যে ভাবে বুঝবেন খবরটি ভুয়া!

লিখেছেন ঃ ডাঃ মোঃ মারুফুর রহমান অপু, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক

ব্যাপারটা নতুন না তবে ইদানিং অনেক বেশি দেখছি। দুদিন পরপর চমকপ্রদ আকর্ষণীয় শিরোনামে নিত্য নতুন তথ্য বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিষয় টোটকা নিউজফিডে দেখতে পাই যেগুলো ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চা বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জড়িত নয় এমন মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত প্রফেশনালরাও শেয়ার করেন! ডাক্তারেরা যখন এইসব ভুয়া টোটকার ফাদে পা দেন এবং শেয়ার করে সেটা দেখতো তো খারাপ লাগেই, এর ফলাফল ও ভয়ংকর হতে পারে। সুতরাং আসুন নিজে ও অন্যকে বাচানোর স্বার্থে জেনে নেই কিভাবে বুঝতে আপনার সামনে আসা তথ্যটি গুজব নাকি সত্য!

ধাপ-১ঃ সোর্স
সন্দেহ জিনিসটা ভালো না,, তবে এই ক্ষেত্রে খুব কাজের এবং এটাই প্রথম ধাপ। আপনার তথ্যটা কোথা থেকে পেয়েছেন সেটি আগে দেখুন। হতে পারে কারো কাছে শুনেছেন বা কোন মিডিয়াতে কাউকে বলতে দেখেছেন, ঘটনা যদি এমন হয় তাহলে নিশ্চিত হয়ে নিন যিনি তথ্যটি দিচ্ছেন তিনি এই তথ্য দেবার জন্য অথোরাইজড কিনা অর্থাৎ সেই তথ্যটি সম্পর্কে বলার মত যোগ্যতা তিনি রাখেন কিনা। যেমন একটি উদাহরন দেই, ধরে নেই কোন এক দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী যিনি ডাক্তার নন তিনি সংবাদ সম্মেলনে বললেন আমরা ক্যান্সারের টিকা আবিষ্কার করেছি বা এ ধরনের চমকপ্রদ কিছু। এক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই তাকে সন্দেহ করবেন এমনকি তিনি যদি ডাক্তার হতেন তাও! কারন ক্যান্সারের টিকা আবিষ্কার করেছি এ কথাটি প্রথমে বলবে যে কর্তৃপক্ষ এটা আবিষ্কার তারা কিংবা মন্ত্রী ও বলতে পারেন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে। এতো গেলো কারো মুখের কথা। এবার আপনি যদি অনলাইনে তথ্য পান, সেটা মেইলে হতে পারে, সেক্ষেত্রে দেখুন মেইল এর সোর্স কি, যারা পাঠিয়েছে তারা এই মেইল পাঠানোর যোগ্য অথরিটি কিনা, যদি দেখতে যোগ্য অথরিটি মনে হয় (যেমন abcd@cancerresearch,gov.bd) সেক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনি তাদের কাছ থেকে মেইল পাবার জন্য সাবস্ক্রাইব করেছিলেন কিনা, না করে থাকলে এটি আপনার কাছে আসার কথা না সেক্ষেত্রে এই ইমেইল এড্রেস ফেইক হবার সম্ভাবনা অনেক, ইমেল এড্রেস এর প্যাটার্ন দেখলেও অনেক সময় বোঝা যায় এটা ফেইক। এবার ধরুন যদি এটা ফেইসবুক বা টুইটারে কোন অনলাইন নিউজ লিঙ্ক হিসেবে পান সেক্ষেত্রে দেখে নিন অনলাইন নিউজ লিংকটি কোন পরিচিত স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান এর কিনা (যেমন bbc, guardian, NYtimes কিংবা prothom-alo, bdnews, bbc bangla) যদি তা না হয় তাহলে অবশ্যই সন্দেহ করুন! এমনকি bbc bangla ও ভুল তথ্য দিতে পারে! লিংক ছাড়া আপনি কোন ফেসবুক পেইজ থেকেও তথ্য পেতে পারে, সেক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, তারা যে তথ্যটি দিচ্ছে সেটার সূত্র বা রেফারেন্স আছে কিনা, থাকলে সেই রেফারেন্স কোন স্বীকৃত অথোরিটি থেকে এসেছে কিনা এগুলোর কোনটি না হলে অবশ্যই সন্দেহ করুন। তথ্য ছবি হিসেবেও পেতে পারেন, সেক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অনেক সময় রেফারেন্স হিসেবে এভাবে লেখা থাকতে পারে চীনের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ অমুক বলেছেন। সেক্ষেত্রেও সন্দেহ করুন, সন্দেহের পর কি করবেন সেটা বলছি। এগুলো ছাড়াও মিথ্যা তথ্যগুলো সাধারনত চমকপ্রদ শিরোনামের পাশাপাশি শেয়ার করার অনুরোধ থাকে, দ্রুত শেয়ার করে জানিয়ে দিন, বা শেয়ার করে অশেষ নেকি হাসিল করুন ইত্যাদি ধরনের। মেইল এর ক্ষেত্রে মেইল ফরোয়ার্ড করার রিকয়েস্ট থাকে। অনেক সসময় ব্যাক্তিগত তথ্য চাওয়া হয় বা অপরিচিত ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে বলা হয়, ফ্রি তে অনেক মূল্যবান গিফট দিচ্ছেন এমন প্রলোভবন দেখানো হয়। এগুলো দেখেও সন্দেহ করতে পারেন।

ধাপ-২ঃ ঘাটাঘাটি
সন্দেহের পরের ধাপ, সন্দেহ দূর করা। এবার যেসব কারনে সন্দেহ করেছেন সেটি আগে আইডেন্টিফাই করুন। এবার দেখুন তথ্যটি আপনার পেশা বা পড়াশোনা সম্পর্কিত কিনা, সেক্ষেত্রে আপনি স্ট্যান্ডার্ড টেক্সটবুক বা আপনার শিক্ষকদের কথায় এমন কোন তথ্য পেয়েছিলেন কিনা খেয়াল করুন, যা বলা আছে সেটি আপনার জানা তথ্যের সাথে কতটুকু মেলে সেটা খুজুন। এই ধাপেই অনেক ভুয়া তথ্য ধরে ফেলতে পারবেন। না পারলে আপনার জন্য আছে ভুয়া ও সত্য তথ্যের বিশাল ভান্ডার ইন্টারনেট। যে তথ্যটি পেয়েছেন সেই তথ্যটির মূল কথাটুকু কপি করে গুগলে সার্চ করুন। সার্চের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বুদ্ধি এপ্লাই করতে পারেন যেমন, বেশিরভাগ তথ্য হয় অমুক করলে তমুক হবে বা অমুক না করলে তমুক হবে বা হবেনা। এক্ষেত্রে যেদুটো কে cause and effect হিসেবে দেখানো হচ্ছে সেটিকে এভাবে লিখুন, relation of “অমুক” with “তমুক”, গুগল সার্চের ক্ষেত্রে গুগল স্কলারে আলাদা করে সার্চ করতে পারেন, এক্ষেত্রে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পিয়ার রিভিউড জার্নাল ও টেক্সটবুক থেকে সে তথ্য বের করে দেবে। আরেকটি কাজ করতে পারেন, মূল কথাটি লিখে এরপর hoax/myth/fake/scam এই শব্দগুলো ব্যবহার করে দেখতে পারেন, যেমনঃ finger prick and stroke prevention hoax. সরাসরি গুগলে সার্চ না করে জনপ্রিয় কিছু ফেইক তথ্য বের করার ওয়েবসাইট বের করতে পারেন যেমনঃ
snopes.com, urbanlegends.about.com, breakthechain.org, truthorfiction.com,sophos.com/security/hoaxes/, hoax-slayer.com, vmyths.com, symantec.com/…/security_res…/threatexplorer/risks/hoaxes.jsp, hoaxbusters.org,virusbusters.itcs.umich.edu/hoaxes.html ইত্যাদি।

এছাড়াও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যের ভেরিফিকেশন এর জন্য জন্য pubmed, nature, ইত্যাদি ছাড়াও, বিভিন্ন দেশের পাবলিক হেলথ ওয়েবসাইট cdc.gov, quackwatch.com,virusmyth.com,

তথ্যগুলো যদি ছবি হিসেবে আসে বা কোন ছবি দিয়ে সেটার রেফারেন্স ধরে তথ্য দেয়া হয় সেক্ষেত্রে গুগলের চমতৎকার একটি অপশন আছে ইমেজ সার্চ। google image search এ গিয়ে ছবিটি আপলোড করে দিলে বা ছবির লিংকটি দিয়ে দিলে গুুগল আপনাকে ঐ ছবির সব ইতিহাস পাতিহাস খুজে বের করে দেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ইউডিউব ভিডিওর ক্ষেত্রে আছে ইউটিউব ডাটা ভিউয়ার (http://www.amnestyusa.org/citizenevidence/) সন্দেহজনক ভিডিওটির URL এখানে দিলে সে আলাদা আলাদা থাম্বনেইল করে দেবে এবং সেখান থেকে আপনি আবার সার্চ দিয়ে একই ভিডিওর কয়েকটি ভার্সন বের করতে পারবেন, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে পুরোনো কিংবা নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স এর ভিডিওটিকে বিশ্বাস করতে পারেন। অনেক সময় ছবিয়ার মালিকানা বা কোথায় কে কিভাববে তুললো সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে সেক্ষেত্রে EXIF ডাটা সার্চ করা যায় http://www.regex.info/exif.cgiএই লিংক থেকে। এক্ষেত্রে ছবির URL দিয়ে দিলে ছবিটি তোলা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যেতে পারে। কোন ছবি ফটোশপ করে বা কেটে বা জোড়া লাগিয়ে ব্যাবহার করা হয়েছে কিনা সেটা জেনে নিতে পারেন http://www.fotoforensics.com/ থেকে। কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানের আবহাওয়াগত তথ্যের সত্যতা জানতে সাহায্য করবেhttp://www.wolframalpha.com/ আর কোন স্থানের ম্যাপ বা এ বিষয়ক তথ্যের ভেরিফিকেশন এর জন্য google street view, google earth এবং wikimapia তো আছেই!

উপরের এত কিছু যদি করতে মনে না চায় তাহলে একটা সহজ ব্যাপার আছে সেটা হল “বড় ভাই” থিওরি! তথ্যটি সংশ্লিষ্ট একাডেমিক কোন বড়ভাই, বন্ধু বা স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন যার কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে বলে আপনি বিশ্বাস করেন। তবে এসব ক্ষেত্রে বার বার জিজ্ঞেস করাতে অনেকেই বিরক্ত হতে পারে বা তারা ব্যাস্ত থাকতে পারে।

ধাপ-৩ঃ একশন
তো এখন যেহেতু বের করেই ফেলেছেন তথ্যটি গুজব নাকি সত্য একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার কর্তব্য আপনার পরিশ্রমের ফলাফল সবাইকে জানানো। অর্থাৎ তথ্যটি যে ভুল এবং এটি প্রচার করলে মানুষের ক্ষতি হতে পারে সেটি জানিয়েই কিন্তু আপনি নিজে অনেক মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। গুজব থেকে দূরে থাকুন, নিজে বাচুন, অন্যকেও বাচান।

বিঃদ্রঃ যে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেখে এই পোস্ট লেখা সেটি হল ইদানিং আমার নিউজফিডে অনেকের শেয়ার করা লিঙ্ক থেকে দেখতে পাচ্ছি স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর তাতক্ষনিক দশ আঙ্গুল ফুটো করে রক্ত বের হতে দিলে নাকি রোগীর বেচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে! শিরোনামটা অনেকটা এরকম “এই তথ্যটা আগে জানলে আমার বাবা বেচে থাকতেন” বা এ ধরনের কিছু। এটি একোটি ভয়াবহ ভুয়া তথ্য এবং আক্রান্ত রোগীকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে এই কাজ করতে গেলে রোগীর মারাত্নক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে (বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই লিংকে দেখুনঃ http://www.hoax-slayer.com/needle-stroke.shtml)

এরকম আরেকটি বিভ্রান্তিকর তথ্য হচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর হার্ট এটাকের সময় জিহ্বার নিচে মরিচের গুড়া দিলে হৃদরোগ থেকে বেচে যেতে পারে। এটিও ভুল তবে কিছু গবেষনায় মরিচের সামান্য কিছু উপকারীতা পাওয়া গেছে তবে অবশ্যই সেটি ৬০ সেকেন্ডে ভালো করে এমন কিছু নয় এবং গবেষনা ইদূরের ত্বকের উপরে করা যার কোন ফলোয়াপ করা হয়নি। বিস্তারিত (http://thesurvivaldoctor.com/…/23/cayenne-pepper-heart-att…/)

ডাক্তার ও মেডিকেল স্টুডেন্টদের অনুরোধ করছি আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যেকোন পদ্ধতি কাজ করে সেটি বলার আগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ৪টি ফেইজ পার করে আসতে হয়, ল্যাবে, এরপর প্রাণীর উপর এরপর ভলান্টিয়ারদের উপর এরপর রোগীদের উপর এরপর পোস্ট মার্কেট সার্ভিলেন্স তো আছেই এবং এগুলো সবই প্রকাশিত আন্তর্জাতিক জার্নালে পাওয়া যায় কিংবা আপনার টেক্সবুকে আছে, সুতরাং এগুলোর বাইরে কিছু দেখলে লাফ দিয়ে শেয়ার না করে আগে একটু খুজে নিন যে ব্যাপারটা সত্য কিনা নাহলে আপনার শেয়ার করা বিভ্রান্তিকর তথ্য কারো মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

 

Ishrat Jahan Mouri

Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

অনুষ্ঠিত হলো "ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের রোযায় করণীয়” বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে মত বিনিময় সভা

Sat Jun 4 , 2016
আর কিছুদিন পরেই শুরু হতে যাচ্ছে রোজা। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা আত্মশুদ্ধির জন্য পুরো বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই রমজান মাসটির জন্য। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিবছর রমজানে প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখে। আমাদের দেশে প্রতি ১০০ জনের মাঝে ৮ জন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত যাদের অধিকাংশই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo