ইদ ও ইদের সালামির একাল – সেকাল

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫ মে ২০২০, সোমবার
ডা. মাহবুব মুতানাব্বি
সহযোগী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এর আগে লিখেছি, আমাদের ইফতারের আয়োজন ও খরচ, সবই ছিল হালকা। ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন দুই তিন হাজার টাকার পঞ্চাশ আইটেমের বুফেতে ঠেকেছে। একবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল অথবা সোনার গাঁ এ রকম এক দাওয়াতে গেলাম। এতো আইটেম দেখে অনেক প্ল্যান করলাম খাওয়ার। তবে প্রতিটাই এতো বিস্বাদ আর ঠান্ডা ছিল, স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগলো না। তবে অর্জন হল বলতে পারা, পাঁচতারায় ইফতার করে এসেছি।
একইভাবে আমাদের ছোটবেলায় ইদের তোহফা বা বখশিসের প্রচলনও ছিল হালকা। ইদি বা এইধরণের কোনো হাইব্রিড শব্দ তখন আমরা শুনি নি। সালাম বলতে সালাম করাই বুঝতাম। এর সাথে অর্থকড়ির কোনো যোগাযোগ জানা ছিল না। সালামি বলে কোনো শব্দ জানা ছিল না। বাড়িঘরের পজেশন নিতে সেলামী দিতে হয়, তা জানতাম। তো, সেই ইদের বখশিস কারা দিতেন? দাদা, নানা। ক্ষেত্রবিশেষে বাবা – মা। বাবা – মা কেন দিতেন না? তাঁরা তো কাপড়, জামা একটা কিছু দিতেনই। আবার আজাইরা টাকা দেয়ার মত আলগা পয়সা বেশির ভাগ বাবা -মার ছিল না। দু একজন ছিলেন। সামাজিকভাবে তাঁদের ঘৃণ্যদৃষ্টিতে দেখা হতো। আর দাদা নানারা কত দিতেন?
পকেটের কোণায় থাকা সিকি বা আধুলি। আস্ত টাকা তো আর উপহার হয় না।
এখন অবশ্য সালামি বা সেলামির সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। পিয়ন, দারোয়ান থেকে শালা শালী সবাইকেই দিতে হয়। প্রতি বছরই দেখি, ঈদের কিছুদিন আগে থেকে অফিসে ও একটু বেশি সালাম পাই। তাদের সালামি ও ন্যুনতম শতের ঘর থেকে শুরু হয়। শালা শালী পর্যন্ত যেতে যেতে হাজারের ঘরে পৌঁছে যায়। তবে কিছু কিছু সালামি ব্যতিক্রমী। বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থরা এ সময় টেলিফোনে কিছু সালাম পান। ভরাট গলার সে সালাম শুনলে বুক কেঁপে ওঠে। সে সালামি সংগ্রহ করতে আসে আপাতনিরীহ দর্শন শার্টের নীচে কোমরে ধাতব অস্ত্র গোঁজা স্বেচ্ছাসেবক। এই সালামি কমের পক্ষে ত্রিশ চল্লিশ হাজার থেকে শুরু হয়। খুশি না হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে হয়।

আবার রিভার্স সালামি ও আছে। অফিসের উমেদার, সাহেবদের ইদের খরচ দিতে হয়। আবার কিছু ছাত্রকেও সালামি দেন শিক্ষকরা। পারলে সালাম ও দেন। গতবার শুনে ছিলাম এক শিক্ষক ছাত্রদের ইদের সালামি দিতে চেয়েছিলেন দুই কোটি টাকা। কিন্তু ছাত্রদের মান-মর্যাদার হিসেবে এই অর্থ তিনভাগের একভাগও না হওয়ায় ভীষণ মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। এ তো গেল সালামির বিবর্তনের কথা। নানার সিকি থেকে শিক্ষকের দুই কোটি।

এবার আসি ইদের মার্কেটিংয়ের কথায়। ইদ যেহেতু উৎসব, সবাই নতুন একটা কিছু পেত। যার শার্ট কম, সে নতুন শার্ট। যার জুতা ছিঁড়ে গেছে নতুন জুতা। তবে তিনটা শার্ট থাকলে চারটা সাধারণত চিন্তা করা হতো না। গ্রামের বাচ্চাদের দেখেছি চারপয়সার রঙীন কাগজের টুপিতেই ঈদে অনেক খুশি। বাবা-মায়েরা বিভিন্ন দিক থেকে টাকা পয়সা যোগাড় করে ইদের শেষ সপ্তাহে শুরু করতেন কেনাকাটা। দর্জির দোকানে সেলাইয়ের খুব একটা সুযোগ থাকতো না। সাধারণ সেলাই, যেমন পায়জামা মা-খালারা বাসায়ই সেলাই করে ফেলতেন। ঢাকায় এসে দেখলাম চানরাত। সব কেনা থাকলে ও সারারাত ঘুরতে থাকে। সাধে কি আর শামসুর রাহমান বলেছেন, “এই মাতোয়ালা চানরাইতে!” তারপর দেখলাম, রোজার শেষে নয়, শুরুতেই শুরু হয়ে যায় ইদের মার্কেটিং। এরপর দেখলাম, রোজার ও একমাস আগে শুরু করে রোজার আগেই একদফা ঘরভরা শেষ। আর কারো কারো কেন জানি, বাংলাদেশের কোনো জিনিসই পছন্দ হয় না! ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছেন। সীমিত সম্পদের মধ্যবিত্তই বসে থাকবে কেন? সে ও দৌড়ায় কলকাতা। ব্যাংকের লোনের টাকা নিয়ে আলীমুদ্দীন স্ট্রিটে।

আগে ইদের দিন ছিল দুপুরে জব্বর আলীর বিশেষ নাটক আর রাতে আনন্দমেলা। সারা সপ্তাহ এগুলো নিয়ে চলতো আলোচনা। ডায়ালগ ঘুরতো মানুষের মুখে মুখে। জবা, কুসুম, রোকন, দোলনের মা যেন সবার ঘরের মানুষ। আর এখন ইদের সপ্তম দিন পর্যন্ত অসংখ্য অনুষ্ঠান করতেই হবে। শিল্পী গলাভাঙ্গা, ঠ্যাং ব্যাঁকা যাই হোক না কেন! এসব নাটকের কুশীলবদেরও কেউ চেনে না। ডায়ালগ ও কারো মনে থাকে না। ইদের কাপড়ের অবস্থা ও দাঁড়িয়েছে তাই। ইদের সপ্তম শাড়ি না দিতে পারলে জামাই পরীক্ষায় পাশ হলেও সংসারে ফেইল। আর মাসাককালি থেকে পাখি, নতুন নামে যে ড্রেস আসবে সেটা তো লাগবেই। এই মানসিক দৈন্য দোকানদারেরাও বোঝে। তাই এক একটা নতুন নাম দিয়ে ক্রেতাদের এক্সপ্লয়েট করে। এবার নাকি শোনা গিয়েছিল, ‘করোনা শাড়ি’ পাওয়া যাবে। বিরাট মিস! ইদটা ছিল ধর্মীয় উৎসব। এখন চলে এসেছে পেয়ার, মৌজ, মাস্তি। বিশাল আকারের সাউন্ডবক্স বসিয়ে হিন্দি গানের তালে না নাচলে কারো কারো তো ইদ জমেই না।
অথচ সেই সময়টা ছিল কত সহজ! সকালে উঠে সবাই ঝাঁপ দিয়ে পড়তো পুকুরে। ভালো করে গোসল করে একমাইল দূরের ঈদগায় হেঁটে হেঁটে যাওয়া। পুকুর পারের ঈদগায় সবাই বসে অপেক্ষা করতো, দূরে মাঠের আল ধরে কেউ আসছে কীনা। শেষ ব্যক্তিটি আসলে নামাজ শুরু। মাইক নেই। ইমাম নিচনপুরের মুনশি আস্তে তকবির বলতেন। পেছন থেকে বাজখাঁই গলায় পুনরাবৃত্তি করতেন আজাইরা (আজহার আলী) মুনশি। জোরালো আওয়াজে কারো কারো নিয়ত ছুটে যাওয়ার উপক্রম হতো। ফেরার সময় আবার সেই পথ হাঁটতে হাঁটতে ফেরা। দুপুরে আত্মীয় কারো বাড়ি যাওয়া বা রাস্তার বড় পুলের ওপর দাঁড়িয়ে হই চই করা। আদিগন্ত খোলা মাঠের বাতাস গায়ে মাখা।

এই তো ইদ!
অথচ এমন মজা মনে হয় পরে আর কখনো লাগে নি। ইদের মূল খাবারই ছিল সেমাই। বার বি কিউ দিয়ে ইদ ছিল কল্পনার বাইরে।

চাঁদ দেখা কমিটির ঝামেলাও ছিল না। সরাসরি চাঁদ দেখা গেলেই ইদ। পঁয়ষট্টির যুদ্ধকালীন সময়ে আইয়ুব খান গ্রামে গ্রামে দিলেন রেডিও। এবার লাগলো ঝামেলা। ঊনত্রিশে না ত্রিশে? এক রোজায় ত্রিশ তারিখ সকালে সবাই ঘুমের আড়মোড়া ভাঙছে। বড়মামা শহর থেকে গিয়ে বললেন, আজ ইদ। চাঁদ দেখা গেছে। গ্রামের মুরব্বিরা বসলেন বৈঠকে। অনেক তর্ক চললো। এরমাঝে কখন যেন বড় মুরুব্বি আমার বড়নানা ভিতরবাড়ি থেকে পান চাবাতে চাবাতে ঢুকলেন। হয়ে গেল সেদিনই ইদ!

কুমিল্লা এসে দেখলাম, ইদের চাঁদ দেখা গেলেই সাইরেন বাজায়। হই চই হয়। কেন্দ্রীয় ঈদগায় নামাজের আগে বন্দুকের গুলি ছোঁড়ে। তার মাঝে ও নানা গোলযোগ লেগে আছে। মুকাব্বিরের আওয়াজ শোনা যায় নি। এ নিয়ে শুরু হল হইচই। ডি সি সাহেব কিছু বলতে গেলে জুতা দেখালো জনতা। চাপে পড়ে দৌলতপুরের হুজুর পুনরায় নামাজ পড়াতে গেলে শুরু হল হাসাহাসি। তিনি নিয়ত ছেড়ে দিলেন। বুঝলাম, শহরের জামাত এতো সহজ নয়। পরে সরে গেলাম পুলিশ লাইনে। আইনশৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় গোলযোগ কম। সেখানে ইমাম আব্বার ঘনিষ্ঠ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব মাওলানা ফখরুদ্দিন সাহেব। বিরাট আলখাল্লা পরে দরাজ গলায় বলতেন, ‘একহি ছফমে খাড়া হ্যায় মাহমুদ আওর আয়াজ; না কোই বান্দা রাহে গা, না কোই বান্দা নওয়াজ।’

ঢাকায় থাকা অবস্থায় দেখলাম ইদ জামাত বায়তুল মোকাররম থেকে সরে চলে এসেছে হাইকোর্টের খোলা প্রান্তরে। সে থেকে রাষ্ট্রপতির সাথেই নামাজ আদায় করতাম। কিন্তু আমন্ত্রণ পেয়েও রাষ্ট্রীয় শুভেচ্ছা বিনিময়ে কখনো যাওয়ার আগ্রহ বোধ করি নি। এক মাইল দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটু মুচকি হাসি। এত কষ্টের অবশ্য একটা নেট রেজাল্ট হচ্ছে, ড্রইংরুমে বসে বলা গিয়ে আসলাম অমুকখানে। আমার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আমি এসব বলে বিমলানন্দ লাভ করতে দেখেছি।

Subha Jamil Subah

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় কবলিত মানুষের পাশে হৃৎস্পন্দন

Mon May 25 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ২৫ মে, ২০২০ সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় “আম্পান” কবলিত জনগোষ্ঠীকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল তরুণ ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থী দ্বারা পরিচালিত সামাজিক সংগঠন “হৃৎস্পন্দন”। দেশের সুন্দরবন ও সাতক্ষীরা সহ কয়েকটি জেলার উপর দিয়ে গত ২০শে মে রাতে বয়ে যায় প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এতে মানুষ তীব্র খাদ্যসঙ্কটে পড়েছে। সেনাবাহিনি ও […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo