিত একজন আইনজীবী আছেন, তাকে ৫ লাখ টাকা দিলে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া সম্ভব। এই কথায় মোস্তফা কামাল রাজি হলে দুজন মিলে রিপনের ভাইয়ের মাধ্যমে আইনজীবী মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দেন। এর ১৫-২০ দিন পর রিপনের জামিন হলেও মোস্তফা কামালের জামিন হয়নি। অবশ্য রিপনের জামিনের কাগজ উচ্চ আদালত থেকে রংপুরের নিম্ন আদালতে গেলে ধরা পরে আইনজীবীর জালিয়াতি। প্রতারক আইনজীবী মিজানুর রহমান জামিন আবেদনের জন্য যে আবেদন করেন, সেখানে তিনি মামলার জাল এজাহার দাখিল করেন। রংপুর থানার মামলার এজাহারনামীয় ২ নম্বর আসামি মোস্তফা কামালকে এক নম্বর আসামি বানিয়ে এবং এজাহারের এক নম্বর আসামি রিপনকে ২ নম্বর আসামি দেখিয়ে মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা, আদালতে আসামি ফরোয়ার্ডিংয়ের কপি সংগ্রহ করে জালিয়াতির মাধ্যমে জামিনের জন্য হাইকোর্টে নথি উপস্থাপন করে। এ ছাড়াও আসামির তদবিরকারক হিসেবে এমন একজনের স্বাক্ষর নেয়, যার সঙ্গে আসামির পরিচয় বা কোনা সম্পর্কই নেই।
পাশাপাশি ওই আইনজীবী আদালতকে জানান যে, আসামি মোস্তফা কামাল ওই মামলায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও আসামি রিপনের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। এসব ভুয়া তথ্য উপস্থাপন করে রিপনের জামিন মঞ্জুর করান তিনি। পরে নিম্ন আদালতে বিষয়টি ধরা পড়লে উচ্চ আদালতকে অবহিত করা হয় এবং জামিন বাতিল করা হয়। এরপর উচ্চ আদালত ওই আইনজীবীকে এক নম্বর আসামি করে ভুয়া তদবিরকারক মঞ্জুরুল হক এবং ভুয়া চিকিৎসক রিপনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা করেন। ওই মামলাটি পুলিশ এবং সিআইডির তদন্তের পর পিবিআইকে দায়িত্ব দেন আদালত। এরপর পিবিআইর তদন্তে বের হয়ে আসে আইনজীবী এবং ভুয়া চিকিৎসকের প্রতারণার কাহিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো, দক্ষিণ) আবির হোসেন বলেন, জামিন নেওয়ার জন্য শুধু ভুয়া মামলার এজাহার কিংবা নথি নয়, সাইদুর রহমান নামে এক কাল্পনিক চরিত্রও তৈরি করা হয়েছিল। আইনজীবী নিজেই ভুয়া নথি বানিয়ে আদালতকে বলেছিলেন যে, এসব নথি তিনি কুরিয়ারের মাধ্যমে সাইদুর রহমান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছেন; কিন্তু তদন্তকালে এই নামে কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মূলত নিজেকে রক্ষা করতেই তিনি এই প্রতারণার গল্প সাজিয়েছেন। তিনি আরও অনেক আসামিকে এভাবে জাল কাগজের মাধ্যমে জামিনের ব্যবস্থা করেছেন বলে তদন্তে জানা গেছে। খবর কালবেলার।
এই পিবিআই কর্মকর্তা বলেন, এক মামলা থেকে রক্ষা পেতে ভুয়া কাগজ ব্যবহার করায় আরেক মামলার আসামি হয়েছেন এই ব্যক্তিরা। দীর্ঘ তদন্তের পর মামলার চার্জশিট তৈরি করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত আইন অনুযায়ী বাকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
প্ল্যাটফর্ম/এমইউএএস