বাংলাদেশ কেন বিদেশী জনবলকে স্বাস্থ্যখাতে কাজ করতে উৎসাহিত করছে?

ঘটনা- ১

তিনজন চিকিৎসক দিল্লীস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ভিসা ইন্টারভ্যু দিতে গেলেন। তাদের একজন ভারতীয়, একজন নেপালী এবং শেষজন বাংলাদেশী। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে অংশ নিতে তারা একসঙ্গে যাবেন। ইন্টারভ্যু শেষে তাদের পাসপোর্ট রেখে দেয়া হল, জানানো হল কিছুদিন পর কুরিয়ারে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়া হবে।

লক্ষণ হিসেবে ‘পাসপোর্ট রেখে দেয়া’ অত্যন্ত ইতিবাচক। আপনার পাসপোর্ট রেখে দেয়ার অর্থ, আপনার ভিসাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ৯৯%। তিন চিকিৎসক সানন্দে দূতাবাস থেকে বেরিয়ে এলেন। দিল্লীস্থ একটি রেস্তোরাঁয় তিন বন্ধু মিলে পর্যাপ্ত পানাহার করলেন, সফলভাবে ভিসা ইন্টারভ্যু সম্পন্ন হবার আনন্দ উদযাপন করা হল।
কিছুদিন পর কুরিয়ারে আমেরিকার ভিসাসহ ভারতীয় ও বাংলাদেশী চিকিৎসকের পাসপোর্ট চলে এলো। কিন্তু নেপালী চিকিৎসকের পাসপোর্ট এলো না। ঐ চিকিৎসকের বাবা নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী, তিনি কূটনৈতিক মাধ্যমে খবর নেয়ার চেষ্টা করলেন, ঘটনা আসলে কী? দুজনের পাসপোর্ট ভিসা হয়ে গেল, তারটা কেন হল না?
পরে জানা গেল, বাংলাদেশী ও ভারতীয় চিকিৎসকের ভিসা প্রদানে অতিরিক্ত কোন চার্জ নেই, কারন এই দুটো দেশে আসার জন্য আমেরিকার নাগরিকদের কোন চার্জ দিতে হয় না। কিন্তু নেপালে যেতে হলে আমেরিকানদের অতিরিক্ত ভিসা চার্জ দিতে হয়। কাজেই আমেরিকাও নেপালী নাগরিকদের ভিসা দেয়ার জন্য অতিরিক্ত ২০০ ডলার চার্জ নেয়। সেই নেপালী চিকিৎসককে ভদ্রভাবে জানিয়ে দেয়া হল, মন্ত্রীপুত্র হও আর যাই হও, ঐ চার্জ দিলেই ভিসা জুটবে, অন্যথায় নয়।

ঘটনা- ২

ইউরোপভিত্তিক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যখাতের ডেটা নিয়ে কাজ করার জন্য একজন কর্মী প্রয়োজন। বেতন বার্ষিক আঠারো হাজার ডলার, কর্মস্থল ভারতের পুনে শহর। একজন বাংলাদেশী চিকিৎসক সেই চাকরিতে আবেদন করলেন এবং প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকেও গেলেন। চূড়ান্ত ইন্টারভ্যু’র আগে তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস থেকে ফোন করা হল।
‘স্যরি, তোমার প্রোফাইল ম্যাচ করা সত্ত্বেও তোমাকে আমরা নিতে পারছি না’।
‘খুবই ভাল কথা, কিন্তু কেন?’ বাংলাদেশী চিকিৎসকটি সাগ্রহে জানতে চাইলেন।
‘আমাদের লোক দরকার ভারতীয় অফিসে, কিন্তু ভারতে জব-ভিসার নিয়ম অনুসারে তুমি সেখানে কাজ করতে পারবে না’।

‘আমি যতদূর জানি ভারতে ডাক্তারি করতে লাইসেন্সিং করাতে হয়, কিন্তু ডেটা সায়েন্টিস্ট কিংবা প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে সেরকম কোন লাইসেন্সিং এর ব্যাপার নেই’।
‘ তোমার কথা ঠিক। কিন্তু সমস্যাটা লাইসেন্সিংয়ের না। ভারতের অভিবাসন আইন অনুসারে কোন বিদেশি নাগরিক যদি ভারতে কাজ করতে চায় তাহলে তাকে দুটো শর্ত পুরন করতে হয়। প্রথমত, তাকে এমন কোন কাজ করতে হবে যেটার যোগ্য লোক ভারতে নেই। দ্বিতীয়ত, তার বার্ষিক আয় হতে হবে কমপক্ষে পঁচিশ হাজার ডলার। কাজেই তোমার আপাতত কোন আশা নেই’।

বাংলাদেশী চিকিৎসক চাকরিটি পেলেন না। এতে অবশ্য তিনি বিশেষ বিচলিত হলেন না। সেদিন বিকেলে তাকে ভারতের রাজপথের পাশে দাঁড়িয়ে ‘গোলগাপ্পা’ খেতে দেখা গেল। গোলগাপ্পা জিনিসটা হচ্ছে ফুচকা, তবে বাংলাদেশে যেভাবে তেঁতুলের টক দেয়া হয় ভারতে তা দেয়া হয় না। পরিবর্তে সবুজ একটা তরল দেয়া হয়, সেটাতে টকের সঙ্গে পুদিনা মেশানো থাকে। গোলগাপ্পা খাওয়া শেষে চুকচুক করে ঐ তরল খেতে একেবারে খারাপ লাগে না।

পরিশিষ্ট-
বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগী দেখতে আসেন। দেশে তাদের সমযোগ্যতার চিকিৎসকের কোন কমতি না থাকলেও তারা আসেন, তাদের কোন লাইসেন্সিং প্রয়োজন হয় না। বরং তাদের আগমন উপলক্ষ্যে হাসপাতালগুলো প্রচুর বিজ্ঞাপন দেয় যাতে রোগী সমাগম বেশি হয়, তাতে সেই হাসপাতাল ও ভারতীয় চিকিৎসকদের অর্থনৈতিক লাভ হয় বটে, কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যখাতের দুটো বড়সড় ক্ষতি হয়। প্রথমত, যে চিকিৎসা অল্প ব্যয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে করা যেত সেটা উচ্চ ব্যয়ে করা হয়, ফলে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, জনমনে পরোক্ষ ধারণা জন্মায়, ‘ভারতীয় ডাক্তার মানেই ভালো, কাজেই ছোটখাটো কাজ হলে এখানেই তাদের দেখিয়ে নেয়া যাবে, বড় অপারেশন হলে প্রয়োজনে ভারত চলে যাবো, অসুবিধা কোথায়!’ সেবা যারা নেবেন, তাদের এমন মনস্তত্ত্ব দেশের স্বাস্থ্যসেবার বিকাশের পথ অনেকটাই রুদ্ধ করে দেয়।

আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সেই বিচক্ষণ ব্যক্তিদের কাছে সবিনয়ে প্রশ্ন করতে চাই, নেপালের নাগরিকের কাছে ভিসা বাবদ আমেরিকা কেন অতিরিক্ত পয়সা নেয়? ভারত কেন বিদেশী জনবলকে ভারতে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে? অপার সম্ভাবনাময় স্বাধীন বাংলাদেশকে কেন স্বাস্থ্যখাতে দিনদিন পরনির্ভর করে ফেলা হচ্ছে?

লিখেছেন:
ডা. মাহবুব হোসেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ
শিক্ষার্থী, জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মেডিকেলিও গোয়েন্দা গিরিঃ Losartan ও Renal artery stenosis (RAS) এর গল্প

Sun Apr 2 , 2017
৬৫ বছরের বয়স্ক ভদ্রলোককে ধরাধরি করে এনে জরুরি বিভাগের বিছানায় শুইয়ে দিল। সাথে আসা লোকদের জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে? জানাল, মাথা ঘুরে পড়ে গেছে আর বমি করছে। রোগীর কাছে গিয়ে দেখি মুখটা এক দিকে বেঁকে গেছে। Pupillary response চেক করলাম, নরমালি রিএক্টিং, নরমাল সাইজ। হঠাৎ চোখ পড়ল রোগীর দুই চোখের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo