তোফা-তহুরার বাড়ি ফেরা : চিকিৎসকদের দলবদ্ধ কর্মের একটি বিস্ময়কর গল্প

21552947_10210168621959888_233467103_n
তোফা তহুরা আজ ফিরে যাচ্ছে  বাবা-মায়ের কোলে, তাদের বাড়িতে। এসেছিল জোড়া হয়ে , ফিরে যাচ্ছে তারা সুস্থ এবং আলাদা হয়ে।

 

 

বাংলাদেশের চিকিৎসকদের এই সাফল্য এক বাক্যে শেষ করার নয়। তোফা তহুরার ঘটনা প্রমাণ করলো বাংলাদেশী চিকিৎসকদের উপর আস্থা রাখলে বিশ্বমানের সেবা বাংলাদেশেই দেয়া সম্ভব এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

 

 

21558013_10155589321069178_3414667249062696006_n

 

রোববার বেলা সোয়া ১২ টার দিকে  ঢাকা মেডিকেল কলেজের  সম্মেলন কক্ষে আয়োজন করা হয় একটি সাংবাদিক সম্মেলনের।
সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের উপস্থিতিতে চিকিৎসক দলের সকলে তোফা তহুরাকে তাদের বাবা-মায়ের হাতে  তুলে দেন।    এসময়  উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.   আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের পরিচালক  হাসপাতালের পরিচালক  একেএম নাসির উদ্দিনসহ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আজাদ আবুল কালাম। আরও উপস্থিত ছিলেন  স্বাস্থ্য সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম  এবং স্বাস্থ্যসচিব সিরাজুল হক খান।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি  মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সহ আরও অনেকে।

21557574_10155589323939178_8783601751483931941_n

সম্মেলনের  শুরুতে বক্তব্য রাখেন , ঢাকা মেডিকেল কলেজ  হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের  অধ্যাপক এবং তোফা তহুরার চিকিৎসক , ডা.  সাহনূর ইসলাম।

তিনি   বলেন, তোফা ও তহুরা  এখন ভাল আছে, অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া করছে। আজ তোফা হঠাৎ করে বসতে শিখেছে। তবে ওরা এখনও আশঙ্কামুক্ত নয় । তাদের আরও দুবার অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হবে এবং সেটা হতে পারে  ৬ মাস পর, তারপরও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরে সঠিক দিন-তারিখ ঠিক করে জানিয়ে দেওয়া হবে । কিন্তু  এই কয় মাসের মাঝে আমরা নিয়মিত ওদের খোঁজ রাখব। ওদের জন্য সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব ”

ডা. সাহনূর ইসলাম আরও বলেন, আজ তফা-তহুরা বাড়ি চলে যাবে বাবা মায়ের কোলে করে। সেইজন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্যোগে তাদের  একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে , যেন ওরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে। এখন তাদের পুর্নবাসনের প্রয়োজন। ওদের ভবিষ্যৎ যেন আর বাকি শিশুদের মতই নিরাপদে থাকে সেইজন্য প্রয়োজন হবে বেশ কিছু আর্থিক সহযোগিতা । কেউ  যদি ওদের কে আর্থিক সাহায্য করতে চান তাইলে ডাচ বাংলা ব্যাঙ্কের এই একাউন্টে , একাউন্ট নং – ১৩৯১৫৭৩৭৪০ , ইমামগঞ্জ শাখা দাচ-বাংলা ব্যাংক , এই নম্বরে টাকা জমা দিতে পারেন। ওদের বাবা মায়ের নামে এই যৌথ ব্যাংক একাউন্টটি খুলে দিয়েছি আমরা। আর ইতোমধ্যে এই একাউণ্টে বেশ কিছু টাকা জমা হয়েছে।”

সম্মেলনে সকলের বক্তব্য শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে তিনি, তোফা ও তহুরার বাবা রাজুর জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন।

 

21432937_1812389595441796_3558044378537648029_n

21433104_10155589324059178_8071274813368158096_n

মা সাহিদার বুকে একটি নয় দুটি নবজাতক তুলে দিয়েছিল ধাত্রী। চার বছর বয়সী ছেলের পর একটি মেয়ে যেখানে আকাঙ্ক্ষিত, সেখানে যমজ দুটি মেয়ে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা সাহিদা-রাজু দম্পত্তি। প্রসব যন্ত্রণা মূহুর্তের মাঝে ভুলে গিয়ে নয় মাসের গর্ভের ধন বুকে নিতেই চমকে উঠে সাহিদা, শিশু দুটো কোমরের দিকে জোড়া লাগানো।

 

আঁতুড় ঘর থেকে প্রসূতি মায়ের কষ্ট ছড়িয়ে পরে সারা পাড়া। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার জিনিয়া গ্রামের অতি সাধারণ এক গর্ভধারিণী সাহিদার প্রসব হয়েছিল নিজ বসতভিটায়, দাইয়ের হাতে। অভাবের সংসারে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা অকল্পনীয়, গর্ভে সন্তান আসার পর একবারের জন্যেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি সাহিদার। যমজ শিশুদের জন্মও হয়ত অনাড়ম্বর থেকে যেত যদি সাহিদা-রাজু দম্পত্তি তাঁদের নিয়তি মেনে নিতেন। শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বুকের দুধ খেলেও ধীরে ধীরে তাঁদের পেট ফুলে উঠে, বমি শুরু হয়। জন্মের পাঁচ দিন পর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সিভিল সার্জন ডাঃ নির্মলেন্দু চৌধুরী সরকারি এ্যাম্বুলেন্সে একজন চিকিৎসকসহ তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

20881994_10212678062922724_2928006090221665079_n-1

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় সাড়ে চার হাজার রোগীর ভিড়ে সাহিদারা হারিয়ে যায়নি। শিশু সার্জারি বিভাগে চতুর্থ ইউনিট  অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলামের অধীন জরুরী ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসা শুরু হলো। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের চিকিৎসকদের মতামত অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। শিশুদের অবস্থা খারাপ থাকায় তখন রক্ত পরীক্ষা ও বেবিগ্রাম(এক্সরে) করা গেলেও এমআরআই করা যায়নি। নবজাতক বিভাগের স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে(স্কাবো) তাদের রাখা হয়। ১২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মেডিকেল বোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় সেপ্টিসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে এনে পেটে অস্হায়ী মলদ্বার স্হাপনে অস্ত্রোপচার করা হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে দুজন শিশুর পায়খানার রাস্তা একটি ছিল।

 

FB_IMG_1502744532409

 

তোফা নামের অর্থ উপহার, তহুরা অর্থ ভালোবাসা। প্রথম অস্ত্রোপ্রচারের পর মা সাহিদা দুজনের নাম রাখলেন তোফা-তহুরা।

বিরল জোড়া লাগানো শিশুদের প্রথম অস্ত্রোপ্রচার চিকিৎসকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল, বিশেষ করে অবেদনবিদদের (এনেস্থেশিয়া) জন্য। দুটো শিশুকে একই সাথে অজ্ঞান করা, জোড়া লাগানো শরীরে খুব সূক্ষ্ম হিসেবে ওষুধের ব্যবহার এবং জ্ঞান ফেরানো কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন এনেস্থাশিয়ার সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এস এম শফিকুল আলম, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোঃ মোজাফ্ফর হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাবেয়া বেগম। সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলাম এর নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। অস্ত্রোপ্চারের পর পুনরায় মেডিকেল বোর্ডে এমআরআই করার নির্দেশ দেয়া হয়।

কৃষক রাজুর সন্তান তোফা-তহুরার চিকিৎসা অর্থের জন্য থেমে থাকেনি, মেশিন নষ্ট বা যন্ত্রপাতি নেই সেজন্যেও কালক্ষেপণ ঘটেনি। এমআরআই করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোঃ মিজানুর রহমানের নির্দেশনায় রেডিওলজি এন্ড ইমেজিংয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহরিয়ার নবী শাকিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিশ্বজিত ভৌমিকের সাথে যোগাযোগ করেন। এমআরআই এর রিপোর্টসহ পুনরায় মেডিকেল বোর্ড বসে। তোফা-তহুরার ওজন কম থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ছয় মাস অস্ত্রোপ্রচার করে তাদের আলাদা করা হবে, এই ছয় মাসে তারা একমাস পর পর চেকআপে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসবে এবং এর মাঝে কোন অসুবিধা হলে এর আগেই ভর্তি হবে। এসময় তোফা-তহুরার চিকিৎসা বাংলাদেশেই হবে জানিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্স করা হয়।

19022227_1675617565790152_442688320_n

 

বাংলাদেশী চিকিৎসকগণ যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন তোফা-তহুরার অস্ত্রোপচারের জন্য তখন বিদেশি হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় এক এনজিও এর মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজখবর করা হয়। পৃথিবীর যে কোন পিতামাতাই চাইবেন তাদের সন্তানেরা যেন সর্বোচ্চ চিকিৎসা পায়। বিদ্যাবুদ্ধিতে দেশের আর দশজন মানুষের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও সাহিদা-রাজু কোন প্রলোভনে পড়েনি অথবা ইতিপূর্বে এরকম জোড়া লাগা শিশুদের পিতামাতার মত চুপিসারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যায়নি।

তোফা-তহুরার চিকিৎসায় চিকিৎসকেরা পিতামাতার আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন আন্তরিকতা দিয়ে। পুনরায় অপারেশনের জন্য ভর্তি হবার পর প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় করে সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলাম তোফা-তহুরার মা-বাবার সাথে সন্তানদের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলাপ করেছেন এবং ভর্তির আগে প্রতিমাসে তাঁর কাছেই ফলোআপে এসেছে।

 

কোলের সন্তান প্রতিদিন যখন একটু একটু করে বেড়ে উঠে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে, বাবা বা নিকটাত্মীয়র চেনা কন্ঠের ডাক শুনলে ফিরে তাকায়, আধো আধো বোলে একটা দুটো শব্দ বলতে শেখে-বাবা মায়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। সাহিদাও চায় তার আদরের তোফা তহুরা হামাগুড়ি দিক, একদিন কোমর সোজা করে বসুক। সাহিদার প্রত্যাশা পূরণে এতটুকু ত্রুটি রাখেনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।

ছয় মাস পর অপারেশনের জন্য তারা ভর্তি হলে পুনরায় প্রত্যেক সংশ্লিষ্ট বিভাগের মতামত চাওয়া হয়। বার্ন এন্ড প্লাস্টিক রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম 3 Tesla মেশিনে পুনরায় একটা এমআরআই করতে বলেন। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে এ মেশিন চালু আছে জেনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে রেডিওলজি এন্ড ইমেজিংয়ের বিশেষজ্ঞ ডাঃ শারমিন আক্তার রুপার সহযোগিতায় 3 Tesla মেশিনে এমআরআই করা হয়। একাধিকবার এমআরআই করার কারণ জোড়া লাগা শিশুদের ত্বক, মেরুদণ্ডের হাড়, স্পাইনাল কর্ড, স্নায়ু, পায়ুপথ, পরিপাকতন্ত্র, প্রজননতন্ত্রসহ শরীরের প্রত্যেকটি অংশের অনুপুঙ্খ ধারণা থাকা সফল ও নিরাপদ অস্ত্রোপ্রচারের পূর্বশর্ত। সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের যোগাযোগের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মিজানুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট সকলের উপস্থিতিতে মেডিকেল বোর্ড অপারেশনের তারিখ ঘোষণা করে। মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তোফা তহুরাকে হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকার কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং অপারেশনের নির্ধারিত তারিখের নির্দিষ্ট সময় পূর্বে এসে ভর্তি হতে বলা হয়।

 

20841118_10212678059602641_3253508830992619251_n

 

শত সীমাবদ্ধতার মাঝে বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে মূল শক্তি দক্ষতা এবং টিমওয়ার্ক। তোফা তহুরার অস্ত্রোপচারের পূর্বে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, নিউক্লিয়ার মেডিসিন প্রত্যেক বিভাগের সাথে শিশু সার্জারির বিভাগের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে সকল পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয় এবং সমাজ সেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে খরচ বহন করা হয়। জেনারেল এনেস্থেশিয়ার জন্য উপযুক্ত কি না জানতে সকল পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি করা হয়।  অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলাম নিজে ইকোর পর কার্ডিওলজি বিভাগে এবং নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শংকর বিশ্বাসের সাথে দেখা করেন।

অস্ত্রোপচারের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবে নিউরো সার্জারি ওটি ও অস্ত্রোপ্রচারের যন্ত্রপাতি তৈরি রাখা হয়। প্রথমবার অস্ত্রোপ্রচার শিশু সার্জারি ওটিতে হয়েছে কিন্তু পৃথকীকরণ অস্ত্রোপ্রচারে নিউরোসার্জারি অংশে অপারেটিং মাইক্রোস্কোপ এবং অর্থপেডিকসার্জারি অংশের জন্য সি আর্ম(এক ধরনের এক্সরে যন্ত্র) প্রয়োজন।

 

অস্ত্রোপ্রচারের দুই দিন আগে তোফা তহুরাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। তাদের জন্য হাই ডিপেণ্ডেন্সি ইউনিট(এইচডিউ) এবং আইসিইউতে দুটি করে শয্যার ব্যবস্থা রাখা হয়। পৃথকীকরণ অস্ত্রোপ্রচারের জন্য মোট ৩টি দলে শিশু সার্জন, প্লাস্টিক এন্ড রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জন, নিউরো সার্জন, অর্থপেডিক সার্জন, অবেদনবিদ, রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিশেষজ্ঞ কাজ করেন। প্রত্যেক টিমের জন্য আলাদা যন্ত্রপাতি, ওষুধ, সহযোগী নার্স, ওটি বয় সহ অন্যান্য সদস্য যেমন চিকিৎসক ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার তৈরি রাখা হয়। অস্ত্রোপ্রচারের দিন সকালে প্রেস কনফারেন্সে দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়।

 

পা অবশ হয়ে যেতে পারে এবং প্রস্রাব পায়খানা ধরে রাখতে অক্ষম হতে পারে জেনেও তোফা তহুরার মা বাবা অস্ত্রোপ্রচারের অনুমতি প্রদান করে। আদরের সন্তানদের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত চলতে ফিরতে দেখতে পাবেন এই আশায় দীর্ঘ ৯ ঘন্টার অপেক্ষা। সজল চোখে অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে যখন তারা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিল ভেতরে চলেছে তখন অন্য লড়াই। বাংলাদেশের চৌকস সার্জনেরা প্রায় নির্ভুল অস্ত্রোপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, নেপথ্য নায়ক অবেদনবিদেরা অস্ত্রোপ্রচারকে নিরাপদ রেখেছেন।

FB_IMG_1502744676348

 

অস্ত্রোপচারের শুরুতে তোফা তহুরার ত্বকে প্রথম আঁচর থেকে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত প্লাস্টিক সার্জারির অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম তাঁর দক্ষতা দিয়ে উপস্থিত সকলকে আশ্বস্ত করেছেন। এরপর ধাপে ধাপে অর্থপেডিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোঃ শামসুজ্জামান, নিউরোসার্জন ডা. অসিত চন্দ্র সরকার, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান প্রধান এবং নিউরোসার্জন সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজিউল হক অস্ত্রোপ্রচার করেন।

উপস্থিত একজন বিশেষজ্ঞ সার্জনের মতে নিউরোসার্জনগণ তোফা তহুরাকে অদ্ভুতভাবে একই ছন্দে অস্ত্রোপ্রচার করেন। এনেস্থেসিয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোঃ মোজাফ্ফর হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাবেয়া বেগম অবেদনবিদ হিসেবে কাজ করেন। সার্বক্ষণিকভাবে রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিন আক্তার রুপা উপস্থিত ছিলেন এবং লিড সার্জন হিসেবে ছিলেন শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাহ্ নূর ইসলাম। তোফা তহুরা পৃথকীকরণ অস্ত্রোপ্রচারের দ্বিতীয় ভাগে প্রথম শিশু তোফার দেহে অস্ত্রোপ্রচার সম্পন্ন করেন শিশু সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সদরুদ্দিন আল মাসুদ, সহকারী রেজিষ্ট্রার ডা. নাজমুল হায়দার সনেট, নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোঃ রফিকুল ইসলাম। দ্বিতীয় শিশু তহুরার দেহে অস্ত্রোপ্রচার সম্পন্ন করেন শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আশরাফ উল হক, অধ্যাপক ডা. আব্দুল হানিফ, প্লাস্টিক এন্ড রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারির সহকারী অধ্যাপক ডা. হেদায়েত আলী খান, নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাশেদ মাহমুদ। ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন ডা. কৌশিক ভৌমিক, ডা. সামিউল ইসলাম এবং ভিডিওগ্রাফিতে কাজ করেন জনাব আব্দুল্লাহ।

 

জীবনে যদি কোন পূণ্য করে থাকেন তবে দোয়া করেন বাচ্চা দুটোকে যেন আইসিইউতে নিতে না হয়”- অস্ত্রোপ্চারের পূর্ব প্রস্তুতির সময় ডা. শফিক , অধ্যাপক ডা. সাহনূর ইসলামকে বলেছিলেন।

 

 

সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় অস্ত্রোপচার শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই তোফা তহুরার জ্ঞান ফেরে, তারা কেঁদে উঠে এবং তখনি পা নাড়াতে পারছিল। আইসিউতে নিতে হয়নি, তোফা তহুরা দুজনকে পোস্ট অপারেটিভ এ রাখা হয়। সেখানেই ১০ মাস পর তোফা তহুরার মা বাবা বিস্মিত চোখে তাদের আলাদা হওয়া সন্তানকে দেখেন। দীর্ঘ ৯ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার পর দেশবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

 

 

তোফা-তহুরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাফল্যের একটি মাইল ফলক হয়ে থাকল, সকলের সহযোগিতায় যা ভবিষ্যতে আরো অনেক সাফল্য বয়ে নিয়ে আসবে।

FB_IMG_1502744611973

তোফা তহুরা বাংলাদেশের সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি সাফল্যমাত্র। কিন্তু যেতে হবে বহুদূর। তোফা তহুরার মা সাহিদার মত প্রতি ১০০ জন গর্ভবতীর ৬২জনের প্রসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে না হয়ে নিজ বাড়িতে হচ্ছে এবং তার মত প্রতি ১০০ জন গর্ভবতীর মাঝে ৭৪ জনই গর্ভকালীন নূন্যতম ৪ বার চিকিৎসকের চেকআপে যায় না। তবু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেমে নেই, মাঠ পর্যায়ে কাজের পাশাপাশি সর্বোচ্চ পর্যায়েও পৃথিবীর যে কোন দেশের সমান তালে জটিল রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা দিচ্ছেন।

 

আস্থা রাখুন আপনার চিকিৎসকের উপর, 
আস্থা রাখুন বাংলাদেশের উপর।

 

 

 

 


( বিশেষ দ্রষ্টব্য ঃ প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ এর অনুমুতি ব্যাতিত এই সকল তথ্য, ভিডিও এবং ছবি অন্যান্য জায়গায় প্রকাশ করলে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বাধিত থাকিবে প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ)

তথ্য সংগ্রহে ঃ ডা ঃ মোহিব নীরব, ডাঃ ইশরাত জাহান, ডাঃ বনফুল রায়
সহ সহযোগিতায়  ঃ ডাঃ সারওয়ার এবং ডাঃ আফসারা
ছবি ঃ নিজস্ব প্রতিনিধি , বিভিন্ন সুত্র থেকে সংগৃহীত 

যে কোন তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন ঃ [email protected] 

Ishrat Jahan Mouri

Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মায়ের গর্ভেই থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্নয় পদ্ধতি

Mon Sep 11 , 2017
আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া একটি মারাত্মক জেনেটিক/জন্মগত রক্তরোগ। স্বামী-স্ত্রী এ রোগের বাহক হলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকদের কোন লক্ষন থাকেনা। এরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরী হয়না। এই শিশুদেরকে অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo