অবশেষে তুমি.. – রুদ্র মেহেরাব

প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৫

” অবশেষে তুমি.. ”

লেখকঃ রুদ্র মেহেরাব
সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ

ঘটনা ১ঃ

মায়ার খুব মন খারাপ হচ্ছে। স্টার্নামের মতো একটা সহজ আইটেম সে পেন্ডিং খেয়েছে। গোটা ক্লাসে সে ই একমাত্র পেন্ডিং খাওয়া বান্দা! স্যার প্রচন্ড বকলেন। রাগ করে উঠে যেতে বললেন। আরেকটু হলে স্যারের সামনেই কেদে দিতো মায়া। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটাকালো। একদম পিছনের বেঞ্চটিতে গিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলো। হঠাৎ সাইলেন্ট করা ফোনটা কেপে উঠলো। মায়া ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করলো। বেঞ্চের নিচে নিয়ে আড়াল করলো-স্যার যেনো দেখতে না পায়। অর্নব ভাইয়া টেক্সট দিয়েছে। ছুটির পর ক্যান্টিনে থাকতে বলেছে। অর্নব ভাইয়া থার্ড ইয়ারে পড়ে। ফেইসবুকে পরিচয়। উনার প্র‍্যাকটিক্যাল খাতা করে দেবার কথা মায়ার। কাল রাতে বলেছিলো প্র‍্যাকটিকালের কিছু ছবি একে দিতে। সেজন্য হয়তো থাকতে বলেছে। ছুটির পর মায়া ক্যান্টিনে গিয়ে দেখলো অর্নব বসে আছে।
: স্লামুলাইকুম ভাইয়া – ছুটি হয়ে গেছে আপনার?
: হ্যা। এইতো হলো পাচ-দশ মিনিট আগে। তোমার আইটেমের কি হলো? ক্লিয়ার তো?
: না ভাইয়া। ক্লিয়ার হয়নি। সহজ সহজ জিনিস বলতে পারি নি। কি যে হলো স্যারের সামনে!
: ব্যাপার নাহ। প্রথম প্রথম এমনই হয়। পরে দেখবে যে ঠিক হয়ে গিয়েছে।
: হুম। জানিনাহ কি হবে।
: আচ্ছা শোনো তোমাকে কালকে রাতে প্র‍্যাকটিক্যালের কিছু ছবি একে দিতে বলেছিলাম না? এই নাও খাতা। বই দিয়ে দিচ্ছি। বই থেকে দেখে আকবা। পারবা না?
: হ্যা পারবো। দেখি একটু?
: হ্যা – শিউর!
: এহ বাবা! এ তো দেখছি দা – বল্লমের ছবি! এগুলা আকবো!
: হা হা হা। এগুলা ফরেনসিকের উইপনের ছবি। থার্ড ইয়ারে যখন উঠবা তখন তোমাদেরও আকতে হবে।
: কবে লাগবে আপনার?
: কাল পরশু হলেই হবে। পারবা না কম্পলিট করতে?
: হ্যা পারবো মনে হচ্ছে।
মায়া একপলক দেখে নিলো ছবি গুলো। দা,ছুরি, ডেগার, হাতুরি, দড়ি এসবের ছবি। মেডিকেলে এসে এগুলো কেনো পড়া লাগে তা এখনো তার মাথায় ঢুকছে না। সে প্র‍্যাকটিকাল খাতা আর বই গুছিয়ে নিলো।
: ভাইয়া – যাই তাহলে।
: লাঞ্চ করি একসাথে.?
: উমমম.. না আজকে না। অন্যদিন।
:আচ্ছা। ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ
:আল্লাহ হাফেজ।

হ্যা.. এভাবেই শুরু হয় তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব। অনেক অল্প সময়ে অনেক ভালো বন্ধু হয়ে যায় তারা। ফোন – হোয়াটসঅ্যাপ – মেসেঞ্জারে প্রতিদিনই কথা হতো তাদের। মাঝে মাঝেই মায়া অর্নবের কাছে গান শুনতে চাইতো। যদিও অর্নব একদমই গাইতে পারেনা। তবুও শুনাতো। রিকল ব্যান্ডের “নিঝুম রাতে” গানটা মায়ার খুব পছন্দ। বিকেলে লেইকপার ধরে হাটতো দুজন। সবুজ ঘাস – পানির উৎকট গন্ধ – হকারের চিৎকার – চা দোকানীর টুংটাং কাপের শব্দ – বিকেলের নরম
বাতাস ! মায়ার সাথে এভাবে হাটতে খুব ভালো লাগতো অর্নবের। মনে হতো বছরের পর বছর – দিনের পর দিন এভাবে হেটে যেতে পারবে সে। শুধু মায়া পাশে থাকলেই হবে। খুব ইচ্ছে করতো মায়ার হাত ধরতে। অনেকবার বলতে যেয়েও বলতে পারেনি। পাছে মায়া না আবার খারাপ ভাবে! সেই ভেবে। পাশাপাশি হাটতে হাটতে মায়ার হাত যখন অর্নবের হাতে লাগতো – কেমন যেনো কেপে উঠতো ওর শরীর। ইচ্ছে করতো এখনি অনুনয় করে বলে ফেলতে – প্লিজ তোমার হাতটা একটু ধরতে দাও। এক মিনিটের জন্যে হলেও দাও ! প্লিজ ! যখন বাতাসে মায়ার চুল এসে অর্নবের মুখে আছড়ে পড়তো – অর্নব ইচ্ছে করে সরাতো নাহ। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিতো। আলতো করে ছুয়ে দিতো মায়া যেনো টের না পায়। রিক্সায় যখন মায়া একটু গ্যাপ রেখে বসতো – অর্নবের খুব খারাপ লাগতো। মনে হতো কাছে পেয়েও যেনো পাচ্ছে না ! অর্নব কি তাহলে ভালোবেসে ফেলেছে মায়াকে ? নিশ্চয় ! তা না হলে মায়া ফোন না ধরলে – কল ওয়েটিং পেলে এতো খারাপ লাগবে কেনো তার.! এতো জেদ আসবে কেনো! আচ্ছা, মায়াকে কি এসব বলা উচিৎ? নাহ..! মোটেই নাহ..! ও যদি রাগ করে? যদি ভূল বুঝে? যদি কথা বলা বন্ধ করে দেয়.! নাহ.. নাহ..! এটা সম্ভব না..! মায়ার সাথে কথা না বলে একদিন ও থাকা যাবে না। কথা বলতে পারবেনা ভাবতেই কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসে অর্নবের। মায়াকে না দেখে সে একদিনও থাকতে পারবে না। স্রেফ মারা যাবে। এতো মায়া কেনো মেয়েটার চেহারায়? ইশ! এই মায়া যদি আগুন হতো তাহলে নির্ঘাত সারা দুনিয়া এক নিমিষেই পুড়ে যেতো।

মায়া ঢাকায় নতুন এসেছে। এর আগে কখনো সেভাবে থাকা হয়নি। এডমিশন টেস্টের সময় অবশ্য তিনমাস ফার্মগেটে থেকেছে। তাও সেটা ছিলো নামে মাত্র থাকা। বেশিরভাগ সময় ই বাসায় থাকতো। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে – বাসা ছাড়া আর কিছু বুঝে না। এখন অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে কিছুটা। অভ্যস্ত না হয়েও থাকার উপায় কই! প্রতিদিন আইটেম থাকে। সাথে কার্ড – টার্ম তো আছেই। দম ফেলবার ও ফুরসত নেই। মায়া হাতিরঝিলে যায় নি কখনো। টিভি তে দেখেছে। কি সুন্দর করে ব্রিজ বানানো, ফোয়ারা বসানো। ওয়াটার বাস নামে যে নৌকাগুলো চলে সেগুলোতেও সে চড়ে নি। অর্ণব একদিন নিয়ে গেলো তাকে ওয়াটার বাসে করে ঘুরতে। কিন্তু সেদিন এতো ভিড় ছিলো! শেষে টিকিট না পেয়ে ফেরত চলে আসতে হলো। তার কিছুদিন পর আবার গিয়েছিলো। সেদিন ঘটলো আরেক ঘটনা। নৌকায় উঠতে না উঠতেই প্রচন্ড বৃষ্টি। সেই সাথে বাতাস। নৌকা একপ্রকার দুলতে লাগলো। ছোট খুপরির মতো জানালাগুলো দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে মায়ার একপাশ ভিজিয়ে দিলো। নৌকা দুলতে থাকার সময় জোড়ে বাজ পড়তেই মায়া অর্নবের শার্ট খমচে ধরলো। ভয় পেয়ে গিয়েছে সে। সারাটা পথ সে এভাবেই শার্ট ধরে বসে রইলো। অর্নবের তখন কেমন জানি নিজেকে সুখি সুখি মনে হতে লাগলো। ইশ.! সারাজীবন যদি মায়া ওকে এভাবেই আগলে ধরে থাকতো! নৌকা থেকে নামতেই একটা ছোট পিচ্চি দৌড়ে এলো তাদের দিকে। হাতে বেলী ফুলের মালা। এক গাল হেসে মালা নেবার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো। অর্নব মায়াকে মালা কিনে দিলো। বাকীটা সময় মায়া সেটা হাতে পড়ে থাকলো। অর্নবের খুব ইচ্ছে হচ্ছিলে নিজে হাতে পড়িয়ে দিতে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারেনি।

ফুচকা আর ভেলপুরি মায়ার খুব পছন্দ। প্রায় বিকেলেই পিংক সিটিতে ফুচকা খেতে যেতো তারা। তবে সংসদ ভবনের সামনের ফুচকা নাকি মায়ার বেশি ভালো লাগে। প্রায়ই ফুচকা খাওয়ার সময় এই কথা বলতো ও। অর্ণব অবশ্য ঐ দিকে যাওয়ার কথা বললে মায়া কেনো জানি রাজি হতো না। কলেজের সামনে একটা ভেলপুরি মামা বসে। মায়া সেই মামার ভেলপুরি খেতো নাহ। মামার টকে নাকি ঝাল নেই। ১৩ নাম্বার রোডের মাথায় অন্য আরেকজন মামা বসেন। কলেজ শেষে সেই মামার কাছ থেকে ভেলপুরি খাওয়া ছিলো ওর প্রতিদিনকার রুটিনের মতো।

এভাবেই চলতে থাকে মায়া আর অর্নবের বন্ধুত্ব। অর্নব ক্রমেই মায়ার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়তে থাকে। মায়ার সাথে কথা না বললে – বিকেলে একসাথে লেইকপাড় ধরে হাটতে বের নাহ হলে – একসাথে চা না খেলে ওর কোন কিছুই ভালো লাগতো না। অর্নব অনেকবার চেষ্টা করেছে মায়াকে সবকিছু বলে দিতে। কিন্তু মায়া কি না কি ভাববে সেই ভেবে সাহস করে উঠতে পারেনি। মায়াও অবশ্য যথেষ্ট কেয়ার নিতো অর্নবের। ব্যাপারটা অর্নবের খুব ভালো লাগতো। যদিও মুখে কিছু বলতো না। তবু ও। সকাল বেলার “গুড মর্নিং ” লিখা ছোট খুদে বার্তা, রাতের “গুড নাইট” – মন জুড়িয়ে দিতো ওর। আর কোনদিন যদি মায়া খুদে বার্তা পাঠাতে ভূলে যেতো রাজ্যের অভিমান এসে ভর করতো অর্নবের মনে।
একদিন মায়া অর্নবকে মোবাইলে একটা ছবি দেখিয়ে বললো –
:আচ্ছা ছেলেটা দেখতে কেমন?
: হ্যা – ভালোই তো..কে এটা?
অর্নব একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভালো করে দেখে বললো।
: হাসিব। আমাকে খুব ভালোবাসে।
মায়া জবাব দিলো।
অর্নবের মনে হতে লাগলো আকাশটা এখনি
ভেঙে পড়বে। মায়া এসব কি বলছে! আগে তো কখনো বলেনি.! বুকের ভেতরটা কেমন যেনো ধড়ফড় করে উঠলো।
: তুমি ও কি ভালোবাসো?
অর্নব অনেক কষ্টে কোন মতে প্রশ্নটা করলো।
: হ্যা – তবে মনে মনে। একচুয়্যালি আমরা দু’জন ই দুজন কে পছন্দ করি। কিন্তু কেউ কাউকে বলি নি। ঠিক পছন্দ ও বলা যাবে না। তারচেয়ে বেশি হয়তো। মায়া একগাল হেসে উত্তর দিলো। মায়া তখনো জানতো না যে অর্নব ও মনে মনে তাকেই চায়।

কথাগুলো শুনে অর্নবের গলা শুকিয়ে গেলো। পায়ের নিচের মাটি মনে হয় সরে গিয়েছে। নয়তো নিজেকে এমন ওজনহীন মনে হচ্ছে কেনো! মাথাটা ভারী হয়ে গিয়েছে হঠাৎ। বুকের ভেতর টা এমন মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে কেনো বারবার ? অর্নবের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পাশেই বসে থাকা মায়ার চেহারাও সে ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে না। জল গড়িয়ে পড়বে এখনি। মায়া ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই অর্নব উঠে পড়লো। মায়া স্তম্ভিত হয়ে গেলো অর্নবের এররকম কান্ড দেখে। সে রীতিমত অবাক ! পিছন থেকে অনেক ডাকা ডাকি করলো মায়া। অর্নব যেনো তার কিছুই শুনতে পেলো না। এই ঘটনার পর অনেকদিন অর্নবের কোন খোজ ছিলো না। না তাকে কলেজে পাওয়া যেতো – না বন্ধুদের আড্ডায়। মায়া অবশ্য সবকিছু বুঝতে পেরে অনেকবার অর্নবের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু অর্নবের ই কোন হদিস ছিলো না। মায়ার খুব কষ্ট হতে লাগলো অর্নবের জন্য। ধূর..! মেয়েদের নাকি তীব্র সিক্স সেন্স থাকে। সে কেন তাহলে আগে থেকেই ব্যাপারটা বুঝলো নাহ..! কিন্তু হাসিব? হাসিবে কে সে কি বলবে? এতোদিনের সম্পর্ক সে কিভাবে ছেড়ে আসবে? নাহ । হাসিব কে কষ্ট দেয়া মায়ার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না।

ঘটনা ২ঃ

আমরা এখন চলে যাবো এই ঘটনাটির ঠিক ৫ বছর পরের কোন এক দিনে। দিনটি ছিলো অন্যসব দিনের মতোই। তবে অর্নবের জন্য নিশ্চয় সেটা সাধারন দিন ছিলো না। সে দাঁড়িয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ভিতরেই চলছে মায়ার সিজারিয়ান সেকশন। বাবা হতে চলেছে অর্নব। ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবার সাহস করেত পারেনি সে। প্রিয়মানুষগুলোকে নিশ্চয়ই চোখের সামনে ডাক্তারি ছুরি-কাচির নিচে দেখতে পছন্দ করবে না কেউ! প্রচুর ঘমছে সে। পাশেই আম্মা জায়ানামজে বসে তসবি জপছে। আব্বা চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে আছে।। মনে মনে যত দোয়া দুরুদ জানে সেও পড়তে লাগলো। ঠিক তখনি দুজন নার্সকে হাসি মুখে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ফুটফুটে একটি বাচ্চা তাদের কোলে।
: মিষ্টি নিয়ে আসেন স্যার ! ছেলে বাবু হয়েছে।

অর্নব হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিলো। কি নিষ্পাপ একটি মুখ ! ঠিক যেনো সদ্য ফোটা কোন এক গোলাপফুল। পিটপিট করে তাকাচ্ছে অর্নবের দিকে। খুশিতে অর্নবের চোখে জল চলে আসলো। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটি মায়া তাকে আজকে দিয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

গরু - ডাঃ মোঃ বেলায়েত হোসেন

Mon Sep 3 , 2018
প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১২ ” গরু “ লেখকঃ ডাঃ মোঃ বেলায়েত হোসেন শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ ——- বিকাল চারটা।ইমার্জেন্সী রুমে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি।একই সাথে দুইটা খারাপ রোগী এসেছে।একজন রিক্সা থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়েছে,আরেকজন স্ট্রোক করেছেন খুব সম্ভবত।কোন দিকে তাকাবার ফুরসত নেই।এমন সময় বাইরে শুনি হট্টগোল।বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo