করোনার সাথে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর একটি ক্ষুদ্র চিরকুট

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার

– ডা. মো. আলাউল কবির দিপু

আমি ডা. মো. আলাউল কবির দিপু, আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছি নারায়নগঞ্জ বন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

গত দেড় বছর যাবৎ আমি, আমার পরিবার ক্যান্সার নামক এক মরণব্যাধির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আমার একমাত্র তিন বছরের সন্তান ইয়াথবির ব্লাড ক্যান্সার এর সাথে লড়ছে দের বছর যাবৎ। বাচ্চার ক্যান্সার ধরা পড়ার এক মাস পরেই আমার মায়ের ওভারিয়ান ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রিয় দুইজন মানুষকে নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছি দিনের পর দিন। সাথে চালিয়ে নিয়েছি হাসপাতালের ডিউটি, চেম্বার। করোনা শুরুর সময় থেকে দেখছি করোনা রোগী। আমার মা ক্যান্সার আক্রান্ত আর এই রোগীরা এমনিতেই দুর্বল হয়। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও থাকে কম। আমার কাছ থেকে যদি কোন ধরণের জীবাণু তাদের না ছড়িয়ে যায় সারাক্ষণই এক ভয় কাজ করে। অনেকদিন প্রিয় সন্তানকে একটু ছুঁয়ে দেখিনি। প্রতিদিন রুটিন করে দুই থেকে তিন মিনিটের জন্য বেলকনিতে নিয়ে ওর মা দাঁড় করিয়ে দেয় আর আমি নানান মিথ্যে কথার ছলে একটু দেখে নেই। “ওর মা শুধু মিথ্যে আশ্বাস দেয়, এই তোমার পাপা আসবে প্রিয় সব জিনিস নিয়ে। কিন্তু ও জানে প্রতিদিনের মত পাপা আজও ফিরবে না”।

গত ২৯শে জুন (সোমবার) বিকেল বেলা থেকে কেমন যেন একটু ছোট ও ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলাম। সাথে একটু হয়রান ভাবও, পাত্তা দিলাম না কারণ পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক। পরের দিন মঙ্গলবার সারাদিন গেল একই রকম। ভোর রাতে হঠাৎ করে বাম পায়ে প্রচন্ড ব্যথা। বলা নেই এমন তীব্র ব্যথা। হিসেব মিলিয়ে দেখলাম সারাদিন সব সময় যেমন কাজ করি মঙ্গলবারেও তার ব্যতিক্রম কিছু করিনি যাতে এই ব্যথা হতে পারে। একটু খটকা, সন্দেহ ও ভয় জাগলো। সকাল বেলা হাসপাতালে গিয়ে স্যাম্পল দিলাম। সাথে সাথে মানসিক একটা প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। বুধবার তথা ১লা জুলাই পালস্অক্সিমিটার ও একটা অক্সিজেন কনসেন্টেটর মেশিন সংগ্রহ করে ফেললাম। এইবার শুরু হল রেজাল্ট শোনার অপেক্ষা।

যে কোন রেজাল্ট শোনার ব্যাপারেই আমি সবসময় স্নায়বিক চাপে ভুগি। যা খুবই স্বাভাবিক তবে অনেকের চেয়ে একটু বেশি। বাসায় আমার রণসজ্জা দেখে প্রথমে সবাই একটু ঘাবরিয়ে গেলেও পরক্ষণে আমাকে সাহস যোগাচ্ছিল। আমি বাসায় আরো বেশি সতর্ক হলাম, বাসার ভিতরেও মাস্ক পরা শুরু করলাম। সবার কাছ থেকে একটু দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলাম। যদিও এর আগেও সন্দেহ বশত আরো দুই বার স্যাম্পল দিয়েছিলাম। পরে রেজাল্ট নেগেটিভই এসেছিল। স্যাম্পল দেয়ার পর থেকে বেশ স্বাভাবিক। শ্বাসকষ্টও নেই, কোন ব্যথাও নেই। দুদিন পর শনিবার দুপুর নাগাদ সেই কাঙ্ক্ষিত রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসল। এ যেন আরেক যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়া। তারপর থেকে নিজের বাসাতেই আইসোলেশনে কাটতে থাকে সময়। শারীরিক দূর্বলতা যেন গ্রাস করে ফেলেছে শরীরটাকে। তবুও কঠিন কোনো উপসর্গ না পাওয়ায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিনিয়ত শুকরিয়া করে যাচ্ছিলাম। ২০×১০ আয়তনের বন্দী রুমে অস্থির সময় পার হতে থাকে। সঙ্গী এনড্রয়েড ফোনটা আর কিছু বই। দেখতে দেখতে কেটে যায় ৩৬ ঘন্টা। এর মাঝে খোঁজ নেয়নি আমার কোনো উর্ধতন কর্মকর্তা বা আমাদের লোকাল অবিভাবক সিভিল সার্জন স্যার, জেলা করোনা ফোকাল পারসন, লোকাল বিএমএর কোন নামধারী নেতা একটি বারও ফোন করে খবর নিয় নি। এম পি মহোদয় এর যোগ্য আমরা এখনো হয়ে উঠেনি তাই সে ব্যাপারে কিছু না বলাই ভাল। এতদিন দেশের নিকট নিজেকে সংখ্যা বলে মনে হয়েছে, এখন দেখছি নিজের বিভাগের নিকট এর চেয়েও নিকৃষ্ট কিছু। সত্যিকার অর্থে আমি বা আমরা আসলে একটা রোবট ছাড়া কিছুই না। যতক্ষণ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি ততক্ষন শো কজ, পড়ে গেছি তো আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। সবাইকে নিজের গা বাঁচিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়াই যেন চিকিৎসকদের কাম্য। যে রাষ্ট্র পুলিশ পাঠায় কে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছে না দেখার জন্য, যে রাষ্ট্র হুমকি দেয় বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসা চালিয়ে নিবে বলে, যে রাষ্ট্রের জনগণ বলে ডাক্তার পালিয়ে বেড়ায়, চিকিৎসা করবো না বলায় ডাক্তারকে চাকরিচ্যুত করতে দ্বিধা করে না, যে রাষ্ট্র আমলা জনগনকে উসকিয়ে দেয় সে রাষ্ট্র কেমন করে দায়িত্ব নিবে তাদের!

এই রুমবন্দী অস্থির সময়ের মাঝেই শুনেছি নতুন করে সহকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ আর নিজ এলাকায় আমাকে নিয়ে গুঞ্জন। এতো কিছুর মাঝেও ভেন্টিলেটর হিসেবে যখন সদ্যজাত সরকারি ডাক্তার বা সহকর্মীর (৩৯ তম বিসিএস এ নিয়োগ প্রাপ্ত) সাহস যোগানো চিরকুট পাই তখন মনে আশার সঞ্চার যোগায়। উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অসুস্থতার প্রথম দিন থেকেই আমার পিঁছু ছাড়েনি। একজন স্টাফকে রীতিমতো দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন দিপু ভাই এর কখন কি লাগবে এবং নিয়মিত আপডেট তাকে জানাতে। বড় কোন বোন নেই আমার। তিনি যেন সে অভাব পুরণ করলেন। এসিল্যান্ড আমাকে ফোন দিয়ে আমার মুখ থেকেই শুনলেন আমার অসুস্থতার কথা। তিনি যেন কেমন অপরাধবোধে ভুগলেন। এর পর থেকে তিনিও নিয়মিত খোঁজ নেয়া শুরু করলেন। একটা মজার ঘটনা ঘটলো থানার সাথে। করোনা পজিটিভ রোগীদের একটা তালিকা প্রতি দিন থানায় পাঠাতে হয়। ওনারা ফোন করে পজিটিভ রোগীদের। সে হিসেবে আমাকেও ফোন করল। ফোন করার পর অফিসার বলছে, “স্যার রুটিন মাফিক নাম্বার মোবাইলে তোলার পর আপনার নাম্বার দেখে অবাক হয়েছি, খোঁজ নেয়ার জন্য ফোন করলাম।”

ক্ষুদ্র সেই চিরকুট

দীর্ঘ ১৮ দিন কাটালাম একটা রুমে। দুঃসহ সময়, পরিচিত মুখগুলো অপরিচিত হয়ে উঠল। শুনলাম আমার কিছু আত্মীয়ের আমার পরিবারের সাথে খারাপ আচরণের খবর, আমার চাচাতো বোন টিউশনি করতো আমারই আত্মীয়ের বাসায়। আমার করোনা তাই তার টিউশনি চলে যায়। আরেক আত্মীয় আমাকে না জানিয়েই আমার পজিটিভ হওয়ার খবর সবাইকে জানিয়ে দিল যা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছে। প্রথম দিন হালকা শ্বাসকস্ট ছিল। তার চেয়ে বেশি ভয় বা আতঙ্ক কাজ করেছে। সারাক্ষণই করোনার এই যুদ্ধে প্রথম শহিদ ডা. মঈন এর চেহারা আর উনার ছোট বাচ্চা দুটোর ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সামনের খারাপ পরিস্থিতির কথা মনে পরেছে, সারা রাত ঘুমাতে পারতাম না। অজানা এক ভয় পেয়ে বসল। রুমের বাহিরে একটা ছোট টেবিল রাখা হল। তার উপর ওয়ান টাইম ব্যবহৃত প্লেটে খাবার দেয়া শুরু করল। বাহিরে রেখে যায় আর আমি পরে সংগ্রহ করে ভিতরে নিয়ে আসি – এই ভাবেই চলল। টানা নামাজ, বই পড়া, ফেসবুকিং করে সময় কাটানো, মাঝে মাঝে ছেলেটার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতাম। মা আমার সারাক্ষণ পাশের রুমে বসে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াতের শব্দ শুনে আমি আমাদের বর্তমান অবস্থা, আমরা যে বিপদের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি এই জিনিসগুলো আঁচ করতে পারি। আর আমার স্ত্রীর শুরু হল আরেক যুদ্ধ। ওরা সবাই দুই তালায় আমি নীচ তলার শেষ মাথায় একটা ঘরে বন্দী। মানুষ একা থাকলে মনে হয় খাবারের চাহিদাও বেড়ে যায়। একটু পরপর এটা ওটা চেয়ে বেচারাকে বিরক্ত করে ফেললাম। পরিবারের অন্য সবাইও আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। ফোন করে অন্যরা খবর নিচ্ছেন। গত ১১ই জুলাই স্যাম্পল পাঠালাম নেগেটিভ হয়েছি কিনা জানার জন্য। ১৩ ই জুলাই আমার বাদে সবার রিপোর্ট আসল। ল্যাবে যোগাযোগ করলে জানাল একই নামে দুটো স্যাম্পল গিয়েছে। আমার ল্যাব আইডি বলার পর বলল নেগেটিভ কিন্তু কোন পেপারস দিতে পারবে না। বাধ্য হয়ে ১৪ই জুলাই আবার স্যাম্পল দিলাম। ১৬ই জুলাই মেসেজ দিয়ে জানালো আমি করোনা নেগেটিভ। পরপর দুটি নেগেটিভ রেজাল্ট এর একটা বাধ্যবাধগতা থাকাতে আরেকটা স্যাম্পল দেই। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাও নেগেটিভ আসে। তবে করোনা শরীরে মারাত্মক রকম প্রভাব রেখে গেছে দুর্বলতার। সবার নিকট দোয়া চাচ্ছি।

“আমার গল্পটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু আমার বিশ্বাস প্রতিটা স্বাস্থ্যকর্মীর গল্পগুলোও এরকমই। আমরা যারা দেশের সেবায় কাজ করি তারা দেশবাসীর নিকট বেশিকিছু চাই না। জানি আপনারা আমাদের ভুলগুলো দেখবেন, হাইলাইট করবেন। শুধু বলব, দোয়া না করেন, ভাল না বাসেন, অন্তত নিজের জন্য হলেও নিঃশব্দে হলেও ভাল কে ভাল বলেন”।

এভাবেই হাজার হাজার গল্পের চরিত্র যেন একেকজন ডাক্তার। কোথাও গল্পের পরিনতি ঘটেছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, কোথাও এখনো চলছে যুদ্ধ সংগ্রাম আর বাকিদের গল্প মাঝপথে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ২৬০৯ জন এবং এ পর্যন্ত আমরা হারিয়েছি ৮২ জন শহীদ চিকিৎসককে।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

পদত্যাগ করলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ

Tue Jul 21 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। আজ মঙ্গলবার (২১ জুলাই) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারীর শুরু থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বহীনতার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। সম্প্রতি কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo