লাইফ ইন লকডাউন, ডে সিক্সটি ওয়ান

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৭ জুন ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

একজন সরকারি ডাক্তার। একত্রিশ মে কোয়ারেন্টাইন এর আগে শেষ ডিউটি করলো। ডিউটি করে স্যাম্পল দিলো। রিপোর্ট পজিটিভ আসলো পাঁচ জুন। সে প্র‍্যাগনেন্ট। আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম অনাগত অতিথিকে নিয়ে। আজ ছয় তারিখ তার বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সে ফেসবুকের একটি গ্রুপে পোস্ট দিলো কোনোভাবে ঢাকা নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। কোভিড সাসপেক্টেড, পেন্ডিং রিপোর্ট। কেউ কেউ কমেন্টে ‘ফি আমান-লিল্লাহ ‘ লিখলো, কেউ লিখলো ‘মে গড হেল্প ইউ’, কেউ কেউ স্যাড সাইন দিলো। আমি একান্ন নম্বর স্যাড সাইনটি দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের ইন্টার্নাল ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সে সংবাদটি দিলো। তার বাবা আর নেই।

দেখলাম কেউ কেউ লিখেছে ‘ইন্না-লিল্লাহ হি ওয়া ইন্না ইলাহির রাজিওন’, আমি আবার চতুর্থ স্যাড সাইনটি দিতে গেলাম। হাত কেঁপে উঠলো। ছয়দিন পর রিপোর্ট, একটি সিট, একটি ভেন্টিলেটর মেশিন- শোক প্রকাশ করতে দেয় নি। আমরা কত ভাগ্যবান জানেন- এই যে মৃত্যুটা হলো সেখানে সার্টিফিকেটে কজ অফ ডেথে সিভিডি বা বড়জোড় এক ভাইরাসের নাম লেখা থাকবে। থাকবে না লেখা ‘তার মেয়ে ডাক্তার’, থাকবে না লেখা ‘সরকারি বেতনে আমরা আলাদা আলাদা পাঁচরুমের বাসা নিতে পারি নি’, থাকবে না লেখা ‘ভাইরাসটি আমরা হাসপাতাল থেকে ফুসফুসে বয়ে বাড়িতে নিয়ে গেছিলাম’।

আমি এখন একা বাসায় অপেক্ষা করি- পারসিস্টেন্ট ফিভার, সোর থ্রোট, কাশির। স্যাম্পল দিব রিপোর্ট আসবে না। অসুস্থতা লুকিয়ে রাখব। ভাড়া বাসায় থাকি- কখন কে কি বলে! যদি তুলে দেয়? তারপর একদিন শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। কাছের যে হাসপাতাল সেখানে আইসিইউ সাপোর্ট নেই। ওখানে থাকা আর বাসায় থাকা একই কথা। চেষ্টা করব আইসিইউ ওয়ালা কোনো হাসপাতালে যেতে। ওরা বলবে ‘তুমি যে করোনা রোগী তার প্রমাণ দাও’, অন্যরা বলবে ‘তুমি যে করোনা রোগী নও তার প্রমাণ দাও’। আমি হেল্পলাইম নাম্বারে ফোন দিব, কনস্ট্যান্ট বিজি পাব। ততক্ষণে আমার শ্বাসকষ্ট বাড়বে। আমি কোনো সরকারি হাসপাতালের লাইনে দাঁড়াবো। জ্বর বাড়তে বাড়তে ১০২ ছাড়াবে। ফেসবুকে পোস্ট দিব। মানুষ লাইক দিবে, স্যাড সাইন দিবে, প্রার্থনা সূচক কমেন্ট দিবে, মূল্যবান পরামর্শ দিবে। আমি নিরুপায় হয়ে খুব খরুচে কোনো বেসরকারি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। একসময় রাস্তায় ঢলে পড়বো। আমার আপাত কেয়ারটেকার দ্রুত কোনো নিকটস্থ ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবে। সেখানে ডাক্তার পাত্তা দিবে না। ‘এতো কম বয়সে স্ট্রোক হয় না…’। সে কাতরকণ্ঠে রিকোয়েস্ট করবে। তিনি তখন দেখবেন, বলবেন ”বড্ড দেরী করে ফেলেছেন, হি ইজ অলরেডি ডেড”।

মানুষ মরে গেলে তার আত্মা কী সাথে সাথেই ফানুসের মতো উড়ে যায়? আমি কিন্তু যাব না; দাঁড়িয়ে থাকবো। ভূতেরা কোনো প্রতিশোধ নিতে আসে না। উত্তর শুনতে আসে, শুধু নিষ্পলক চেয়ে থাকতে আসে। সরাসরি কারো আত্মার দিকে চেয়ে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করে না, যোগাযোগও করে না।

আমাদের গল্প গুলো একান্তই আমাদের। মনখারাপ-হতাশা-হেরে যাওয়ার গল্প। এগুলো শেয়ার হয় না।

মানুষ যত বয়স্কই হোক যখন জোনাকি পোকা দেখে একদম তার শৈশবে ফিরে যায়। এ সময়ে সন্ধ্যা নামার পর বড় গাছের নিচে জোনাকি পোকাদের মেলা বসতো। এটি তাদের মিলনের সময়। একদম শান্ত প্রকৃতি দূরে কোথাও ঝড়ের ইঙ্গিত দেয়। শহুরে আলোকিত সভ্যতায় জোনাকিরাও আজ পথভ্রষ্ট। নিজেরা নিজেদের আলো চিনতে পারে না।

আমরা যেন দৌড়ুচ্ছি। প্রচন্ড জোরে। পিছনে পড়ে যাচ্ছে মৃত্যুর রেকর্ড, নিষ্ঠুর গল্প, অভিমানের কান্না। আজ রাত্রিতে ভোরের দিকে ঝড় হবে। অপেক্ষা বর্ষণের।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ এ মৃত্যুবরণ করলেন স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক

Sun Jun 7 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, রবিবার, ৭ জুন, ২০২০ করোনা মহামারীতে শহীদ হলেন আরেকজন চিকিৎসক। এবার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন ডা. মীর্জা নাজিম উদ্দিন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক- মেডিকেল সার্ভিসেস ছিলেন ডা. মীর্জা নাজিম উদ্দিন। মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩০ তম ব্যাচের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo