হাসপাতালে নিয়মতান্ত্রিক নজরদারি ও জটিলতা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার

ডা.আজাদ হাসান
সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ
ব্যাচ- ২১

মান সম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিয়মিত মনিটরিং এর বিকল্প নেই। আমাদের দেশে এমনিতেই মনিটরিং এর অভাব, সম্প্রতি তাও যেটা শুরু হয়েছিলো তা অঙ্কুরে বিনষ্ট করার এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হলেও দেশের জনমানুষের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করি।

কোয়ান্টিটি নয় কোয়ালিটি’র উপর বিশেষ ভাবে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত বলে আমি মনে করি। কেবল সাইন সর্বস্ব এবং চটকদার বিজ্ঞাপন নির্ভর প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতাল নয়, মান সম্পন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক চাই। স্বাস্থ্যসেবা কোনো পণ্য নয় যে এটা বিজ্ঞাপন নির্ভর হবে। যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করছে সেখানে অবশ্যই কঠিন নিয়মের মাধ্যমে, কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আপষের কোনো সুযোগ নেই”।

প্রসংগত উল্লেখ্য, প্রাইভেট ক্লিনিক সমূহ নিয়মিত মনিটরিং এর আওয়াতায় আনতে হলে বর্তমান কাঠামোর আওয়াতায় স্বাস্থ্য বিভাগের একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। কেননা, স্বাস্থ্য বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা না থাকায়, স্বাস্থ্য বিভাগ একক ভাবে মনিটরিং করলেও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব এবং ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতার অভাবে তা কখনো ইফেক্টিভ হয় না। স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রশাসনের উপর নির্ভর করতে হয়, প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ আবার প্রায়শঃই নিজেদের রুটিন ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতের মনিটরিং এর ইচ্ছে থাকলেও ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় সেটা এখন অনেকটাই প্রশাসনের মর্জির উপর নির্ভরশীল। আর এর সুযোগে প্রাইভেট ক্লিনিক মালিকরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। তাই এসব অনিয়ম দূর করতে স্বাস্থ্য বিভাগে প্রতি জেলায় একজন করে “প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেসী” ক্ষমতা সম্পন্ন “ডেপুটি সিভিল সার্জন” (হাসপাতাল ও ক্লিনিক মনিটরিং বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল) পদ সৃষ্টি করে, জেলার সকল প্রাইভেট ক্লিনিক এবং ডায়গনসিস সেন্টার সমূহকে নিয়মিত মনিটরিং এর অধীনে আনায়ন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত প্রস্তাবিত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ ডেপুটি সিভিল সার্জন পদ সৃষ্টি না হবে ততদিন পর্যন্ত বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেট এর নেতৃত্বে একজন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত “ভ্রাম্যমান আদালত” দ্বারা বর্তমান শুদ্ধিকরণ অভিযান অব্যাহত রাখা উচিৎ বলে আমি মনে করি।

সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারলাম, সম্প্রতি ক্লিনিক মালিকদের পক্ষ হতে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান পরিচালনা’ শীর্ষক চিঠিতে সরকারের উচ্চ মহলে অভিযোগ জানিয়ে বলা হয়, ‘‘করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য নানা বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করছেন। একটি হাসপাতালে একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করাতে তাদের স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং এ কারণে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে একধরনের চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে।’’

এই অভিযোগটি কোনো ভাবে গ্রহন যোগ্য নয়। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা ক্লিনিক যদি সরকারি বিধি মোতাবেক স্বাস্থ্য সেবা পরিচালনা করে থাকে, তা হলে তো ওনাদের এতো চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ব্যবসা করতে অসুবিধা নেই কিন্তু সেটা দেশে প্রচলিত নিয়ম এবং বিধি বিধান মেনেই করা উচিত এবং এক্ষেত্রে অবশ্যই স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে হবে, যাতে রোগীরা প্রতারিত না হন। আর এটা মনিটর করা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থার। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত ইন্সপেকশনে “ভ্রাম্যমাণ আদালত” দেখা গিয়েছে, করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি ধরা পড়ে। বিশেষ করে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা অনৈতিক ভাবে সাধারণত জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা জন সম্মুখে প্রকাশিত হয়। ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অভিযানের ফলে ক্লিনিক সমূহের বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়ে। এমন কি এই অভিযানের ফলে লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় বছরের পর বছর হাসপাতাল পরিচালনার মতো অনিয়ম আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। যা দেশের মানুষের কাছে আস্থার সংকটই তৈরী করে নি, বরং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশেট ভাবমূর্তিকে দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান পরিচালনা না করলে হাসপাতালের এসব অনিয়ম কখনোই জনগণের সামনে আসত না। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে অভিযান পরিচালনা করতে গেলে তাতে করে কেবল দীর্ঘসূত্রিতা বৃদ্ধি পাবে, তা রোগীদের স্বার্থে কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। টাস্কফোর্স কমিটিতে জন-নিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব থাকলেই কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিশ্চিত হবে আমি সেটা মনে করি না। তাছাড়া তিনি একজন নন-টেকনিক্যাল পারসন। টেকনিক্যাল বিষয় গুলো টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। আর তাই, হাসপাতালের অনিয়ম ও জালিয়াতি ধরার ক্ষেত্রে “ভ্রাম্যমান আদালতে”র মাধ্যমে অভিযানের বিকল্প নেই বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। প্রসংগত উল্লেখ্য, এই যে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক সমূহ বিনা লাইসেন্সে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে ব্যবসা করে যাচ্ছে, সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? এর জন্য কারা দায়ী, বর্তমান সিস্টেমের মাঝে কোনো গাফিলতি থাকলে তাও সংশোধন পূর্বক আপগ্রেড করা আবশ্যক।

আর একটি বিষয়, এখানে আমি প্রাইভেট ক্লিনিকের প্রসংগে আলোচনা করলেও সরকারি হাসপাতাল সমূহও মনিটরিং এর আওয়াতায় আনতে হবে। কাউকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সব ক্ষেত্রেই কোয়ালিটি মেইটেইন করার সাথে সাথে কমপ্লাইয়েন্স, উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন ম্যান পাওয়ার বা টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সঠিকভাবে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, সেইফ মেডিক্যাল ওয়েস্ট(বর্জ্য) ডিসপোজাল ইত্যাদি বিষয় গুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। সুতরাং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্তটি পুনরায় বিবেচনার অনুরোধ করছি।

প্রসংগত উল্লেখ্য, ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন করার পূর্ব শর্ত হিসাবে নিম্নোক্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান হতে ছাড়পত্র নিতে হয়ঃ
১) পরিবেশ অধিদপ্তর,
২) কারখানা অধিদপ্তর,
৩) শ্রম অধিদপ্তর,
৪) দমকল অধিদপ্তর,
৫) সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্সের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।

তাছাড়া সব দপ্তরেই বিপুল পরিমান লাইসেন্স ফি ধার্য করা হয়েছে। আর সিটি কর্পোরেশন তো একধাপ এগিয়ে, একরকম এমাউন্ট দিয়ে প্রতিবছর লাইসেন্স করতে হবে। কথিত আছে, সরকারের এসব প্রতিটি দপ্তরেই লাইসেন্সের জন্য ঘুষ দিতেই হয়, না হয় পার্টিকে ঘুরাতেই থাকে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ব্যাপারে অভিযোগের তীর এক নম্বরে, লাখ টাকা উপরি ছাড়া কথাই বলতে চায় না। এখন আপনারাই বলুন এদেশে কিভাবে চলবেন? এসব অনিয়ম থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ২৭ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ২৮৫১ জন

Fri Aug 7 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০ গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ২,৮৫১ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন আরো ২৭ জন এবং আরোগ্য লাভ করেছেন ১,৭৬০ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ২,৫২,৫০২ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ৩,৩৩৩ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ১,৪৫,৫৮৪ জন। দুপুর ০২.৩০ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo