গাজায় ইসরায়েলি অবরোধে খাদ্যের অভাবে কঙ্কালসার শিশু সিওয়ার

সোমবার, ২৬ মে, ২০২৫

ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজায় ভয়াবহ খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে এখন গাজা। খাদ্যের অভাবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা শিশুদের। অপুষ্টিতে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ শিশুই। এমনই এক শিশুকে নিয়ে লিখেছেন বিবিসির ফার্গাল কিন। সোমবার (২৬ মে) বিবিসির অনলাইনে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।

দাদির কোলে অপুষ্টিতে ভোগা গাজার শিশু সিওয়ার। পাশে বসে আছে তার মা নাজওয়া। নিজেদের জন্য খাবার জোগাড় করতে প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের। ছবি: বিবিসির স্ক্রিনশট

ক্যামেরা দেখার পরও কারও মধ্যে উৎসাহ দেখা যায় না। শিশুরা চোখ তুলে তাকায় না বললেই চলে।

মৃত, মুমূর্ষু ও মৃত্যুর প্রহর গোনা মানুষের মধ্যে বসবাস করা একটি শিশুকে আর কীই–বা অবাক করতে পারে?

ক্ষুধা তাদের নিঃশেষ করে ফেলেছে। সামান্য একটু খাবারের আশায় তারা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কখনো কখনো ভাগ্যে কিছুই জোটে না।

বিবিসির জন্য কাজ করা আমার সহকর্মী ও তাঁর ক্যামেরার সঙ্গে এসব গাজাবাসী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

বিবিসির সহকর্মী দেখেছেন তাঁদের অনাহার, মৃত্যু পথযাত্রা এবং কীভাবে তাঁদের মরদেহ বা দেহের খণ্ডাংশ সাদা কাফনে মোড়ানো হয়। নাম জানা থাকলে তাঁদের নাম সেই কাফনের ওপর লেখা হয়।

১৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধ এবং এখন নতুন করে ইসরায়েলি হামলার মধ্যে এই স্থানীয় ক্যামেরাম্যান হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বেঁচে থাকা মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আহাজারি শুনে চলেছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে আমি তাঁর নাম প্রকাশ করছি না।

তিনি শারীরিকভাবে সম্মানজনক দূরত্বে থাকেন, কিন্তু তাঁরা দিনরাত তাঁর মনে জেগে থাকেন।

তিনিও তাঁদেরই একজন—একই সংকীর্ণ নরকে বন্দী।

এই সকালে বিবিসির সহকর্মী খুঁজতে বেরিয়েছেন শিশু সিওয়ার আশুরকে। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে পাঁচ মাস বয়সী এই কন্যাশিশুর কঙ্কালসার দেহ এবং কান্না তাঁকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তিনি আমাকে লিখেছিলেন, তাঁর ভেতরটা ভেঙেচুরে গেছে।

সিওয়ার আশুরের ওজন ছিল মাত্র দুই কেজির একটু বেশি।

পাঁচ মাস বয়সী একটি শিশুর ওজন সাধারণত ছয় কেজি বা তার বেশি হওয়া উচিত।

সিওয়ারকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং সে এখন তার বাসায়, এমনটাই শুনেছেন আমার সহকর্মী।

এ খবর পেয়ে আমার বিবিসির সহকর্মী ছুটে এসেছেন গুঁড়িয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি আর ত্রিপল ও টিনের তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে।

কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই আমার সহকর্মী অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে আমি খুদে বার্তা দিয়ে তাঁর খোঁজ নিয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ঠিক নেই। মাত্র কিছুক্ষণ আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী খান ইউনিসের বেশির ভাগ এলাকা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে…আমরা জানি না কী করব, যাওয়ার জন্য কোথাও কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।

‘আল-মাওয়াসি এলাকাটি বাস্তুচ্যুত মানুষের ভিড়ে গিজগিজ করছে। আমরা দিশাহারা, এখন কী করব বুঝতে পারছি না।’

বিবিসির সহকর্মী এক কক্ষবিশিষ্ট একটি ছোট কুটির খুঁজে পেলেন, যার প্রবেশপথে ধূসর-কালো ফুলেল পর্দা টাঙানো। কক্ষের ভেতরে রয়েছে তিনটি গদি, একটি ড্রয়ারের অংশবিশেষ আর একটি আয়না। সে আয়নায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে তা সিওয়ার, তার মা নাজওয়া ও নানি রিমের সামনে মেঝেতে এসে পড়েছে।

সিওয়ার চুপচাপ, দুই নারীর সুরক্ষার ছায়ায় সে এখন নিরাপদে আছে।

শিশুটি প্রচণ্ড অ্যালার্জির কারণে সাধারণ দুধের ফর্মুলা হজম করতে পারে না।

একদিকে যুদ্ধ, তার ওপর ইসরায়েল গাজায় ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দিচ্ছে না। এ কারণে সেখানে সিওয়ারের মতো শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ফর্মুলা দুধের তীব্র ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

২৩ বছর বয়সী নাজওয়া বলেন, ‘নাসের হাসপাতালে থাকার সময় তাঁর মেয়ের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। তাই চিকিৎসকেরা কয়েক দিন আগে একটি ফর্মুলা দুধের কৌটা দিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেন। এখন বাসায় ফেরার পর সিওয়ারের ওজন কমতে শুরু করেছে। চিকিৎসকেরা আমাকে বলেছিলেন, সিওয়ারের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়, সে এখনো হাড় জিরজিরে। তার অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। সিওয়ারের জন্য কেবল একটি দুধের কৌটা খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা (চিকিৎসক)। সেটিও এখন ফুরিয়ে এসেছে।’

সিওয়ারের মুখের সামনে মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে।

সিওয়ারের মা নাজওয়া বলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। পোকামাকড় ওর গায়ে ভিড়তে আসে। ওকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, যাতে তাঁর গায়ে কিছু না লাগে।’

গত বছরের নভেম্বরে জন্মের পর থেকে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই বড় হচ্ছে সিওয়ার। কাছে কিংবা দূর থেকে কখনো মর্টার বা রকেট, আবার কখনো বোমার শব্দ ভেসে আসছে। ক্ষণে ক্ষণে বন্দুকের গুলি কিংবা মাথার ওপর গর্জে উঠছে ইসরায়েলি ড্রোন।

নাজওয়া বলেন, ‘এত কাছে থেকে প্রচণ্ড জোরে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান আর রকেটের শব্দ হয় যে সে এগুলো বুঝতে পারে। যখন সিওয়ার এগুলোর শব্দ শোনে, তখন সে ভয়ে কেঁদে ওঠে। ঘুমিয়ে থাকলেও চমকে উঠে কান্না করে ফেলে।’

গাজার চিকিৎসকেরা বলছেন, অনেক তরুণী মা জানিয়েছেন যে তাঁরা অপুষ্টির কারণে তাঁদের শিশুদের বুকের দুধ পান করাতে পারছেন না।

সেখানে প্রধান সমস্যা এখন খাবার ও পরিষ্কার পানি।

সিওয়ারের জন্মের সময় নাজওয়া নিজেই অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। তিনি ও তাঁর মা রিম এখনো নিজেদের জন্য খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। আর প্রতিমুহূর্তে চলছে সেই সংগ্রাম।

নাজওয়া বলেন, ‘অতিরিক্ত দাম ও সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে আমরা দুধ বা ডায়াপারও জোগাড় করতে পারি না।’

ইসরায়েলি সামরিক সংস্থা কোগাট ২২ মে বলেছিল, গাজায় কোনো খাদ্যসংকট নেই।

তারা বলেছে, সম্প্রতি গাজায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিশুখাদ্য ও বেকারির জন্য ময়দা আনা হয়েছে। এই সংস্থা বারবার দাবি করেছে, হামাস ত্রাণ চুরি করে।

অন্যদিকে ইসরায়েলি সরকার বলছে, হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত এবং গাজায় জিম্মি ইসরায়েলিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের ২০ জন জীবিত এবং আরও ৩০ জনের বেশি মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গাজায় কোনো খাদ্যসংকট নেই বলে কোগাট যে মন্তব্য করেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্যসহ বহু বিদেশি সরকার।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও গাজায় মানুষ ‘অনাহারে’ আছে বলে মন্তব্য করেছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরায়েল গাজায় যে পরিমাণ ত্রাণ ঢুকতে দিয়েছে, সেখানকার চাহিদার তুলনায় ‘এক চা–চামচের’ সমান।

গুতেরেস বলেছেন, জ্বালানি, আশ্রয়, রান্নার গ্যাস এবং পানি বিশুদ্ধকরণ সামগ্রীর অভাবের মধ্যে ফিলিস্তিনিরা ‘সম্ভবত এই নিষ্ঠুর সংঘাতের সবচেয়ে নিষ্ঠুর পর্যায়’ পার করছে।

প্ল্যাটফর্ম/

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কঙ্কালসার শরীর নিয়ে বেঁচে আছে টাইফয়েডের সঠিক চিকিৎসা না করা বেলাল

Mon May 26 , 2025
সোমবার, ২৬ মে ২০২৫ চট্টগ্রাম এর অসহায় বেলাল। ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হলে অর্থের অভাবে করাতে পারেননি সঠিক চিকিৎসা। ফলে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় তার শরীরের মাংসপেশি, বেরিয়ে আসে কেবল হাড়! শরীরের এমন দুরবস্থায় কোনো কাজও করতে পারেন না তিনি। শৈশবেই বাবা ছেড়ে চলে যাওয়ায় আপন বলতে পাশে আছেন শুধু […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo