কোভিড-১৯ এর চূড়ান্ত সংক্রমণের পূর্বাভাস: লকডাউন বিষয়ক ভাবনা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩১ মে ২০২০, রবিবার

ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম
সহযোগী অধ্যাপক ইপিডেমিওলজি এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজার, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী
(এনসিডিসি), স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর

যখন লকডাউন, স্কুল বন্ধ বা সাধারণ ছুটি কিছুই ছিল না তখন আমরা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কিছু প্রেডিকশন মডেল দেখেছিলাম, যেগুলো পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। লকডাউন থাকা অবস্থায় আমরা ভাইরাসের গতিপথ জানি না কারন বাংলাদেশে মহামারি সব অঞ্চলে একই রকম নয়। এখনও দেশের কোথাও গুচ্ছ সংক্রমণ আবার কোথাও বা সামাজিক সংক্রমণ।

আমরা যদি ঢাকা, নারায়ানগঞ্জ এবং অন্যান্য বড় শহর থেকে পাওয়া নমুনা পরীক্ষা ও সনাক্তের তথ্যগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায় যে সেগুলো জুলাই এর শেষ এ সংক্রমণ শীর্ষে থাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিন্তু তাই বলে আমরা একদম নিশ্চিত নই।

মূল সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের পরীক্ষা এখনও তুলনামূলক কম করা হচ্ছে এবং আমরা সকল সংক্রমিত রোগীকে চিহ্নিত করতে পারছি না। কেউ কেউ বলেন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সমাজভিত্তিক নমুনা পরীক্ষার বদলে কিছু ক্ষেত্রে [সোশ্যাল কানেকশন স্যাম্পল কালেকশন] পরিচিতি বা সুযোগভিত্তিক নমুনা সংগ্রহ চলছে।

উপরন্তু যে পরীক্ষা আমরা করছি তা বিস্তৃত জনসংখ্যার উপর নয়, অনেকাংশেই ডিসপ্রপোরশনাল। কতগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় পরীক্ষা, বুথ, ল্যাবরেটরি সবই অনেক বেশি।

কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষার গুণগত মান নিয়ে কথা উঠেছে। কোথাও আবার ল্যাবরেটরী কনটামিনাটেড হয়ে নমুনা পরীক্ষায় ব্যঘাত ঘটিয়েছে। সামান্য কিছু জায়গায় নমুনা নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এগুলো ঘটা অসম্ভব না তবে দেখতে হবে এগুলো ডাটা বিশ্লেষণ এর সময় আমলে এসেছে কিনা। আমরা এটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে, আমরা যে তথ্যের ভিত্তিতে করোনা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের একটি প্রেডিকশন তৈরি করছি সেই তথ্যগুলোই বা কতটুকু সঠিক।

এই মডেলগুলো নিয়ে আরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে পরবর্তীতে আরও বেশী প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে, সময়ের সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাল গতিপথ পরিবর্তন করতেই পারে। করোনার বৈশ্বিক আচরন বিবেচনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে সাধারন মানুষের জনসাস্থ্যবিধি মানার উপর এবং সাস্থ্যব্যবস্থার প্রস্তুতির উপর সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেখার ঢাল নির্ধারিত হয়।

বাংলাদেশের মত বিরাট জনসংখ্যার দেশে আমরা যদি প্রতিদিন বিশ ত্রিশ হাজার পরীক্ষাও করি তাও সেটা যথেষ্ট নয়। কারো কারো মতে বাংলাদেশে প্রত্যেকের পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই কারণ পরীক্ষার হারের সাথে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা খুব বেশি বাড়ে নি। এটা আমার মতে ঠিক নয়।

আমার ধারনা যখন নতুন আক্রান্তের কথা বলি, আমরা কেবল মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এবং তার বিপরীতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশ করি, কোনটা কোন ধরনের নমুনা সে সংখ্যাটা মনে হয় প্রকাশ করি না। অর্থাৎ কতগুলো নমুনা পরীক্ষা রোগ শনাক্তের জন্যে আর কতগুলো পরীক্ষা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্যে হয়েছে বা সেটা প্রকাশ করি না। কেউ কেউ একই নমুনা দুজায়গায় করেও সংক্রমণের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চান, এই তথ্যগুলো আলাদা করার ব্যবস্থা আছে কিনা।

একত্রে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা প্রকাশ করাতে আমরা বুঝতে পারি না যে তার মধ্যে কতজন বাড়িতে সুস্থ হওয়া রোগীর নমুনা আর কতজন হাসপাতাল থেকে ছাড়া প্রাপ্ত রোগীর নমুনা আছে। তাই যখন অনেক মানুষ সুস্থ হয়ে যাচ্ছে এবং এই সুস্থ ব্যক্তিদের প্রত্যেকের যদি দুইটা করে নমুনা নেয়া হয় আর সেগুলো নেগেটিভ হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবে আপনার পরীক্ষার সংখ্যা বাড়বেই এবং পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের সংখ্যা কমবেই।

অন্য দেশ গুলো যেভাবে পরীক্ষা করছে তা হল, তারা বিস্তৃত জনসংখ্যার উপর পরীক্ষা করছে এবং তাদের পজিটিভ রোগীর সংখ্যা তাদের পরীক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের মত দেশে প্রতিদিন বিশ ত্রিশ হাজার পরীক্ষা নিয়মিতভাবে করা খুব দুরূহ কাজ।

রোগতত্ত্ববিদরা মনে করেন বেশিরভাগ আক্রান্ত-অধ্যুষিত লোকালয় যেমন ঢাকা, নারায়ানগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলে নমুনা পরীক্ষার সাথে সাথে রোগের লক্ষণ/ উপসর্গ দেখে কঠোর নজরদারি প্রক্রিয়াটি (সিন্ড্রমেটিক সারভিলেন্স) জোড়লো করতে হবে। সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিধিগুলো কড়াকড়ি না করতে পারলে গুরুতর বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও এসব বেশিআক্রান্ত-অধ্যুষিত শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে অবাধ চলাচল ঠেকাতে হবে, সোজা কথায় বললে একটি একটি পকেট অঞ্চল লক ডাউন এর আওতামুক্ত করে পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। মহামারি আইনের আওতায় একাজটি সাস্থ্য বিভাগ স্থানীয় প্রশাসন এর সাহায্য নিয়ে করতে পারেন।

লক ডাউন ছাড়া কোভিড-১৯ এর সংক্রমন কেমন হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা পেতে প্রয়োজন তিনটি ইনকিউবেসন পিরিয়ড (করোনা ভাইরাসের আক্রমন ঘটার পর থেকে রোগ প্রকাশ পেতে যেই সময় প্রয়োজন) যার সময়কাল দেড় মাস। আর তাই মে মাসের ৩০ তারিখ থেকে যদি লকডাউন তুলে নেওয়া হয় তাহলে আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়েই এই রোগের সংক্রমন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে।

ধারনা করা হচ্ছে যেহেতু মানুষের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার একটি ভীতি কাজ করবে তাই লকডাউন তুলে নেওয়া হলেও সাধারণ জনগণ এর একটা বড় অংশ সংক্রমণ প্রতিরোধ এর সামাজিক বিধিনিষেধ গুলি মেনে চলা অব্যাহত রাখবে [ধারনা করাই যায় যে বেশ কিছুদিন ধরে এই আচরণ গুলি মেনে চলার কারনে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন], যেমন মানুষ নিজের জীবনের নিরাপত্তার কারনেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবে, মাস্ক ব্যবহার করবে যার ফলে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেও চুঁড়াটি খুব বেশি উচুঁ হবে না।

আমাদের এসময়ে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ [রেড জোন] এলাকা গুলোর দিকে বেশি মনযোগী হয়ে সে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল নিয়ে ভাবা উচিত এবং সেকারনে-

প্রথমত আমাদের পুল হিসেবে পরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা গুচ্ছকে [ ক্লাস্টার] চিহ্নিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত প্রত্যেককে পরীক্ষা করে পজিটিভ হলে তাদেরকে কোয়ারেন্টাইন করা, যদিও এই প্রক্রিয়ায় কাজ করার সময় চলে গিয়েছে। এছাড়া আমরা আমাদের পরীক্ষা করার ক্ষমতাও দশ হাজার থেকে হঠাত বিশ হাজার করতে পারছি না।

আমাদের এখন যেটা করতে হবে তা হল মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করা। সে জন্য পঞ্চাশ, ষাটোর্ধ সকলের যাদের উপসর্গ আছে তাদের সকলের পরীক্ষা করতে হবে, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং প্রথম দিন থেকেই সঠিক চিকিৎসা দেয়া শুরু করতে হবে যাতে তারা মৃত্যুবরণ না করেন।

নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বা সংখ্যা মহামারির বিস্তৃতি নির্ধারণের জন্য প্রধান পন্থা হবে না। বরং মৃতের সংখ্যা দ্বারা মহামারীর গত প্রকৃতি ও বিস্তৃতি নির্ধারিত হবে। এপিডেমিওলজিকাল মডেলের মাধ্যমে এটি করতে হবে। কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য এখন নেই। তাই বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আমাদের লক্ষিত/ টার্গেটেড জনগোষ্ঠীর শতভাগ নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে।

লকডাউন ও সাধারণ ছুটির কারনে মহামারি গতি কিছু কমেছে। কিন্তু মনে রাখবেন, একটা সময়ের পর এটা আর কার্যকরী হবে না। লক ডাউন রোগ সারানোর ম্যাজিক বুলেট না এটা কেবল মহামারীর গতিকে আটকে রেখেছে। এ ধরনের সামাজিক জনসাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় যাতে কিনা দেশের সাস্থ্য ব্যবস্থা এটা সামাল দিতে পারে। আমরা লক ডাউন তুলে নেয়ার পর পরই করোনা সংক্রমণ এর পুনরুত্থান দেখতে পাবো কারন এটাই এই রোগের ধরণ। আপনাকে মনে রাখতে হবে যে লকডাউন এর উদ্দেশ্য এই নয় যেন মহামারী চলে যায় অথবা সারাজীবন লক ডাউন চলবে।

পরিশেষে বলি, এই মহামারি সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। তাই এটি শুধু কতগুলো ঢেউ হবে তার উপরই নির্ভর করে না ঢেউ কত উঁচু হবে, জলোচ্ছ্বাস হবে কিনা তার উপরও নির্ভর করে। যদি খুব দ্রুত সংক্রমণ হয় বা এক সাথে বহুলোক আক্রান্ত হয় তাহলে ঢেউ অনেক বড় হবে। তারপর এটি তীরে সব গুঁড়িয়ে দিয়ে শেষ হয়ে যাবে। এই রোগের ক্ষেত্রেও একটি বড় ঢেউ উঠেছে বা উঠতে যাচ্ছে। একই ভাবে যদি সংক্রমণ সংখ্যা বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ না করা যায় রোগীর সংখ্যা বাড়ে তাহলে মহামারীর একটার পর একটা ঢেউ আরও উঁচু হয়ে আছড়ে পড়বে এবং সমাজ আর অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলবে।

এই কারনেই আমরা চাচ্ছি সংক্রমণের হার কমিয়ে ফেলতে যাতে করে রোগের পর্যায়ের পরিমান বড় না হয়। আপনি যদি এই রকম আর একটি ছোট পর্যায় পান তাহলে আমরা সেটাকে দ্বিতীয় পর্যায়/ ঢেউ বলব কারন এখনও অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়নি। আমার মতে একটা বড় পর্যায়ের চেয়ে দুই তিনটা ছোট পর্যায় হওয়া ভাল। আমরা এখনও একটা পর্যায়ের পুরোটা দেখি নাই, একটি পর্যায়ের মধ্য আছি। এটি এখনও গতি তৈরি করছে। এবং যেহেতু প্রথম পর্যায়টি এখনও শেষ হয়নি তাই এই বিষয়ে স্পস্ট করে বলার মত সময় এখনও হয় নি।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কিশোরগঞ্জে করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য ল্যাব চালু

Mon Jun 1 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১ জুন ২০২০, সোমবার কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে করোনাভাইরাস শনাক্তের উদ্দেশ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব চালু হয়েছে। রোববার (৩১ মে) বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাবটি চালু করা হয়।                   আরটি-পিসিআর ল্যাব চালু হওয়ায় এখন থেকে কিশোরগঞ্জেই করোনা পরীক্ষা করা যাবে। ল্যাবটিতে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo