বিক্ষিপ্ত কিছু ভাবনাঃ ডা. সাকিব হাসান ধ্রুব

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৩ এপ্রিল, ২০২০:
ডা. সাকিব হাসান ধ্রুব

আমি বেশ ইন্ট্রোভার্ট আর চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলাম, নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে গেলে নার্ভাস হয়ে যেতাম। কিন্তু মেডিকেলে ইন্টার্নির সময় থেকে যখন ক্লিনিকাল সাইডে ঢুকলাম, হাজার পদের ইমার্জেন্সি ঝামেলা ম্যানেজ করা শুরু করলাম, তখন থেকে নিজের মধ্যে একটা অন্যরকমের কনফিডেন্স আসা শুরু করেছিলো। রাস্তার পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে আসা ড্রাগ অ্যাডিক্টের পায়ের অ্যাবসেস ড্রেইন করা হোক বা লোকাল পাতি নেতার ১৫-২০ জন নিয়ে আসা শ্বাসকষ্টের রোগী হোক, কোন কিছু দেখলেই ঘাবড়াতাম না, ঠান্ডা মাথায় কাজ করতাম। হাসপাতালই হয়ে উঠছিলো আমার জন্য একটা কমফোর্ট জোন।

আর এখন একটা ভয়ংকর আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে যাই, আমার কমফোর্ট জোনই এখন প্রায় এলম স্ট্রিটের মত নাইটমেয়ার জোন হয়ে গেছে। আগামীকালকের ২৪ ঘন্টা অ্যাডমিশন ভাবলেই এখন পেট নাড়া দিয়ে উঠছে। ডিএমসি ক্যাজুয়াল্টির একজন নার্স কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর করোনা থেকে নিজেদের এক্সপোজার কমানোর জন্য যে ২৪ ঘন্টা ডিউটি আমরা আগে দুই ভাগ করে ১০-১২ জন মিলে করতাম সেটা এখন মাত্র ৫ জন মিলে করছি, যাতে একটা গ্রুপ কোয়ারেন্টাইনে গেলেও ওয়ার্ড ফাংশনিং থাকে। আর রোগীও মাশাআল্লাহ করোনা টরোনা কিছু মানছে না। রোড ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্ট কিছু কমলেও ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট মারামারি বেড়ে গিয়েছে অনেক। আগের অ্যাডমিশনে ৫ টা ল্যাপারোটমি হইছে। এছাড়া একজন রোগী আসছেন নিজের গায়ে ৯ টা বড় সাইজের চাপাতির কোপ আর ওপেন চেস্ট উন্ড আর অ্যাকিলিস টেন্ডন কাট নিয়ে। চেস্ট ড্রেইন টেন্ডন রিপেয়ার এর সাথে সেলাই লেগেছে ভিতর বাহির মিলিয়ে ৭০-৮০ টার মত, দিতে দিতে পিঠ প্যারালাইজড। শেষ রাতে এমন অবস্থা হয়েছিলো যে বাথরুমে যেতে গেলেও অন্য কলিগদের অনুমতি নিয়ে যেতে হয়েছে, এতো রাশ। এর মধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত আছে গ্লাভসের সংকট, মাস্কের সংকট, ক্যাপের সংকট, আর ভ্যাপসা গরমে পিপিই পড়ে থাকার যন্ত্রণা। যে রেইনকোট পিপিই দিয়েছে ওইটার চেয়ে দুই তিনটা n95 মাস্ক আর কয়েকটা ৭-৭.৫ সাইজের গ্লাভস দিলেও কাজ হতো। ৬.৫ গ্লাভস পরে থাকতে থাকতে মনে হয় আঙ্গুলের নখ খসে পড়ে যাবে। এত কিছুর মধ্যে হাত কি নাকে গেল কিনা, মুখে কুলি করার পানি নেওয়ার আগে হাত স্যানিটাইজার দিয়ে ধুয়েছিলাম কিনা এত কিছু খেয়াল থাকে না। খালি মনে হয় কখন ডিউটি আওয়ারটা শেষ হবে আর এই জাহান্নাম থেকে বের হবো। কি পরিমাণ কোভিড এক্সপোজার হতে পারে সেইটা এক্সপেরিয়েন্স থেকেই বুঝে নিয়েন। তাও বাসায় ঢোকার আগে প্রায় ১ ঘন্টা লেগে যায় নিজের ফ্যামিলির সেফটি এনশিওর করে ঘরে ঢুকতে।

“পালাচ্ছি না”, “Heroes work here” এইগুলা বলা যত সহজ ক্যারি আউট করা ততটাই কঠিন, অন্তত আমার তাই মনে হয়। দিন শেষে আমরা সবাই শারীরিক, মানসিক, আত্মিক সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন মানুষ। তাই আমার মতে আমাদের এমন কিছু দাবী করা আমাদের পক্ষে ঠিক হবে না যেটা নিজেদের গলাতেই বোঝা হিসাবে আসে। শুধুমাত্র মেডিকেল সেক্টর কিরকম প্রেশারের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সেটুকু বোঝানোর জন্যই নিজের এক্সপেরিয়েন্সটা বললাম। আর আমার মতে এইরকম অবস্থা বেশিদিন চললে আমাদের ইন্ডিভিজুয়াল হিরোগিরি বেশি দিন টিকবে না, পুরা সিস্টেম কলাপ্স করবে।

টানেলের শেষের লাইট এখনও অদৃশ্য।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনা পরিস্থিতিতে মানিকগঞ্জে দরিদ্রদের পাশে ডা. লুৎফর রহমান

Tue Apr 14 , 2020
প্ল্যাটফর্ম সংবাদ, মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছে লকডাউন। বাইরে বের হওয়া নিষেধ, দেশ হয়ে পড়ছে কার্যত স্থবির। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা দিন আনে দিন খায়, বাড়ি থেকে কাজের জন্যে বের না হতে পারলে যাদের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo