ক্ষুধা এক বিশাল হা করে আছে

২ এপ্রিল, ২০২০

– ডা. শুভদীপ চন্দ, হৃদরোগবিশেষজ্ঞ

সকালবেলা ফুল প্রোটেকশন সহ আমি যখন ব্যাটারি অটোতে বসতে যাব, অটোচালক নাম রশিদ বললো-‘করোনার আগেই না খেয়ে মরে যাব’। আমি দেখলাম আমিই একমাত্র যাত্রী। এ এক যাত্রী নিয়ে এ রোডে পোষাবে না।

দুপুরের তপ্ত রোদ৷ মোবাইল টেম্পারেচার বলছে ছত্রিশ ডিগ্রি। বাজারে কয়েকটি মাত্র প্রাণী। দুটো মাছ বড় ডালায় হাঁ করে অক্সিজেন নিতে চাচ্ছে, এক জায়গায় চারটে ইলিশমাছ জোর করে গুঁজে দিচ্ছে এক বিক্রেতা। বলছে, ‘এর চেয়ে কম দামে আর পাবেন না’। অল্পকিছু সবজি নিয়ে কিছু লোক বসে আছে। একটি লাউ, আঁটি বাঁধা পালংশাক, অল্পকিছু টমেটো। কোথাও বেগুন, আলু, শশা, লেবু। সাধারণত ভ্যানেই এরচেয়ে বেশি সবজি থাকে। শুধু মরিচ নিয়ে বসেছেন এক বৃদ্ধলোক। তার মরিচের যে অবস্থা- কেউ কিনবে না। তার পাশে এক বৃদ্ধা মহিলা বসেছেন চারটি বেল নিয়ে। একটি আবার পোড়া। মাথার উপর ছায়া বলতে একটি ছাতা। সব বিক্রি না করে ঘরে ফিরবেন না!

ফার্মেসির দোকান আর মুদির দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ। তাদেরও ক্রেতা নেই। অলসভাবে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকেন। রিকশাচালকরা এখন আর দামাদামি করেন না। ত্রিশ টাকার ভাড়া বিশ টাকা পনেরো টাকায় চলে যান। লাইটপোস্টের ছায়ায় বসে থাকা বুড়ো মুচিটি বলে- ‘স্যার দেন কালি করে দেই?’ আমি নিচের দিকে তাকাই। জুতা সকালেই কালি করিয়েছি। সব দোকান বন্ধ। অফিস আদালত বন্ধ।

মসজিদ থেকে লোক বের হচ্ছে। ভাল সংখ্যক লোক। সবার মুখে মাস্ক পরা। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বলতে কেউ কারো সাথে কথা বলছেন না। নীরবে বাসার দিকে হাঁটছেন। মাথা ভর্তি মুরগি আর দুই হাতে চার চার আট মুরগি নিয়ে কোনোভাবে ব্যালেন্স করা ছেলেটি বললো- ‘স্যার মোরগ নিবেন? সস্তায় যাচ্ছে।’

দাঁড়ি গোফের জঙ্গলে বসে থাকা এক পাগল এমনি এমনি ঢুলছে। পৃথিবীর কোনো আইনই তার জন্য প্রযোজ্য নয়। এক্সিস্টিং কোনো দুশ্চিন্তাও তার নয়। ভিক্ষুক আরো কাতর ভাবে ভিক্ষা চাইলো। অল্প কথায়, মৃদুস্বরে। সংকটের নিজস্ব এক ভাষা আছে- সে নিজেই কথা বলে। ব্যক্তির অত বলা লাগে না। রাস্তার কুকুরগুলো ঘুমাচ্ছে। এখন যখনি দেখি, ঘুমাতে দেখি। ওদের কি হয়েছে কে জানে!

আসলে যেকোনো মহামারি ‘মহামারি’, যখন আপনার দরিদ্রতার মতো অসুখটি থাকবে না! ও সব খেয়ে নেয়। বিপদ-আশঙ্কা-মৃত্যুভয় সব।

কয়েকজনের সাথে কথা বলে শুনলাম- কিছু লোক এগিয়ে আসছেন। দেড়-দুই-পাঁচ কেজি চাল, আধা বা এক কেজি ডাল নিয়ে। আমি কখনো দেখি নি। হয়তো আমাদের মতই দো-পেয়ে মানুষ হবেন। শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে আসে। আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড শুধু আমার লেখা পড়ে উপজেলায় আমাদের জন্য পিপিই নিয়ে গেছেন। কোনো ক্যামেরার ফ্লাশ নেই, সুনাম প্রশংসা নেই, পত্রিকার পাতায়ও এক কলাম বরাদ্দ নেই। আমার অধিকাংশ কলিগ তাকে দেখেও নি। উনাকেও দেখেছি। হুবুহু মানুষের মতো!

আমার লেখায় কখনো কাউকে ট্যাগ করি না। মহত্ত্বকে বাঁধবো, দারিদ্র্যকে বাঁধবো, সৌন্দর্যকে বাঁধবো- অত শক্তি কই! তাই তাকে একটি চরিত্র হিসেবেই রাখলাম। এ কোভিড উনিশের সময় অনেক লোকই এ চরিত্রে এঁটে যাবেন।

আমি আগে ভাবতাম আমার লেখা কেউ পড়ে না। এ ঘটনার পর মনে হয় কেউ কেউ পড়ে। অনুরোধ করছি আপনারা এগিয়ে আসুন। মধ্যবিত্ত পারবে না। তারা ইতোমধ্যে ভয় পাচ্ছে প্রত্যাশিত এক ধাক্কা খাওয়ার জন্য। একদিনের বেতন কাটা যাবে। উপর থেকেই কেটে নিবে- এদেশে ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই! কান্নাটাকে নীরবে গিলে নেওয়াই এ ক্লাসের জন্য সবচেয়ে বড় ইয়োগা।
অন্য যাদের সামর্থ্য আছে এগিয়ে আসুন। ক্ষুধাটিই সার্বজনীন!

Fahmida Hoque Miti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

চিকিৎসকদের পাশে পুলিশ

Thu Apr 2 , 2020
০২ এপ্রিল, ২০২০: ইনশাআল্লাহ আমরা পারবো করোনাকে পরাজিত করতে এভাবে সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে তবে করোনা কেন যে কোন দুর্যোগ আমাদের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য । চট্টগ্রাম বি এম এ ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের যৌথ উদ্যোগে, বিভিন্ন হসপিটালে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্হ্যকর্মীদের জন্য […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo