করোনার দিনগুলি- ৬

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০২ মে ২০২০, শনিবার:

অধ্যাপক ডা. আহমেদউজ জামান
বিভাগীয় প্রধান, সার্জারী বিভাগ
শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

গতকাল (৩০ এপ্রিল) রাত সাড়ে দশটার দিকে সার্জারীর আর এস (রেসিডেন্ট সার্জন) জানালেন একিউট এবডোমেনের একটা মহিলা রোগী ইমার্জেন্সি রুমে এসেছেন। আমার অনুমতি নিয়ে তিনি রোগীকে ভর্তি করলেন। নির্দেশমতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দিলেন।

সকাল ১০ টা নাগাদ আর এস জানালেন রোগীর Abdomen Distended, Lower Abdomen এ Tenderness আছে, Total WBC Counts- 15000/cumm, Hb- 07 mg/dl. আমি আল্ট্রাসনোগ্রামের কথা বললাম। আজ (০১ মে) শুক্রবার, তাই আগামীকাল করাতে চাইলো। আমি আল্ট্রাসনোলজিস্টকে কল দিতে বললাম।

কিছুক্ষণ পর সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মেহেদী হাসানকে মোবাইল করলাম। মেহেদী জানালো আল্ট্রাসনোলজিস্টকে কল দেওয়া হয়েছে। আমি বললাম জুম্মার (লকডাউনের কারণে জোহরের) নামাজ শেষে দুপুর পৌনে দুটোয় হাসাপতালে আসবো রোগীকে দেখতে। মেহেদী বললো সেও হাসপাতালে থাকবে।

যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেখি মেহেদী হাসপাতালের গেটেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি এগুতে গেলে সে বললো, আমি একটু আসছি স্যার। আমি দাঁড়ালাম। গেটের অপরদিকের দোকান থেকে ২ প্যাকেট চিপস হাতে এগিয়ে এলো। বললো, ‘বাচ্চাটার জন্য আনলাম।’

আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। মেহেদী বিবাহিত তা জানি (ভাবীসহ ২/১ টা অনুষ্ঠানে দেখেছি), কিন্তু তাদের চিপস খাওয়ার মতো বাচ্চা আছে তা তো জানিনা! হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘কাল রাতে ২ টা ডিম সিদ্ধ খাইয়েছি, সকালে চিপস খেতে চেয়েছে।’ তখন আমার মনে পড়লো, গতকাল আমরা ৫/৬ বছরের একটা অগ্নিদগ্ধ রোগী ভর্তি করেছি। বাইশ দিন আগে পুড়েছে। পুরো পিঠ, বুক-পেটের কিছু জায়গা, দুই বাহুর কিছু অংশ পুড়ে গেছে। বাবা অত্যন্ত গরীব, গায়ের ছেঁড়া শার্টটা দেখলেই বুঝা যায়। তারপরও মেয়ের চিকিৎসার জন্য স্হানীয় উপজেলা হাসপাতাল থেকে ঢাকার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট পর্যন্ত গিয়েছে এই লকডাউনের মাঝেই। টাকা-পয়সা যা ছিল সব শেষ।
অনন্যোপায় হয়েই বাড়িতে টোটকা চিকিৎসা করাচ্ছিলো। আমাদের হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বাচ্চাটার খবর পেয়ে গ্রাম থেকে আনিয়ে আমাদের ইউনিটে ভর্তি করিয়েছেন।

যে রোগীর জন্য হাসপাতালে এসেছিলাম তাকে দেখে বাচ্চাটার কাছে গেলাম। গতকাল যখন বাচ্চাটাকে প্রথম দেখি তখন তাকে খুব অতিষ্ঠ (irritated) মনে হচ্ছিল। আজকে সে অনেকটাই স্বাভাবিক। মেহেদীর আনা চিপস অনেক আগেই তার কাছে পৌঁছে গেছে। আপন মনে, মাথা নিচু করে অন্য রোগীদের আড়াল করে বাচ্চাটা চিপস খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী খাও? মাথাটা সামান্য উঁচু করে হেসে দিলো মেয়েটি। মেহেদীর দিকে তাকালাম, সেও হাসছে।

ডাক্তাররা এমনই। রোগীর আনন্দে তারা হাসে।
রোগীর দুঃখে তারা কাঁদে। একজন প্রকৃত চিকিৎসক হতে হলে এই মানবীয় পরম গুণটুকু তাকে অর্জন করতেই হয়।

সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিটি সদস্য যেমন দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে বদ্ধপরিকর, মানবতার সেবা করতে, যে কোন পরিস্থিতিতে রোগীকে চিকিৎসা দিতে ডাক্তাররাও তেমনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু যথাযথ পোশাক-সমরাস্ত্র ছাড়া একজন সৈনিক (হোক সে সেপাই বা জেনারেল) কি যুদ্ধক্ষেত্রে যায়? তাকে কি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়? (সুইসাইডাল স্কোয়াড ছাড়া)। তাহলে একজন চিকিৎসকে কেন সকলে (রাষ্ট্র, সরকার, মন্ত্রী, প্রশাসন, মিডিয়া, টকশোজীবি) সবাই মিলে বিনা পোশাকে, বিনা অস্ত্রে (সরঞ্জামে) ভাইরাসবিরোধী যুদ্ধে নামতে বলছেন?

একজন প্রকৃত চিকিৎসক ছাত্রজীবনে লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ এবং চাকুরিজীবনে পেশাগত বিষয় বহির্ভূত কোন কিছুই বোঝে না। দেশের রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কূটচাল বোঝার ক্ষমতা (মেধা) তারা কোনদিন অর্জন করে না।

সাধারণ চিকিৎসকেরা নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে উচ্চসুদের ব্যাংক লোন করে গাড়ি কিনেন, পরিবারের চাপে হোম লোন নামক ফ্লেক্সিবল লোনের (যার সুদ শুধু বাড়তেই থাকে) আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে ৮ টা- ২ টা চাকুরী আর বিকাল থেকে মধ্যরাত অবধি প্রাইভেট প্রাকটিস নামক যন্ত্রণাবহুল এক পেশায় নিজেকে উজাড় করে দিতে বাধ্য হন (স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করার নরক যন্ত্রণার কথা আর বলতে চাই না)।

এতকিছুর পরও এদেশের চিকিৎসকদের মানবিক গুণাবলি উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক বেশি। উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকররা চিকিৎসা দেন মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রেসক্রিপশন অনুয়ারী। (যারা উড়োজাহাজ ভাড়া করে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যান তাদের কথা বলতে পারবো না)। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের রোগীর অর্থনৈতিক অবস্থা, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছু বিবেচনা করে চিকিৎসা দিতে হয়।

আমি বলি, এদেশে ডাক্তারের কথায় রোগী চলে না, রোগীর কথায় ডাক্তার চলে।

সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্হাপনার কথা লিখতে চাইনা। ক্যাডার বিষয়ক আলোচনা আজ থাক, অন্যদিন করা যাবে। এই মূহুর্তে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কিছু চিকিৎসক প্রয়োজন। তাই ৩৯ তম বিসিএসে অংশগ্রহণকারী যারা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কিন্তু অজ্ঞাত কোন কারণে তাদের অদ্যাবধি নিয়োগ দেয়া হয়নি তদের মধ্যে দুই হাজার জনকে নিয়োগের ত্বরিত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। (এত দ্রুততার সাথে ইতিপূর্বে কোন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মহোদয় জানালেন)।

যারা মনোনীত হয়েছেন তারা খুব খুশি, খুশি হওয়াই স্বাভাবিক। আজ সন্ধ্যায় ২/১ জন বিভিন্ন চ্যানেলে তাদের উচ্ছ্বাস-প্রত্যয়, সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। নব যৌবনের নব উদ্যোমে (সরকারি চাকুরির শুরুতে যা হয়ে থাকে) এই নব্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকগণ হিপোক্রেটস Oath (General Principles of Geneva Convention) আত্মস্থ করে করোনা মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তাদের সে যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হোক।

আচ্ছা, তদের নিয়োগ কী কারণে এতোদিন ‘ডিপ ফ্রিজে’ ছিলো তা তো কেউ জানতে চাইলো না।
নব নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের কী করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে? নাকি তাদেরও ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার বানানো হবে?

পিপিই, N95 মাস্ক, ভেন্টিলেটর, বরখাস্ত, ওএসডি, বদলী, শো-কজ, টেস্ট-টেস্ট-টেস্ট, গণস্বাস্থ্যের টেস্টকিট এসব চাপা পড়ে থাকুক।

“চিকিৎসক মাত্রই কোনরূপ অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সর্বদা মানবতার সেবা করিবেক।”

(পরিমার্জিত)

Abdullah Al Maruf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পুলিশ সুপারের উপহার ও চিঠি

Sat May 2 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শনিবার, ২ মে, ২০২০ পিরোজপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) হায়াতুল ইসলাম খান করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের প্রশংসা করে তাঁদের পাশে থাকার কথা জানিয়ে চিঠি ও উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছেন। এসপির চিঠি পেয়ে চিকিৎসকেরা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁকেও চিঠি ও উপহার পাঠিয়েছেন। করোনাকালে সেবাদানকারী দুই পেশার কর্মকর্তাদের মধ্যে এ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo