করোনার দিনগুলোয়- ৪ । আমাদের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট । ডা. মোহাম্মদ আল মামুন

মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০

১। সেদিন একজনের মৃত্যুর পর চারদিক থেকে ফোন আসতে শুরু হলো। তাদের ধারনা রোগীটি মনে হয় করোনায় মারা গেছে। এখনকার এসময়ে এরকমটা হওয়া স্বাভাবিক। করোনায় মারা যেতে পারে যে কেউ। আমরা ও ব্যাপারটাকে হালকা করে দেখি না। মৃত্যুর সময়টা জেনে দেখলাম এক ঘন্টা হয়েছে মাত্র, কাজেই মৃত ব্যক্তির স্যাম্পল নিলে রিপোর্ট করা যাবে।আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছিলাম যে তিনঘন্টার ভিতর পরীক্ষার স্যাম্পল নিলে রিপোর্ট করা যাবে, এরপরে আর লাভ হবে না যদিও তথ্যগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত নয়। সেই মোতাবেক আমার ল্যাব টেকনোলজিস্টকে খেয়েদেয়ে তৈরী হতে বললাম। তখন বাজছিলো দুপুর ১:০০টা। আমি ও তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে আসলাম। এটি ছিলো আমাদের প্রথম স্যাম্পল কালেকশন।
আমাদের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রেডি হতে পারছেন না। একঘন্টা পরে এসে জানালেন তিনি খান নাই এখনো। আমি বসে থেকে তাকে খাবার জন্য সময় দিলাম। এরমধ্যে অন্যান্যরা সবকিছু রেডি করে ফেলেছে। গাড়ী নিয়ে টেকনোলজিস্টের অপেক্ষায় আছি অফিসে বসে। আধ ঘন্টা পরে এসে বললো এখনো খায়নি সে, দরকারি কয়েকটা ফোন করেছে। বউ বাচ্চার সাথে কথা বলেছে। তাড়াতাড়ি তাকে খেয়ে নিতে বললাম। সে খেতে গেলো। আরো আধঘন্টা শেষ সে আসছে না। ফোন দিচ্ছি, ফোন ব্যস্ত। কেউ ফোনে পাচ্ছে না তাকে। অতঃপর আমার অফিস সহকারীকে পাঠালাম তাকে ডেকে আনতে। তাও পৌছাচ্ছে না, এদিকে সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। তিনটা বেজে গেলো প্রায়।
শেষমেষ পুলিশ পাঠালাম ধরে আনতে তাকে। অতঃপর তিনি আসলেন। এসেই জানালেন তার বস্ যিনি এক্সপার্ট তাকে বলেছে N-95 মাস্ক ছাড়া কোন স্যাম্পল কালেকশন করবে না। আমি বললাম ডবল সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করবেন। তার অজুহাত অব্যাহত। তার বস্ তাকে নিষেধ করেছে N-95 মাস্ক ছাড়া স্যাম্পল নিতে। আমি চুপ। বললাম N-95 মাস্ক নেই কোথাও এদেশে। কেউ এটি দিয়ে কালেকশন করে না। আইইডিসিআর ও না। অথচ প্রতিদিনই পরীক্ষা হচ্ছে। অতঃপর বললাম ত্রিপল স্তরের পপলিন কাপড়ের মাস্ক আছে ওটা ও ব্যবহার করবেন। চশমা পরবেন, পিপিই পরবেন। তারপর স্যাম্পল কালেকশন করবেন। তার অজুহাত চলছেই। তার এটিচিউড দেখে মনে হচ্ছিলো তাকে কোরবানীর জন্য নিয়ে যাচ্ছি। গত ঈদে আমার ছাগলটা কোরবানীর জন্য যখন নিচ্ছিলাম তখন এমন করেছিলো। আমি কাউন্সেলিং করলাম যে আপনাকে মারতে কিংবা কোরবানি দিতে নিয়ে যাচ্ছি না আমি। আপনি যদি আক্রান্ত হোন তবে এটি আমার ডিসক্রেডিট।কারন এতে কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। কাজেই আমার প্রয়োজনেই আমি আপনাকে সুস্থ রাখতে চাই। আপনি এতো ভয় পেলে কাজ করবেন কি করে? ভরসা রাখুন আপনাকে মিসলিড করছি না। একটু কাজ হলো। কাঁপতে কাঁপতে বললো আমিতো স্যার পিপিই পড়তে পারি না। বললাম ” শিখিয়ে দিবো”। অতঃপর কাঁপাকাঁপিসহ একজন যন্ত্রমানবকে নিয়ে লাশের পাশে উপস্থিত হলাম। পিপিই পড়ালাম। সবকিছু রেডি করে স্যাম্পল নিতে বললাম আর আমি এসিস্ট্যান্ট পিপিই ছাড়া। শুধু সার্জিক্যাল মাস্ক আর কুখ্যাত সরকারি নতুন সাপ্লাই এর গগলস পরা আমি। অতঃপর তার স্যাম্পল নেয়া শেষ হলো। বহু কষ্টে তার স্যাম্পল নেয়া শেষ হলো। অবশ্য লাভ হয়নি এ স্যাম্পল কালেকশন করে। আমি দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম ৫:০০ টায়।

২। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এর ভীতি দেখে কাঁচের বক্স করার চিন্তা করলাম।যার ভিতর থেকে বড় গ্লাভস এর ভিতর দিয়ে স্যাম্পল কালেকশন করা যাবে।এক্ষেত্রে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রোগীর সাথে যে কোন প্রকার টাচের বাইরে থাকবে।রোগী হাঁচি দিলে ও গ্লাসে আটকে যাবে। আর ওর সামনের দিকটা হবে এয়ার টাইট। যেখানে বাতাসই ঢুকতে পারবে না সেখানে জীবানু ঢুকবে কিভাবে?
বক্সের নীচে দিয়ে একইঞ্চি পরিমান ফাঁকা আছে।এদিক দিয়ে ও জীবানু যাওয়ার ঝুকি নেই। তবে তিনিএকজনকে দিয়ে চারদিক দিয়ে বালু দিয়ে এতো সুন্দর বক্সটিকে একটি চমৎকার গোয়ালঘরে পরিনত করলেন। এখানে মানুষ নয় গরুরা আসবে স্যাম্পল দিতে, গরুরা কাজ করবে এখানে কোন শিক্ষিত মানুষ নয়।

৩। অতঃপর স্যাম্পল কালেকশন এর পালা। এই বক্সের ভিতরে থেকে যে স্যাম্পল নিবে সে গ্লাভস পরলেই যথেষ্ট। বাইরে পলিথিন দেয়া আছে। বাতাস ঢুকবে না। মাস্ক না পরলেও ক্ষতি নেই। তবে এখনকার সিস্টেম অনুসারে সার্জিক্যাল মাস্ক পড়বে সবাই। তিনি পড়লেন পিপিই শু কাভার সহ। সার্জিক্যাল মাস্ক + N-95 সমমানের মাস্ক পরলেন। ভালো মানের গগলস পরলেন। তারউপর আবার খুব ভালো কোয়ালিটির ফেসশিল্ড পরলেন। ও,হ্যাঁ, তার কান্নাকাটি দেখে আমার আরএমও ডবল স্তরের পলিথিন দিলেন বক্সের ছিদ্রটিতে। সব কিছুর পরে তিনি অন্ধের মতো হাতড়াতে লাগলেন।কারন এতো স্তরের সিকিউরিটি নেয়ার পর চোখে কিছুই দেখছেন না।স্যাম্পল কালেকশন কি করবেন আর?
আমরা ডাক্তারগনই অনেক স্যাম্পল নিলাম। তার উপর ভরসা করার সুযোগ কোথায়! বেশ কয়েকটা পরীক্ষার স্যাম্পল নষ্ট হয়ে গেছে, তাই আমরাই যথাসম্ভব কাভার করছি। এখন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ইপিআই কাভার করছে কিছু। তাই রক্ষা। ডিপ্লোমা লেভেল দিয়ে খুব কম সংখ্যক সমস্যাই কাভার করা যায়।

আপনারা চান ভালে সার্ভিস,আমরা ও দিতে চাই। সার্ভিস মানেই শুধু ডাক্তার নয়। এর সাথে জড়িত আছে নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজি, ক্লিনিং, অফিস সবই। এই দুয়ের মাঝের এই গ্যাপটুকু পূরন করতে লাগবে কয়েকযুগ যদি সিস্টেমটার সংশোধন না হয়। এ সিস্টেমটা আমরা তৈরী করিনি। আমাদের হাতে যদি সকল ধরনের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেয়া হতো এ মন্ত্রণালয়ের তবে এরকম অবস্থা হতো না। আমরা বহু আগেই এইসব গ্রাউন্ডলেভেলের পড়াশুনা বাদ দিয়ে উন্নত করতাম। দুঃখ হলো এ দেশটা চলে সর্ববিশেষজ্ঞ দিয়ে। যিনি অর্থনীতি দেখেন তিনিই আবার কৃষি,স্বাস্থ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং দেখেন। সেলুকাস! এদেশের সবকিছু সবজান্তা শমসের দ্বারা পরিচালিত হয় প্রকৃতপক্ষে যাদের কাজ হয় সবকিছুতে বাধা দেয়া মাত্র।
এই কথাগুলো বলতাম না প্রকাশ্যে। এদেশের মেডিকেল সিস্টেমটাকে তলানিতে রেখে দিয়েছে কিছু গোষ্ঠী তাই বলা। এ তালিকায় ডাক্তারও আছেন। মেডিকেল সার্ভিসের সবটুকুই একটি টিমওয়ার্ক। এখানকার একটি সিস্টেম দূর্বল হলে সার্ভিস ডাউন হতে বাধ্য। আর এগুলো থেকে উত্তরনের উপায়গুলো হলো-

১। বিএসসি ইন মেডিকেল টেকনোলজি চালু করা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। অর্থাৎ, সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই এটি চালু করা প্রয়োজন যেন প্রচুর সংখ্যাক টেকনোলজিস্ট বের হয় যাদের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া যায়।প্রথম /দ্বিতীয় শ্রেনীর মর্যাদা দিয়ে চাকুরী দেয়া যেতে পারে প্রমোশনের সুযোগ সহ।
যারা ইতিমধ্যে ডিপ্লোমা করেছে তাদেরকে বিএসসি পড়তে উৎসাহিত করা,অথবা তারা সহকারী হিসেবে কাজ করবেন।যন্ত্রপাতি ধোয়ামোছা করবেন, গ্রাজুয়েট টেকনোলোজিস্টের কথা শুনবেন,কাজ করবেন। বিএসসি নিয়োগ হলে ভালো ছাত্রছাত্রীরা এটি পড়বেন।মেধাবী মুখ এই কাজের জন্য পাবেন।

২।বিএসসি ইন নার্সিং এর আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান চালু করা।যত নিয়োগ হবে সব যেন বিএসসি দেয়া যায়।এতোবেশী নার্স তৈরী করা প্রয়োজন যেন উপজেলা লেভেলে পর্যন্ত কাভার দেয়া যায় এবং যাদের সংখ্যা ডাক্তারের সংখ্যার দ্বিগুন হয় কমপক্ষে।বিএসসি নার্স বিদেশে ও চাহিদা আছে এবং এ চাহিদা আরো বাড়বে, কমবে না কখনোই।ডিপ্লোমা কোর্সগুলো কমিয়ে দেয়া কিংবা বন্ধ করা যেতে পারে।বিএসসি হলে মেধাবী ছাত্রছাত্রী এখানে ভর্তি হবে এবং দায়িত্ববোধ আরো ভালো হবে।

৩।কারিগরি শিক্ষাটা বাস্তবসম্মত হওয়া প্রয়োজন।যেমন ওয়ার্ড বয় নিবেন তবে সে যেন চার বছরের ডিপ্লোমা নিয়ে আসে।ক্লিনার নিবেন সে যেন এর উপর ডিপ্লোমাধারী হয়।মেডিকেল ক্লিনিং এর উপর জ্ঞান এবং বাস্তবসম্মত ট্রেনিং না থাকলে ওরা কাজ করে ও না,পারে ও না।

ঘরে থাকুন
সুস্থ থাকুন।

লেখকঃ ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস, এফসিপিএস(সার্জারী)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

জামিল সিদ্দিকী

A dreamer who want to bring positive changes in health sector in Bangladesh.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

নমুনা পরীক্ষায় অনলাইনে টিকেট দিবে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ

Tue Apr 28 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮শে এপ্রিল,২০২০ইং করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ টেস্টের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে উপচেপড়া ভিড়। সময়মতো নমুনা দিতে না পারায় অনেককে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। সেইসাথে মানা হচ্ছে না কোনো সামাজিক দূরত্ব। এর ফলে অজানা আক্রান্তদের কাছ থেকে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। ভোগান্তি কমাতে এরই মাঝে ব্যাবস্থা নিয়েছে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo