এদেশের চিকিৎসকগণ পেশাদার হয়ে উঠতে পারেন না কেন?

১১ এপ্রিল ২০২০: ২০২০ সালের ৪ এপ্রিল প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ১৯৮ জন ডাক্তার মারা গিয়েছেন। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এসব চিকিৎসকের গড় বয়স ৬৪ বছর। (যাদের বয়সের সীমা ২৮ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে)। মৃতদের মধ্যে ৯০ শতাংশই পুরুষ। জরুরি বিভাগ, ইন্টার্নশিপ, শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞ, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট— এর ৫২ শতাংশই মৃতদের তালিকায় ভিড় জমিয়েছেন। হিসেব বলছে, ইতালিতে মারা গেছেন ৭৯ জন, ইরানে ৪৩ জন, চীনে ১৬ জন, ফিলিপাইনে ১৪ জন, আমেরিকাতে ৯ জন এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৭ জন। আজকের দিনে এসে নিশ্চয়ই মৃতের হিসেব এই সংখ্যায় আটকে নেই। বলাই বাহুল্য মৃতের এই গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী।

ব্যাপার না। মরতেই পারে। এরা কসাই। এদের মধ্যে মানবিকতাবোধের বালাই নেই— এমন চাপা ক্ষোভ কম-বেশি সবার মধ্যে থাকতে পারে। অন্তত বাংলাদেশে বসে যে কেউ ডাক্তারদের প্রতি এমন নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেই পারেন। এক সময় আমিও করতাম। করার পিছনে কারণও আছে। অভিজ্ঞতা আমাদের একই জিনিসকে আলাদাভাবে পরিচয় করায়।

সেই কারণটা এবার বলি। একবার আমার বন্ধুর বাবার হার্নিয়ার অপারেশন করানো হবে। কিশোরগঞ্জ শহরের সুপরিচিত সার্জন। বন্ধুটি সেই সার্জনের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘এ একটা মেছো (মাছ বিক্রেতা)। চিকিৎসা করতে আসে নাই, যেন মাছ বেচতে আসছে।’ বন্ধুটির বিস্ময় ছিল, একজন প্রাজ্ঞ সার্জনের আচরণ এতটা রূঢ ও নিম্নশ্রেণীর কেন?

আমার ঘটনা বলি। এই চিকিৎসকও শহরের সুপরিচিত। সবচেয়ে ভালো ব্যবসা বোধহয় তিনিই করছেন। তার কাছে গেলাম চিকিৎসার জন্য। যথারীতি পরীক্ষা-টরীক্ষা করা হলো। রিপোর্ট নিয়ে তার সামনে বসে আছি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাইয়া, আমার সমস্যা কী? তিনি খুব সাবলীলভাবে বললেন, ‘সে আপনি বুঝবেন না।’ ঘাউরামি শুরু করলাম, ‘না বুঝলে বুঝাইয়া দেন।’ তিনি বিরক্তিভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকালেন, ‘আরে ভাই, যে ওষুধ লিখে দিছি, সেই ওষুধ খান। আর পনেরো দিন পর এসে দেখা করবেন।’ এই বলে তিনি তার কলিং বেলে চাপ দিয়ে দিয়েছেন। এর মানে হলো, পরবর্তী খদ্দের কে? জলদি আসুন। দুজন হাতপাকা ডাক্তারদের অপেশাদার বাণিজ্যিক আচরণে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। এদের প্রতি আমার এখনও রাগ হয়। তারা কেন এত বাণিজ্যিক!

ডাক্তারদের কাছ থেকে সাধারণ রোগীরা কী চান? কেবল ব্যবস্থাপত্র? নাকি মানসিক সাহস? একজন চিকিৎসক যদি তার রোগীর পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আরে ধুর, কী হয়েছে এমন? খামাকা মুষড়ে পড়েছেন কেন? কিচ্ছু হয়নি আপনার। একদম চিন্তা করবেন না।’ এর চেয়ে বড় টনিক আর কী আছে? রোগীর কাছ থেকে সেই ডাক্তার কত টাকা ফিস নিয়েছেন, রোগী কস্মিনকালেও মনে করতে চাইবে না। একজন ডাক্তার তো এভাবেই হয়ে উঠতে পারেন নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘ভগবান’!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এদেশের চিকিৎসকগণ এমন পেশাদার হয়ে উঠতে পারেন না কেন? এর জবাব পাওয়ার জন্য আপনি আপনার জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে গেলেই বুঝতে পারবেন। আমাদের জেলা সদরের হাসপাতালে শয্যা আছে ২৫০টি। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, কোনোদিনই রোগীর সংখ্যা তিনশোর চেয়ে কম থাকে না। হাসপাতাল যেহেতু ২৫০ শয্যার, নিশ্চয়ই সেখানে লোকবল, যন্ত্রাদি তথা চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা ৩০০ জনের অনুপাতে করা নয়। এর ভেতরেও ডাক্তার, নার্স বা স্টাফদের থাকতে পারে মাতৃত্বকালীন ছুটি, উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ছুটি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে পদ খালি থাকা তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাহলে বিষয়টা কেমন জটিল হয়ে ওঠছে দেখুন!

আর হাসপাতালের চিত্র কী? বড় বড় করে লেখা থাকে, ‘মহিলা ওয়ার্ড। পুরুষের প্রবেশ নিষেধ।’ সেখানেই সুড়সুড় করে ঢুকে পড়েন। আয়া, নার্স বা ডাক্তার বাধা দিলে কী করেন? ‘আমারে চিনেন?’ কাহিনি শেষ। দ্বিতীয়বার কেউ আপনার পরিচয় জানতে চাইবেন না। সে সাহস করাও পাপ। যে নেতার পরিচয় দিয়ে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আপনি পুরুষ হয়ে নারীদের ওয়ার্ডে নায়কোচিতভাবে ঢুকে গেলেন, সেই নেতার বোধহয় কস্মিনকালেও আপনার কথা মগজ বা মাথায় নেই। অথচ তাকে ব্যবহার করে আপনি হয়ে গেলেন মি. হনু। ‘পলিটিক্স কিসের জন্য করি?’—ভাব নিয়ে যে আপনি আপনার দেশের সিস্টেমটাকে খেলে দিলেন, তা কিন্তু ভুলেও চিন্তায় এলো না। বিভিন্ন টেন্ডার এলে পার্সেন্টিজের ব্যাপার-স্যাপার না হয় তোলা থাক। এই কমিশনে যে হাসপাতাল বা ডাক্তারদের কর্মদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবহার সীমিত হয়ে গেল, তা অদৃশ্যই থাকবে।

হাসপাতালগুলোর দেয়াল দেখেছেন? পানের পিকে রঞ্জিত দেয়াল কেমন করে দাঁত ভেঙচায়? ভালো করে দেখলে যে কেউ তাকে খেয়ালী চিত্রকরের কোনো সৃষ্টিকর্মও ভেবে থাকতে পারেন। হাসপাতালের মতো জায়গায় অন্য কোনো দেশের জনগণ ধূমপান করে কি না— জানা নেই। তবে প্রায়শই বিরক্ত হয়ে হাসপাতাল প্রশাসনের কাছে আমাদের নালিশ করতে মন চায়, ‘আচ্ছা ভাই, আপনারা এমন কেন? ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার রেখেছেন ভালো কথা। আমাদের স্মোকিং জোন কই?’

সারাজীবন অভাবে অনাহারে মরতে থাকলেও যেসব নিকট-আত্মীয়, দূর সম্পর্কের আত্মীয়, পড়শি কস্মিনকালেও কোনো খোঁজ নেয় না, যদি জানতে পারে আপনি অসুস্থ। তবে আর রক্ষে নেই। তারাই দেখবেন হাসপাতালটাকে পাউরুটির দোকান ও কলামহাল বানিয়ে ফেলেছে। রোগীদর্শন নয়, যেন পিকনিক। অবান্তর গসিপিং তো আছেই। রোগী হিসেবে আপনি অনেক আগেই এক্সট্রা। ইতিমধ্যে সব শয্যা রোগীতে দখল। আপনার জন্য আগে থেকেই কোনো সিট বরাদ্ধ নেই। নিশ্চিত আপনাকে করিডোরে, বারান্দায়, চিপাচাপায় ময়লা-মলিন বিছানায় ঠাঁই পেতে হয়। জায়গার সংকুলান তো হলো। কিন্তু আপনার জন্য নার্স, টেকনোলজিস্ট, ডাক্তার, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি? তার ব্যবস্থা কে করবে?

তাও ভালো। কোনো রকমে চালানো গেলো। ডাক্তার আপনাকে বললেণ, ‘আজ থেকে একটাও বিড়ি/সিগারেট নয়।’ আপনি কী করলেন? দাঁত খেলিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, ‘স্যার, বিড়ি না খাইলে তো আমার চলবেই না!’ এই অবস্থায় ডাক্তারদের উচিত, এক বস্তা সিগারেট আপনার পাশে রেখে যাওয়া। ডাক্তার শ্রেণীটাই কসাই গোত্রের, তাই তারা আপনার-আমার সে কষ্ট বোঝেন না।

যে ডাক্তার দায়িত্ব পালন করার সময় জেনে এসেছেন, তিনি মাত্র পাঁচজন রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিবেন, তিনি এসে দেখলেন একই সময়ে তাকে পনেরোজন রোগীকে সেবা দিতে হবে। এই অবস্থায় তিনি কি আপনাকে মির্জা গালিবের কবিতা শোনাবেন? না চৌরাসিয়ার বাঁশি বাজিয়ে আপনাকে বিনোদিত করবেন? এমনটা কি আশা করা যায়?একটা সফল সার্জারির পরে কয়জন সার্জনকে এক তোড়া ফুল দিয়ে বলেন, ‘থ্যাংকিউ ডাক্তার!’ অথচ সাড়া দিতে সামান্য দেরি করলেই হাসপাতালের কাঁচভাঙা, গায়ে হাত তোলা, নেতা দিয়ে শাসানোর ব্যবস্থা করে ফেলেন।

এবার আসুন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করা যাক। আমরা তো সেই ৩১ ডিসেম্বর থেকে জেনে এসেছি, করোনা নামক ভাইরাস কাউকেই করুণা করছে না। তবে কেন আমরা চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করিনি? কেন আমরা একে ‘সাধারণ জ্বর’ বলে চালিয়ে দিই? পিপিইয়ের অভাবে যেখানে ডাক্তারগণ হা-হুতাশ করে জীবনের ঝুঁকি নেন, সেখানে প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে পিপিই-এর ফ্যাশন শো কেন হয়? বলতে পারেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কে দেবে? চিকিৎসা সেবায় সংশ্লিষ্টদের সংক্রমিত হয়ে মরলে মৃতের পরিবারের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক সুবিধাদি দেওয়া হবে, তাদের জন্য বিশেষ বীমা-পলিসি আছে— এমনটা শুনিনি আগে। এসবের দরকার নেই কি? কেন ডা. মইনের মতো একজন চিকিৎসক সিলেটের মতো বিভাগীয় শহরে অবস্থান করেও ভেন্টিলেশন সুবিধা পাবেন না? সাধারণেরা তাহলে কোথায় যাবে? তার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কেন নয়?

এবার আসুন উপরের সারণিতে। যারা মারা গেছেন, তারা আমাদের মতো এমন নাজুক পরিবেশে কাজ করে মারা যাননি। ব্যতিক্রম বাদে, প্রায় সব দেশের চিকিৎসকগণই আমাদের দেশের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুরক্ষিত। তবু এদের মৃত্যু ঘটছে। তাহলে আমাদের দেশের চিকিৎসকগণ কতটা ঝুঁকিতে আছেন? এই ঝুঁকি নিয়েও তারা যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, এটা কি আমাদের জন্য একটু বেশিই প্রাপ্য নয়?

উপরে উদাহরণ দেওয়া ডাক্তার ছাড়াও আরো অনেক ভালো ডাক্তার আছেন। যাদের কাছে টাকাই বড় কিছু না। যারা ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে গেলে অশ্রুসিক্ত হন। নিজ গাঁটের পয়সা খরচ করে গরীব দুস্থদের চিকিৎসা সহায়তা দেন। সে খবর খুব আড়ালে থাকে, কারণ এদের নিজস্ব সংবাদদাতা বা ফটোগ্রাফার নেই। নেই বিশেষ প্রচারণা সেলও। যারা নিজ উদ্যোগে বিনামূল্যে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলোকে সেবা দেন, তাদেরকেও প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। ঘরের খেয়ে কেন তারা বনের মোষ তাড়ান— সেই প্রশ্নও করি, ‘এটা কি তবে আপনার প্রচারণারই অংশ? না চ্যারিটি?’

করোনা-পরিস্থিতিতে যেসব চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অন্তত সামান্য সম্মানটুকু দিই, চলুন। যারা জনগণের বোনকে বিয়ে করতে চায়, চাল চুরি করে নিজের পেট ভরতে চায়, তাদের তো বহুবার স্যালুট/স্লোগান দিয়েছি, এবার না হয়, চিকিৎসক ও চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টদের জন্য হাত ও আওয়াজ তুলি? কেমন?

জামাতুল ইসলাম পরাগ

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ঃ আমাদের ডাক্তাররা কি করছেন? পর্ব ২

Sat Apr 11 , 2020
শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২০ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী করোনা ভাইরাস। এর দ্বারা সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশেও। এই যুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধা হচ্ছে আমাদের চিকিৎসকেরা। তাদের সম্মানার্থেই আমাদের এ নিয়মিত আয়োজন “আমাদের ডাক্তাররা কি করছেন”। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ণ চিকিৎসক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, “আমরা আপনাদের জন্যে হাসপাতালে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo