World CML Day: Chronic Myeloid Leukaemia ও এর বৈজ্ঞানিক পরিক্রমার ইতিহাস

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর,২০২০, মঙ্গলবার

লেখা: ডা. অখিল রঞ্জন বিশ্বাস

অধ্যাপক, হেমাটোলজী

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ

Chronic Myeloid Leukaemia (CML) যে একমাত্র লিউকেমিয়া নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রথম দিকের লিউকেমিয়ার বর্ণনা তথা আবিস্কারগুলো খুব সম্ভবত Chronic Myeloid Leukaemia –এরই বর্ণনা।

১৮৪৫ সালে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে, প্রথমে এডিনবার্গের প্যাথলজিষ্ট John Huges Bennet এটাকে বর্ণনা করেন রক্তের পচন (Suppuration of blood)-এর সাথে প্লীহা (spleen) ও যকৃত (liver)– এর বেড়ে যাওয়া হিসেবে এবং পরে জার্মান ফিজিওলজিষ্ট Rudolf Virchow এটাকে বর্ণনা করেন ‘Weisses Blut’ বা ‘White Blood’ তথা ‘Leukaemia’  হিসেবে।

J H Bennet এটিকে প্রথম বর্ণনা করলেও তিনি এটিকে এক ধরনের সংক্রমন বলে মনে করেছিলেন, পক্ষান্তরে R Virchow এটিকে বর্ণনা করেছিলেন রক্তের ক্যান্সার হিসেবে। যাহোক, খুব শীঘ্রই এই দুই বিজ্ঞানী তাঁদের মহত্ত্বের প্রমান স্বরূপ পরষ্পর পরষ্পরের কৃতিত্ব মেনে নেন- Virchow মেনে নেন Bennet –কে এর প্রথম বর্ণনাকারী হিসেবে আর Bennet মেনে নেন Vircho- কে এটিকে রক্তের ক্যান্সার হিসেবে প্রথম বর্ণনাকারী হিসেবে। এবং Virchow- এর দেয়া Leukaemia নামটিই স্বীকৃত হয়।

১৮৭২ সালে, Rudolf Virchow- এরই এক কৃতি ছাত্র Ernest Neumann লিউকেমিয়ার উৎপত্তিস্থল হিসেবে bone marrow বা অস্থিমজ্জাকে চিহ্নিত করেন, যা কোন রক্তের ক্যন্সার (Blood cancer)- কে লিউকেমিয়া হিসেবে নামকরনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এরপরের প্রায় শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন লিউকেমিয়ার বিভিন্ন ধরন যা মোটা দাগে প্রধানতঃ myeloid leukaemia এবং lymphoid leukaemia শ্রেণীদ্বয়ে বিভক্ত। এই দুই শ্রেনীতেই আছে acute leukaemia ও chronic leukaemia হিসেবে দু’টি শ্রেণী, যেগুলির মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো উপশ্রেণী।

 

যাহোক, ফিরে আসি Chronic Myeloid Leukaemia- তে। ১৯৫১ সাল CML-এর জন্য আরেকটি মাইলস্টোন। এই বছরে William Dameshek, CML- কে রোগের উৎপত্তিগতভাবে (pathophysiologically) অন্যান্য লিউকেমিয়া থেকে একেবারে আলাদা করে Myeloproliferative Disorders (MPD) নামক আরেক ধরনের ব্লাড ক্যান্সারের শ্রেণীতে দেখান।

তবে শুধু CML নয়, এমন কি শুধু লিউকেমিয়া অথবা শুধু ব্লাড ক্যান্সার নয়, যে কোনো ক্যান্সারের ইতিহাসে এক বড় মাইল ফলক ১৯৬০ সাল, যে বছর Peter Nowel এবং David Hungerford একটু ছোট হয়ে যাওয়া ২২ নম্বর ক্রোমোসোমকে CML –এর সাথে সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত করেন, যেটির নামকরণ করা হয় তাঁদের কর্মস্থলের নামে Philadelphia Chromosome হিসেবে। এর পরে বহু ধরনের ক্যান্সারের সাথে ক্রোমোসোমের অসংখ্য ধরনের সংখ্যাগত ও গঠনগত অস্বাভাবিকতার যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে।

 

তবে এধরনের প্রথম যোগসূত্র, Philadelphia Chromosome বা সংক্ষেপে Ph Chrosome, এই CML – এই উদঘাটিত হয়। অর্থাৎ, এই আরো একটি বিষয়েও CML প্রথম। অবশ্য এই Philadelphia Chromosome- এর গঠন নিয়ে ধারনাও পরে বদলে যায়।

১৯৭৩ সালে Janet Rowly দেখান যে Philadelphia Chromose স্রেফ ছোট হয়ে যাওয়া ২২ নং ক্রোমোসোম নয়, বরং ২২ নং ক্রোমোসোমের বড় বাহু থেকে বড় একটি অংশ ছুটে পড়ে গিয়ে সেখানে ৯ নং ক্রোমোসোমের বড় বাহু থেকে ছুটে আসা অপেক্ষাকৃত ছোট একটি ক্রোমোসোম খন্ড জোড়া লেগে যাওয়ার ফলে তৈরী হওয়া ক্রোমোসোম, যেটাকে জিনতত্বের ভাষায় বলা হয় t(9;22) বা translocation (9;22), যার তাৎপর্য রয়েছে World CML Day- এর তারিখ নির্ধারনে। ক্রোমোসোম খন্ডাংশের এই translocation বা পুনঃস্হাপনের কারনে ৯ নং ক্রোমোসোমে অবস্থিত নিষ্ক্রিয় ABL ক্যান্সার জিন ২২ নং ক্রোমোসোমের BCR নামক জিনের পরে যুক্ত হয়ে সক্রিয় হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, পুনঃস্থাপন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট BCR-ABL translocation gene হচ্ছে Chronic Myeloid Leukaemia ঘটানো জিন।

নামের সাথে ‘Chronic’ যুক্ত থাকা থেকেই বোঝা যায় Chronic Myeloid Leukaemia, Acute leukaemia সমূহের মত তীব্র মারমুখী ধরনের ব্লাড ক্যান্সার নয়, বরং বছরের পর বছর পর্যন্ত ধীর গতিতে অগ্রসরমান রোগ, এমন কি প্রথম দিকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোন রকম লক্ষনহীন অবস্থায়ও চলতে পারে। তবে কার্যকর চিকিৎসা ছাড়া এর অবশ্যম্ভাবী পরিনতি রোগ অগ্রসর (Progression of disease) হয়ে accelerated এবং অতঃপর blastic phase এ পর্যবসিত হওয়া, যা চরিত্রগতভাবে acute leukaemia এর মত এবং পরিণতি acute leukaemia-এর চেয়েও খারাপ, অর্থাৎ অবধারিত মৃত্যু।

অর্থাৎ, accelerated phase হয়ে blastic phase –এ সম্ভাব্য progression প্রতিহত করার মধ্যেই রয়েছে CML রোগীর বেঁচে থাকার চাবিকাঠি।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তর দশকের দিকে রক্তরোগের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী চিকিৎসা পদ্ধতি, Bone Marrow Transplantation (BMT) বা Haemopoietic Stem Cell Transplantation পদ্ধতির আবিষ্কারের ফলে এটিই ছিল CML চিকিৎসায় বলতে গেলে একমাত্র আয়ু বৃদ্ধিকারী চিকিৎসা পদ্ধতি; যা সহজলভ্য, দীর্ঘমেয়াদী জটিলতামুক্ত এবং সম্পূর্ন কার্যকর ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। তাছাড়া রোগীর সাথে match করে এমন bone marrow বা stem cell দাতাও অধিকাংশ সময়েই পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে স্বভাবতই অধিকাংশ রোগীকে চিকিৎসা দিতে হত কিছু কেমোথেরাপি জাতীয় ওষুধ দিয়ে, যেগুলি রোগীর কিছু উপসর্গের উপশম ঘটানো ছাড়া রোগের progression ঠেকানো তথা রোগীর আয়ু বৃদ্ধিতে অতি সামান্যই ভূমিকা রাখত। অবশ্য এর মধ্যে সামান্য ব্যতিক্রম interferon alpha নামে একটি ওষুধ, যেটি সামান্য কিছু ক্ষেত্রে (১০%-২০%) CML-এর progression খানিকটা ঠেকাতে সক্ষম।

তবে মানুষের বৈজ্ঞানিক জয়যাত্রা থেমে থাকে নি। ইতোমধ্যে জানা হয়ে গিয়েছে BCR-ABL translocation gene হচ্ছে CML সংঘটনে মূল অপরাধী। এরই আলোকে ১৯৯২ সালে Alexander Levitzki, tyrphostins নামে একটি ABL1 জিনকে নিস্ক্রিয়কারী মৌলের ধারনা উপস্থাপন করেন। প্রায় একই সময়ে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক ওষুধ গবেষনা ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান Ciba-Geigy আবিষ্কার করে GCP57148B নামক একটি মৌল, যা পরবর্তীতে Imatinib Mesylate নামে পরিচিত হয়। Imatinib হচ্ছে এক ধরনের tyrosine kinase inhibitor(TKI); TKI কী সে আলোচনা এখানে আনছি না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, Ciba-Geigy এই সম্ভাব্য ওষুধটি নিয়ে তেমন আগ্রহী না হলেও Oregon Health and Science University এর Brian Druker এটি নিয়ে প্রথম পর্যায়ের ব্যবহারিক পরীক্ষা (phase-I clinical trial) চালান।

এই পরীক্ষার আশাতীত সাফল্যের আলোকে পরবর্তীতে Novertis AG (Ciba-Geigy ও Sandoz একীভূত হয়ে গঠিত) ২য় ও ৩য় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাতে সর্বাত্বক বিনিয়োগ করে। এসব পরীক্ষার আক্ষরিক অর্থেই জাদুকরি সাফল্যে ২০০৩ সালে imatinib mesylate যুক্তরাষ্ট্রের FDA কর্তৃক অনুমোদন পায় CML চিকিৎসায় প্রথম পর্বে (1st line) ব্যবহারের জন্য। তখন বিখ্যাত সাময়িকী Time Magazine-এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে imatinib কে বর্ণনা করা হয় CML চিকিৎসায় magic bullet হিসেবে। Imatinib –এর সেই সাফল্য এতটাই জাদুকরী যে, এক সময় যে BMT চিকিৎসার সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যবহার হত CML চিকিৎসায়, সেই BMT প্রায় অতীত হয়ে গেল CML চিকিৎসায়। এই সূত্রে আরো একবার CML –এর নাম উঠে গেল প্রথম তালিকায়, সেটি হচ্ছে ক্যান্সার চিকিৎসায় targeted therapy বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী ওষুধের প্রয়োগ।

হ্যাঁ, Imatinib হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম targeted therapy, যেটি chronic myeloid leukaemia –এর প্রানঘাতী accelerated ও blastic phase এ অগ্রসর হওয়া বহুলাংশে ঠেকিয়ে দেয়ার সক্ষমতা দেখালো।

এতগুলো ‘প্রথম’ এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ার কারণে CML –কে disease of ‘first’ বলা হয়ে থাকে। তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে CML আরো বহুমুখী চরিত্র যেমন উদ্ঘাটিত হচ্ছে, তেমন আসছে নতুন নতুন targeted ওষুধটিও। ইতোমধ্যে আরো ৫ টি TKI চলে এসেছে CML চিকিৎসায়, যেগুলোর একটির সম্ভাব্য ব্যর্থতায় অন্যটির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে CML রোগীদের প্রায় স্বাভাবিক আয়ু প্রদান করা সম্ভব।

বিশ্বব্যাপী CML রোগী ও এর চিকিৎসা ও গবেষণায় সংশ্লিষ্টরা ২২শে সেপ্টেম্বর World CML Day হিসেবে পালন করেন। ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখকে আমেরিকান ঘরানায় লেখা হয় ৯/২২ হিসেবে, অর্থাৎ ৯ম মাসের ২২ তারিখ। Philadelphia Chromosome এর t(9:22) থেকে নিয়ে এই সংখ্যাটিকে স্মরণ করতেই এই তারিখ। World CML Day –এর প্রত্যাশা, বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবত CML রোগী সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন লাভে সমর্থ হোক।

Gowri Chanda

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

তবে কী মানব দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমছে?

Tue Sep 22 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার মানুষের দেহে হাজার হাজার রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির জন্য তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়৷ এজন্য দেহে এমন একটি বিস্তৃত থার্মোরেগুলেশন সিস্টেম রয়েছে, যা বেশিরভাগ সময় দেহের তাপমাত্রাকে আদর্শের কাছে রাখে। আমরা সকলে জানি ৯৮.৬˚F শরীরের সাধারণ তাপমাত্রা৷ প্রায় ১৬০ বছর পূর্বে পাওয়া ডাটা নমুনাগুলির অনুসারে সময়ের সাথে শরীরের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo