ম্যাডাম যখন মায়ের মত মমতাময়ী

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১১ মে, ২০২০, সোমবার

ক্লাসশেষে একদিন আউটডোর থেকে বেরোচ্ছি, ঘড়ির কাঁটা তখন দুইটা পেরিয়ে। হাসপাতাল গেইটে দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। স্টার্ট নেয়া শুভ্র সাদা প্রাইভেটকার থেকে ডাক এলো। সেদিক গিয়ে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময়ের প্রাক্কালে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি?

-জ্বি ম্যাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
-পড়াশুনা কেমন চলছে?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তবে ম্যাম ফোর্থ ইয়ারের শুরুর দিকে তো, একটু চাপ বেশী।
-হ্যা চাপ তো হবেই, বড় হচ্ছো, ডাক্তার হবে। তখন কত চাপ নিতে হবে। এখন এসবে অভ্যাস করে নাও।
-জ্বি ম্যাম।
-আচ্ছা খাওয়া দাওয়া কেমন করো?
-ম্যাম খাই তো। তবে হোস্টেলের খাবার আর কি!
-শুনো বাহিরের খাবার কম খাবে। এখন চাপ লাগে বেশী, তাই বেশী পুষ্টি প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খাবে। প্রতিদিন দুধ খাবে। ডিম-সিদ্ধ, ফলমূল বিশেষত কলা, পেয়ারা সিজনাল ফলগুলো বেশী করে খাবে।
-আচ্ছা ম্যাম। ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করবো। দু’য়া করবেন।

আরেকদিনের ঘটনা, বাৎসরিক কলেজ পিকনিকে গিয়েছি সাফারী পার্কে। খাওয়া-দাওয়ার পর্বে সবাইকে খাওয়ানো হচ্ছে। আমরা কয়েকজন খাবার পরিবেশন শেষে সবাই চলে গেলে খেতে বসেছি। দুপুরের ভ্যাপসা গরম। দেখি হিমেল পরশ বুলাতে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্যে গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছেন ম্যাম। সেদিনকার ঘটনায় চোখ টলমল করছিলো। কতটুকু ভালোবাসা থাকলে এতটা কাছে টেনে নিতে পারে!

তথাকথিত মা দিবসের প্রাক্কালে স্মরণ হচ্ছিলো সেই মমতাময়ী ম্যাম, দ্বিতীয় মায়ের কথা। তাই কি বোর্ডের পাতায় স্মৃতিতে চড়িয়ে থাকুক বলেই লিখছি।

যে মা কে নিয়ে কথা হচ্ছিলো তিনি আর কেউ নন, আমাদের কানিজ ম্যাম।

প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা ম্যাম। কিংবদন্তিতূল্য এই শিক্ষকের সান্নিধ্য অনেক মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাই পেয়েছে। তন্মধ্যে খাজাঁ ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন সৌভাগ্যবান অনেকেই আছেন।

কথায় আছে, জীবনের ষোল-কলা নাকি পূর্ণ হয় না। আর সবার মাঝে সবগুণ থাকে না। কিন্তু কানিজ ম্যামকে দেখলে মনে হয় সর্বেসর্বা, সর্বগুণী। ম্যামের পড়ানোর স্টাইল অন্য সবার চেয়ে ব্যতিক্রমী, কিন্তু সবচেয়ে লাভজনক। গৎবাধা সিস্টেমের মত স্লাইড না পড়িয়ে ম্যাম ফিজিওলজির মেইন বই “গাইটন” ছোটবাচ্চাদের মত ধরে ধরে, দাগিয়ে দাগিয়ে পড়ান। ম্যাম দীর্ঘক্ষণ ক্লাসে বুঝিয়ে বুঝিয়ে যেভাবে পড়ান, সেটাই আমাদের পরবর্তীকালের বিভিন্ন জটিল মেকানিজম পড়তে খুব সহায়তা করে। একজন শিক্ষার্থীও যদি একলাইন পড়া বাকি থাকে তবে ম্যাম সেটা পূর্ণ না করে আগান না। কার্ড, টার্ম পরীক্ষার ভাইবাতে ম্যাম খুব কড়া হলেও, প্রফের ভাইবাতে ম্যামের সহায়তার গল্প সবার মুখে ফুটে। আর প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীকে ম্যাম যেভাবে উৎসাহ দেন সত্যিই তা অতুলনীয়।

একজন ভালো শিক্ষকই নন, একজন ভালো মনের মানুষই ম্যামকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। পৃথিবীর যে কেউ ম্যামের বাচনভঙ্গি দেখে বিমোহিত হবেন।স্পষ্ট ভাষায়, প্রাঞ্জল সুন্দর উপস্থাপনা আর জ্ঞানের সমাহার সব মিলিয়ে অন্নপূর্ণা। ম্যামের মত জ্ঞানী মহিলা খুব কমই দেখা যায় এ জামানায়। যেমন মেডিকেলীয় সিলেবাসের জ্ঞান তেমনি ইহকালীন পরকালীন জ্ঞান।

এতকিছু ছাঁপিয়ে ম্যামের যে গুণটি ম্যামকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তা উনার দ্বীনদারিতায়। ডাক্তারদের মাঝে এত দ্বীনদারী আমি দেখিনি। আপাদমস্তক পর্দায় ঢাকা থাকলেও ম্যামের স্মার্টনেসের ধারে কাছেও কাউকে পাওয়া যাবে বলে জানা নেই! বর্তমান জামানার ফ্যাশনেবল হিজাবী নয়, প্রকৃত রাসূলের(সা.) সুন্নাতের পাবন্দীওয়ালী।

আর ম্যামের একটি অভ্যাস খুবই বিরল সেটা হলো প্রতিটি কথার ফাঁকে ফাঁকে “আল্লাহ মাফ করুক”, এই কথাটা বলা। এমনকি একলাইন পড়িয়ে এই কথাটি বলা যেন ম্যামের নিঃশ্বাসে মিশে আছে। ঢাকায় ম্যামের বাসায় আসা-যাওয়ার পূর্ণ সময়টাতে ম্যাম কুরআন তিলাওয়াত করেন। সবমিলিয়ে দ্বীনি পরহেজগারিতা, সুন্নাতের পাবন্দী, অমায়িক ব্যবহার, নীতিতে অটল, সাহায্যকারী মহিয়সী এই নারীটির গুণগুলো উনাকে ম্যাম থেকে “দ্বিতীয় মা” এর আসনে অধিষ্ঠিত করেছে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর হৃদয়ে।

মহীয়সী এই মা সকলের আদর্শ হোক। অধঃপতনের যুগের নারীরা শিক্ষা নিক যে, দ্বীন পালন কখনোই দুনিয়াবি সফলতার বাধাঁ নয়, বরঞ্চ সহায়ক। কেননা দ্বীনি এই মা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে সেটা দেখিয়েছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন উনাকে হযরত আছিয়া (রা.), হযরত ফাতিমা (রা.) এর মত করে কবুল করে নিন। উনার দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করুন। বিবি আছিয়া (রা.)এর সুরে দুয়া করার তাওফিক দিন-

رَبِّ ابۡنِ لِیۡ عِنۡدَکَ بَیۡتًا فِی الۡجَنَّۃِ
‘হে আমার রব, আপনার কাছে আমার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করুন।”

পৃথিবীর সকল মা কে আল্লাহ নেককার মুমিনা বান্দী হিসেবে কবুল করে জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করুন। আমিন। ইয়া রাব্বুল আ’লামিন।

লিখেছেনঃ ওয়াহিদ হৃদয়

Fahmida Hoque Miti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ফরেনসিক মেডিসিনের কিংবদন্তিতুল্য প্রফেসর আর নেই

Mon May 11 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ১১ মে, ২০২০ চলে গেলেন ফরেনসিক মেডিসিনের কিংবদন্তিতুল্য প্রফেসর, ঢাকার নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. আনিসুর রহমান। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) আজ সোমবার (১১ মে) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন ধার্মিক ও ভালো মানুষ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo