করোনার দিনগুলোয়- ৬ ।। লকডাউন না ক্লাস্টার লকডাউন?

মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০

লকডাউন না ক্লাস্টার লকডাউন?

লকডাউন শুরু করার আগেই একটি ছবি ফেসবুকে ভাসছিলো যেখানে দেখা যায় একটি লাল গেট তালাবদ্ধ। তার আশেপাশে জমিজমা। ক্যাপশন “বাংলার লকডাউন”। অর্থাৎ চারদিকে সব খোলা শুধু গেইটটা তালাবদ্ধ। মজার ছলে এটি কেউ তৈরী করে থাকলে ও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মানুষজন আগেই অনুমান করতে পেরেছিল। লকডাউন কেমন হতে পারে নেটিজেনরা আগে থেকেই বলে দিয়েছিলো। লকডাউনকে তাৎপর্যপূর্ন করতে আমাদের প্রশাসন, পুলিশসহ আমরা সবাই তৎপর ছিলাম।আমাদের এই সীমিত জনবল দিয়ে এতো বিশাল মানুষের ঢল কন্ট্রোল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।তারউপর মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও বিবেচনায় আনতে হয়।
আমাদের দেশের ভিতরে কর্মরতদের মধ্যে ছোট ছোট গ্রাম্য টং দোকানদার, রিকশা চালক,সিএনজি অটোরিকশা চালক, ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা চালক সবচেয়ে বেশী। এই সংখ্যাটা আসলে অনুমানের চেয়ে ও অনেক বেশী। এই বিশাল শ্রেনী লকডাউনের আওতায় বেকার থাকলে দীর্ঘদিন, দেশে হাহাকার পরে যাবে। আমরা ত্রাণ দিয়ে কতটুকু আর কভার করতে পারবো!
রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশা, ব্যাটারীচালিত অটোরিকশাগুলো কিছুটা ছাড় পেলো কারন এরা রোগী, কৃষিপণ্য আনা নেওয়া করে। যাত্রী নিলে একজন এই শর্তই ছিলো। কিন্তু আমাদের এই ছাড়টুকুর সুযোগ নিয়ে হাজার হাজার অটো রাস্তায়।যাত্রী নিচ্ছে ৫-৭ জন পর্যন্ত। অনেকের হাতেই আবার প্রেসক্রিপশন। ধরলেই ঔষধ আনতে যাচ্ছি। ভাবখানা এমন সারা উপজেলাবাসী এখন অসুস্থ। অটো আটকালেই প্রেসক্রিপশনধারী উপস্থিত। এগুলো বুদ্ধি না কুবুদ্ধি আল্লাহতালাই ভালো জানে!
আমি বরাবরই এই দেশের জনগনের বেশী বুদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। একটি বুদ্ধি ও কোন ভালো কাজে লাগায় না। খারাপ কাজে লাগায় বলেই এতো মারামারি, কাটাকাটি লেগে থাকে সারাবছর। তাই আমি একটু বোকাসোকা ছেলেমেয়েগুলো বেশী পছন্দ করি। কারন এদেরকে গড়া যায়। বুদ্ধিমানগুলো কুবুদ্ধির জন্য কোন কাজ করতে পারে না। বুদ্ধিমানগুলো যদি ভালো কাজে বুদ্ধি খরচ করতো তবে নিশ্চয়ই আমরা ইউরোপের চেয়ে ও উন্নত হতে পারতাম! আমাদের তো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ। এই মাটিতে যা লাগায় তাই হয়। রাম্বুটান যেখানে বিদেশে বছরে একবার হয় আমাদের এখানে দুইবার। এরাবিয়ান খেজুর ও এখানে হচ্ছে অনেক। তার্কিশ মোরগগুলো নাকি দুইবার করে ডিম দেয় বছরে এদেশে অথচ খোদ জন্মভূমিতে একবার।
আমাদের অন্য জেলা কানেকটিং রোডগুলোতে পুলিশ থাকছে। তারপরে ও করোনা আক্রান্ত এপিসেন্টার নারায়নগঞ্জ থেকে শতশত লোক প্রতিদিন সকালে জড়ো হচ্ছে মেঘনার পাড়ে। এপাড় থেকে ওপাড়, ওপাড় থেকে এপাড়। মানুষের প্রয়োজন যেন আর শেষ হয় না। মেঘনা পাড়ি দিতে পারলেই বাঞ্ছারামপুর। যেভাবেই হোক পাড়ি দিতেই হবে। যে কোনভাবেই হোক তারা ম্যানেজ করে পাড়ি দেয়। সম্ভবত আগুনের নদীও তাদের এই যাতায়াত বন্ধ করতে পারবে না।নৌকা কিংবা স্পিডবোটে চড়ে পুলিশের দৃষ্টিসীমার বাইরে গ্রামের ভিতর দিয়ে পালিয়ে এসে হাটতে থাকে জমির আল ধরে। তাদের ঠেকায় সাধ্য কার! নারায়নগঞ্জ ছেড়ে কোনরকমে বাঞ্ছারামপুর ঢুকতে পারলেই যেন করোনা থেকে মুক্তি পাবে।কেননা এখনো এখানে আশংকাজনক কিছু হয়নি।


স্কুলছুটি, অফিস ছুটির এই পর্বটি কাজে লাগাচ্ছেন কিছু মানুষ। তারা কিন্তু শিক্ষিত। শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি বেড়ানোর কাজটা সেরে নিচ্ছেন এর মধ্যেই। সবার মধ্যে উৎসব ভাব। করোনা উৎসব। বাজারে ভীষন ভীড়। এই ভীড় এড়াতে আমাদের জনি চেয়ারম্যান কাঁচাবাজার করলেন মাঠে। তাঁর এই আইডিয়াটা পছন্দ হওয়ায় আমরা সকল কাঁচাবাজার মাঠে করার নির্দেশ দিলাম। যথেষ্ট ফাঁকা রেখে দোকানগুলো বরাদ্দ দেয়া হলো। যেন কোনভাবেই ভীড় না হয়, সামাজিক দূরত্ব যেন বজায় থাকে। তাদের দাঁড়ানোর অবস্থান ও রং দিয়ে মার্কিং করে দেয়া হলো। কে শুনে কার কথা। কোন মার্কিং মানার প্রয়োজনই মনে করে না আমাদের মানুষেরা। এ যেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। আমরা যা বলবো লোকজন তা অমান্য করবে। এটি করতে পারলেই হয়তোবা সমাজে তাদের মান ও বাড়তে পারে!
চেয়ারম্যানগন বাজারগুলো ভালো করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান কিন্তু মানুষজন ভয়ানক অসচেতন। স্বাক্ষরতা বিষয়ক যে কার্যক্রমগুলো বিগত ২০-৩০ বছর ধরে চলছে সেগুলো যদি স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রাম হতো তাতে লোকজন ও আগ্রহ নিয়ে আসতো, সচেতন ও হতো, সরকারের ও হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। পরিবার পরিকল্পনা ও অনেক গতিশীল থাকতো। অশিক্ষিত লোকজন এতো বড় করতো না পরিবারগুলো। আমরা কিন্তু জানি যে যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হবে সেখানের বাকি সব অটোমেটিক উন্নতি হবে। অন্য কারো কিছু ভাবতেই হবে না। উন্নতরা বাজেটের ১৮% বরাদ্দ দেয় কিন্তু ওদের আয়ের বড় অংশ এখান থেকেই আসে। সাথে হেলথ ট্যুরিজম ও হয়। যার সব কিছু মিলে বিশাল ব্যবসা হয়। বাজেটের সব টাকা উঠে ও ওদের লাভ হয়। আর আমরা জন্ম থেকেই জ্বলছি ভর্তূকি দিতে দিতে।
আমার ভাবতেই অবাক লাগে এই মানুষগুলোর মাঝেই আমি বড় হয়েছি, পড়াশুনা করেছি, খেলাধুলা করেছি অথচ পড়াশুনা কম থাকায় তাদের চিন্তার কত দৈন্যতা। কি জানি নাকি আমরাই চিন্তায় দৈন্য হয়ে পড়েছি ব্রিটিশ সিস্টেমে পড়তে গিয়ে! প্রায়ইতো বলা হয় জনগনই সবসময় ঠিক। এটি অবশ্য রাজনীতির কথা।

আজ ও একটি দোকানের সামনে দেখলাম কমপক্ষে বারোজন বসে আছে। এই বেঞ্চি গুলো কিভাবে যেন রয়ে গেছে। আমি যে রাস্তায় গিয়েছি আট মার্চের পর থেকে সেখানেই সব বেঞ্চির পাটাতন উঠিয়ে দিয়েছি। এই দোকানগুলো বন্ধ থাকতো দেখে ভাঙ্গা হয়নি বোধ করি। দুঃসময় কেটে গেলে পাটাতনগুলো বসাতে ৩০-৫০ টাকা খরচ হবে দোকানদারদের।
সন্ধ্যার পরে রোজার আগে পর্যন্ত বিশাল আড্ডা বসার চেস্টা করতো প্রায় সব গ্রামেই। তারা আবার তাদের গ্রাম লকডাউন করে দিতো গাছের গুড়ি দিয়ে। বিভিন্ন গ্রামে রাস্তার পাশে দিনের বেলায়ও এগুলো দেখা যায়। কিছু গ্রামে তো ভয়াবহ অবস্থা। একশত গজ পরপরই রাস্তাবন্ধ। আমি রাত নয়টায় সাসপেক্টেড কোভিড রোগী দেখতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিলো। পুরো রাস্তা জুড়ে বড় বড় গাছের ব্লক। তারা ঢাকা কিংবা নারায়নগঞ্জ থেকে আসা ঠেকাচ্ছে। অনেকেই নাকি মাইক্রো অথবা এম্বুলেন্স ভাড়া করে গ্রামে চলে আসে। এরকম কিছু পরিবার গ্রামবাসীদের অত্যাচারে আবার ফিরে যেতেও বাধ্য হয়েছে। সবই ঠিক ছিলো যদি তারা লকডাউন করে নিজেরা ঘরে থাকতো! কিন্তু তারা তো বিশাল আড্ডায়! কেমনে তাদের বুঝাই যে তোমাদের ঘরে ও এখন করোনা থাকতে পারে!
মসজিদের নামাজ নিয়ে আরেক সমস্যা। কিছু বললেই কাফের পদবী জুটে। অবশ্য আড়ালে আবডালে লুকিয়ে অনেক লোকের জামাত পড়ে ইমাম সাহেব জিহাদ করে ফেলছেন মনে হয়! আমরা আর কিছু বলছি না। তবে নামাজিরা যেন নিজের জায়নামাজ ব্যবহার করে। জায়নামাজ না থাকলে নিজের ধোয়া গামছা অথবা লুঙ্গি যেন ব্যবহার করেন। আপনি নিজে শহীদ হতে চাওয়া আপনার অধিকার,কিন্তু অন্যজনকে আক্রান্ত করে মারা কিন্তু হত্যা।
সবকিছুর পরে আমরা একটি কথাই বলতে পারি যে লকডাউন আমাদের সমাজের সামনে প্রশ্নের সম্মুখীন। কারন কিছু মানুষ মানলে ও বিরাট অংশ মানছে না বলে এটি কার্যকর করা যাচ্ছে না। আর আমাদের সকল স্বাস্থ্য কর্মী এবং ভলান্টিয়ারসহ ও লকডাউন বজায় রাখা যাচ্ছে না আমাদের অসচেতন মানুষের জন্য।

এরচেয়ে সহজে আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো ক্লাস্টার লক। অর্থাৎ, যেখানেই আক্রান্ত সে বাড়িটি লক করা এবং তার ট্রেসিং করে বাকিদেরকে ও এর আওতায় আনা। এ পদ্ধতিতে কোভিড পজিটিভকে বাড়ীতে রেখেই সোশাল সাপোর্ট দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব। সারা গ্রাম লক করে মানুষজনকে অহেতুক কষ্ট দেয়া হয়।তাই আমরা এখন পর্যন্ত কোন গ্রাম লক করিনি।তার মানে এই না যে এখানে কোভিড বেশী। ছোট ছোট দোকানগুলো খুলে দিলে ও কোন সমস্যা হবে না যদি বসার জায়গা না থাকে। চায়ের দোকানগুলো দীর্ঘ দিন বন্ধ রাখলে মানবিক বিপর্যয় কাটানো অসম্ভব হবে। কাজেই ভলান্টিয়ারগন যার যার গ্রামে চায়ের দোকানিকে চায়ের কাপ ফুটন্ত গরম পানিতে দুই মিনিট রেখে সেখান থেকে উঠিয়ে তারপর চা পরিবেশনের পরামর্শ দিতে পারে। এটি কার্যকর হলে আমার উপজেলাতেই কয়েক হাজার পরিবার বিপর্যয় থেকেও রক্ষা পাবে আবার রোগ ছড়ানোরও মাধ্যম হবে না। ডিসপোজেবল কাপ অর্থাৎ, ওয়ানটাইম কাপ ও বিকল্প হতে পারে।
নাস্তা তৈরীর দোকানগুলো থেকে বসার টেবিল চেয়ার সরিয়ে দিয়ে নাস্তা বিক্রির অনুমতি দেয়া যায়। হাতে করে নাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে খাবে অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। এগুলো দোকানদারকে শিখিয়ে দিলেই কাজ হবে যা ভলান্টিয়ারগন করতে পারবেন। লকডাউনের সময় বাড়ানো নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। এটি এদেশের মানুষ মানছে না। তারউপর পুলিশবাহিনী এদের পাহারা দিতে গিয়ে মানুষজনকে ঝাপটে ধরে আটকাতে হচ্ছে। এতে করে তারাও আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। বরং ক্লাস্টার লক করলে এত সমস্যাও পোহাতে হবে না, মানুষেরও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না।

লেখকঃ ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, এফসিপিএস (সার্জারী)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

জামিল সিদ্দিকী

A dreamer who want to bring positive changes in health sector in Bangladesh.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

পিপিইর ঘাটতির বিরুদ্ধে নগ্ন প্রতিবাদ জার্মান ডাক্তারদের

Tue May 5 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০ জার্মানি COVID-19 কে কতটা ভালভাবে মোকাবেলা করেছে তা আমরা শুনতে পেরেছি তাদের বিস্তৃত পরীক্ষার এবং অন্যান্য ব্যবস্থাগুলির মাধ্যমে । তবে জার্মানি তাদের কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল এবং কেয়ার হোমগুলিতে পিপিইর ঘাটতিও দেখেছিল। জার্মান General practitioner(জিপি)- রা একটি অনলাইন প্রচার শুরু করেছিলেন যাতে তারা তাদের কর্মক্ষেত্রে নগ্ন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo