পরের জায়গা পরের জমি অথবা হামসকলসঃ

mscmb

আমরা সাদাকালো টিভি প্রজন্ম, আমরা ভিডিও ভিসিআর যুগের প্রজন্ম। সে সময় পরিচালকগন ছবির শেষে জড়ুয়া ভাই- বোন উপস্থিত করে আমাদের চমৎকৃত-হতবাক করিয়া দিতেন আর বিনিময়ে পাইতেন অজস্র করতালির ইনাম। এখন দিনকাল ভাল না, কোন কিছু দিয়া আজকের প্রজন্মকে হতবাক করা যায় না ইহারা নাস্তিক জুকারবার্গের সেলফি প্রজন্ম। আর তাই পরিচালকরা হাজির করেন জড়ূয়ার উপরে তেড়ুয়ার চমক লইয়া।

তাহাতেও কী শেষ রক্ষা হয়, বক্স অফিস মাত হয়?

তবে আজ এই অসুস্থ শরীর লইয়া আমি বোম্বাইয়া ছবি বিশ্লেষন করিতে বসি নাই। একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে একটি ক্ষুদ্রাকায় প্রানী আর তাহার অবদানের প্রতি সুধিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করিব। আপনারা ইহাকে ঘ্রিণাভরে বলেন ভাইরাস, আর আমি বলি হামসকলস অথবা পজাপজ (পরের জায়গা পরের জমি)।
জীবণঘাতি একটি ভাইরাসের প্রতি আমার এই অনুরাগ দেখিয়া আপনারা আশ্চর্য হইতে পারেন।

তাই একটু ব্যাখ্যায় যাইতেছি।

প্রিথিবীতে বাহুল্য বিহীন এই একটি প্রানী পাইবেন- শুধু নিউক্লিক এসিড আর ক্যাপসিড এর সমন্বয়ে যাহাদের শরীর গঠিত। অথচ এই শরীর লইয়াই উহারা কত কাজ আমাদের অগোচরে করিয়া যাইতেছে ভাবিতেও আশ্চর্য লাগে। দুনিয়ার সবচেয়ে যে দুষ্ট সম্প্রদায় তাহার নাম মানব সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের লোকেদের শাস্তি প্রদানের গুরুদায়িত্ব উহারা মাথায় তুলিয়া লইয়াছে। ছোটখাট দুষ্টামির জন্য ফ্লু, ডাইরিয়া ইত্যাদির লঘুদন্ড, মাঝারি দুষ্টামির জন্য হেপাটাইটিসের ঝারি, আর বড় দুষ্টামির জন্য ক্যান্সার নামক অতিশয় ভয়ানক রোগের গুরুদন্ডও উহারা আরোপ করিতে কখনো কুন্ঠিত হয় না।

কখনো কখনো আবার স্প্যানিশ ফ্লুর মত ভয়ানক রুপে আবর্ভূত হইয়া পাপি তাপি মনুষ্য জাতির নগর জনপদ উজাড় করিয়া দেয়।

তবে দুষ্ট মানুষ ও কিন্তু কম যায় না। কিউট দুইটা ভাইরাসকে তাহারা প্রায় কব্জা করিয়া ফেলিয়াছে। স্মল পক্স নামের সেই কিউট ভাইরাসটাকে যে কোথায় গুম করিল? ওইদিকে ঠ্যাং না ভঙ্গিয়াই পাপী মানব সন্তানকে খোঁড়া করিবার যে টেকনিক পোলিও নামল সুইট বালিকা ভাইরাসটি আত্মস্থ করিয়াছিল তাহার টেকনিকগুলিও আর আজ কাল কাজ করিতেছে না।

জ্ঞানীরা বলেন- Simplicity is the ultimate sophistication- ভাইরাস উহার এক অসামান্য নজির।

তবে কিছু ভাইরাস আবার এতটা simplicity তে চলিতে পারে না। তাদের আবার বাহারী এনভেলপ প্রয়োজন হয়! কলিকাল আর কি! ঘোর কলিকাল। অবশ্য এই বিলাসীতার ফল ওই সব ফুলবাবুরা হাতে হাতে পাইয়াছে। যেকোন পথে উহারা মানব দেহে প্রবেশের ক্ষমতা হারাইয়াছে। মানব মানবী যখন গোপন ক্রিয়া কর্মে লিপ্ত হয় তখন সেই দূর্বল মুহূর্তে তাহারা উহাদের শরীরে প্রবেশ করে। এইসব কলিকালের হামসকলস দের সম্পর্কে আর কি বলিব, ইহারা দুধের শিশুদেরও রেহাই দেয় না। মায়ের শরীরের নিরাপদ আশ্রয়কে বিষাক্ত করিয়া ইহারা গর্ভের শিশুর শরীরেও প্রবেশ করে, কোন নিস্তার নাই।

আপনারা ভাইরাস বলিলেও আমি কেন ইহাদিগকে হামসকলস বলিয়া ডাকি তাহার একটু ব্যাখ্যা দেওয়ার এই মুহূর্তে প্রয়োজন মনে করি।

হামসকলস এ তেড়ুয়া দেখিয়া আপনারা চমৎকৃত আর ভাইরাসের জগতে এইরুপ ঘটনা তো কোনই ব্যাপার নয়। একসঙ্গে শয়ে শয়ে বা হাজারে ভাই বেরাদরের জন্ম- জড়ুয়া তেড়ুয়া তো এইখানে নস্যি।

আর দেখেন এই নশ্বর দুনিয়া তে কয় দিনের জন্য ই বা আসা। অথচ তাহার জন্য কত কসরত, কত ঘর বাড়ি। অথচ এই সব বাহুল্য স্বভাব হামসকলস দের মধ্যে নাই। আমরা পয়সা কড়ির অভাবে নিতান্ত মনঃকষ্টে ভাড়া বাসাতে থাকি। অথচ উহারা আমির গরীব সকলেই অন্যের বাসায় থাকে আর সেই বাসার ইউটিলিটির ভাগ নেয়। যেন তাহারা কবির এই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে আগ্রহী- পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই…

আজ কয়েকদিনের চেষ্টায় উনারা আমার শরীরে তসরিফ আনিয়াছেন। মাঝে কয়েকদিন ঊনাদের সঙ্গে আমার দারোয়ান ‘ইনেট আর একোয়ার্ড’ এর বনিবনা না হওয়ায় উনারা আসি আসি করিয়াও আসিতেছিলেন না। গতকাল আমার দারোয়ান সাহেবগন আনুষ্ঠানিক ভাবে পরাজয় মানিয়া আমাকে হামসকলসগনের হাতে সোপর্দ করিয়াছেন।

কি ভাবিয়াছেন, ইহাতে আমি বিচলিত?
কভি নেহি।

উনাদের সান্যিধ্যের মাদকতাময় উপস্থিতি আমি রীতিমত তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করিতেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে গা হাত পা ব্যাথা, বিচ্ছিন্ন হাঁচি- কাশি অস্বস্তি ইত্যাকার সমস্যাগুলি যদি আপনি কষ্ট করিয়া মানিয়া নিতে পারেন, নাপা, আপা ইত্যাদির দিকে দৌড়ঝাপ না করেন তবে আপনি পাইবেন জ্বরের সেই অমূল্য মাদকতাময় উপস্থিতি।
নার্ভাস থার্মোমিটারের মুহূমুহূ সতর্কতাকে অগ্রাহ্য করিয়া আপনি যদি শান্ত থাকিতে পারেন, যদি আপনার লক্ষ্য থাকে অটুট তবেই কেবল আপনি মঞ্জিলে মকসুদের পৌছাইতে পারিবেন। ১০০,১০১,১০২…… ক্রমশ একটা ঘোরের মধ্যে চলিয়া যাইবেন।

বোনাস হিসাবে দীর্ঘদিনের বিবাহিতরা যাহারা স্ত্রী মুখের ঝামটাকেই এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সবচেয়ে অপরিবর্তনীয় বিষয় হিসাবে নিশ্চিত হইয়া গিয়াছিলেন তাহাদের জন্য বিস্ময় আর আনন্দের খোরাক যৌবনে শোনা স্ত্রীর মুখের মধুর বচন। আর সাপ্লি খাইয়া ক্রমাগত পিতামাতার বকাবাজির শিকার ছাত্র ছাত্রী ভাই বোনেরা পাইবেন মেডিকেল ভর্তির প্রারম্ভে শোনা এবং বহু বিশ্রুত মা- বাবার কোমল বানি আর আদর আহ্লাদের আস্বাদ।

তবে সব কিছুর ই একটা শেষ থাকে।
তাই বিছানায় শুইয়া শুইয়া, ফেসবুক মুখস্ত করিয়া করিয়া (আরে বাবা , এই অবসরে একটু পাঠ্য বৈ পড়িলে কি হয়? ) আপনি যখন ক্লান্ত, বিরক্ত তখন আপনাকে একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসাবে একটি শুভ সংবাদ শুনাই। তবে একটু কষ্ট করিতে হইবে।

টেক্সট বৈ ল্যাঞ্জের ভাইরোলজি চ্যাপ্টারে চলিয়া যান ( গাইডে অভ্যস্ত আপনার পক্ষে কিছুটা কষ্টকর হইলেও উপায় নাই, জানেন ই তো কষ্টে কেষ্ট মেলে)। হোস্ট ডিফেন্সের একটি পর্যায়ে লেখা আছে, আপনার জ্বর এবং ইহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হামসকলস দেরও মনোদৈহিক বিপর্যয়ের কারণ। ইহা একদিকে যেমন আরামদায়ক তাপমাত্রার পরিবর্তে এই উচ্চ তাপমাত্রায় উহাদের বংশব্রিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছে, তেমনি বিরক্ত আর হতাশায় অনেককে নিষ্ক্রিয় ও করিয়াছে।

অতএব আপনার রোগমুক্তি আসন্ন।

সকলে আবার যার যার মত ক্লাসে যাওয়ার, ক্লাস নেয়ার ও করার এবং সাপ্লি-পেন্ডিং দেয়া ও নেয়ায় আবার ব্যস্ত হই।

 

লিখেছেনঃ ডা. জাকির হোসাইন

ডিপার্টমেন্ট ওফ মাইক্রোবায়োলজি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ।

ডক্টরস ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং আমরা ডাক্তার সমাজ

Mon Jul 21 , 2014
লেখকঃ ডাঃ মারুফুর রহমান অপু হতাশার কথা দিয়ে শুরু করি। এবারের ৩৩তম বিসিএস এ নিয়োগ প্রাপ্ত ডাক্তারদের অনেককেই দেখলাম “মুরাদ টাকলা”! শুধু ৩৩তম বিসিএস নয়, পূর্বতন বিসিএস অথবা নন বিসিএস ডাক্তার এবং মেডিকেল স্টুডেন্ট অনেককেই টাকলামি করতে দেখেছি এই ফেসবুকে। ডাক্তারির মত একটি প্রতিযোগীতামূলক সম্মানীয় পেশায় মেধাবীরাই আসে বলে বিশ্বাস […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo