রামু আইসোলেশন সেন্টারে একদিন

শনিবার, ৬ জুন, ২০২০

ডা. আবুনাসের মোহাম্মদ ফয়েজ
মেডিক্যাল অফিসার, রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

আইসোলেশন সেন্টারের বাইরের গেইটে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে খুব একা লাগছে। সামনের ৩ তলা বিল্ডিংটি একদম নতুন। বিশাল বিল্ডিংয়ের নিচতলা স্বাস্থ্য কর্মীরা থাকেন, ২য় ও ৩য় তলায় রোগীরা থাকেন। ২য় ও ৩য় তলা রেড জোন, যা নিচতলার গ্রিন জোন হতে সম্পূর্ণ  আলাদা।

আশেপাশে কেউ নেই। দূর থেকে মানুষ সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। একটু পরে ক্লিনিং সুপারভাইজার শাহ আলম গেইট খুলে দিল। আমি মনে সংশয় নিয়ে ধীর গতিতে সামনে এগোতে থাকলাম। আমার ব্যাগ শাহলমের কাছে। তারপরও  নিজের পা গুলো অনেক ভারী মনে হচ্ছে, চলতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে বাবা, মা, বোন, ছেলে, বউয়ের, চেহারা ভেসে উঠছিল বারবার। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে পড়ল।

একটু দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। আমার ভয় পেলে চলবেনা। আমি ডাক্তার, আমি রোগীদের সেবা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সম্মুখে নিশ্চিত বিপদ জেনেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে বিসমিল্লাহ বলে সেন্টারে প্রবেশ করলাম।

ডা. রিপন, ডা. মানিক, ডা. তুশিত আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে আমার রুম দেখিয়ে দেওয়া হল। ছোট্ট রুম খুব পরিপাটি করে রাখা। আমি প্রবেশ করার পূর্বে সমস্ত রুম জীবাণু মুক্ত করা হয়েছে। বিছানার উপর ধবধবে সাদা চাদর, একটি টেবিল, একটি চেয়ার, এটাস্ট বাথরুম আছে। রুমটি আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। এইখানে আমাকে ১০ দিন থাকতে হবে। ডা. রিপন আর ডা. তুশিত ১০ দিনের ডিউটি শেষে বিদায় নিয়ে, ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে চলে গেলেন।

রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে আমি এমন একজন অভিভাবক পেয়েছি, যার কথা না বললেই নয়। তিনি সবার প্রিয় ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া স্যার, রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। একজন সাদা মনের মানুষ। রোগী এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আমাদের সকল আবদার, অভিযোগ, সমস্যা সব ওনার কাছে বলি। অনেক বড়মাপের সমস্যাও খুব সহজে সমাধান করে ফেলেন।

ভোর ৪ টায় ফোন দিলেও স্যার প্রথম কলে রিসিভ করেন। একবারের জন্যও বিরক্ত হন নি। স্যারের মত একজন উদার মনের মানুষ পেয়ে রামুবাসী সত্যিই ভাগ্যবান। আমার কপাল ভাল আরও কিছু ভাল মনের মানুষের সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ডা. ওয়ালিউর ভাই এবং ডা. কাউসার ভাই। দুজনেই মাটির মানুষ। এই আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠায় ওনাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে।

এই মূহুর্তে সেন্টারে আমি, ডা. মানিক আর ডা. ঋতু বড়ুয়া আছি। রুমটা নিজের মত করে গোছালাম। এরপর গোসল করে দুপুরের খাবার খেলাম। রান্নাটা খুব চমৎকার হয়েছে মুরগী ভুনা, ডাল আর সবজি। সিস্টার জেরিন নাকি রান্না করেছে। এরপর ডা. ঋতু আমাদের প্রতিদিনের কাজ বুঝিয়ে দিলেন। ডা. ঋতু সম্পর্কে একটু বলি। তিনি আমার জুনিয়র, অসাধারণ কর্মঠ একজন ডাক্তার। তিনি পিপিই পরে ৪-৫ ঘণ্টা এক টানা কাজ করতে পারেন। রোগীদের রাউন্ড দেয়া, মেডিসিন দেয়া, খাবার দেয়া, মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সে সক্রিয় ভুমিকা রাখে। একটু পরে ডা. ঋতু  আর ডা. মানিক রাউন্ডে চলে গেলেন। আমি মোবাইলে রোগীদের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কারও মাথা ব্যথা, কারও গলা ব্যথা, জ্বর, অনেকের ঔষধ লাগবে, গরম পানি লাগবে, কারও পার্সেল আসছে, কেউ আবার বলে স্যার ঘুম আসছে না, অনেক গরম লাগছে, মশা ডিস্টার্ব করছে, বাথরুমে পানি নাই। সবার সমস্যা ফোনে সমাধান করতে করতে রাত ১২.৩০ টা বাজল।

করোনা রোগীরা একটু সান্তনা চান, ওনারা চান কেউ একজন ওনাদের খবর নিক। বেশিরভাগ রোগী শারীরিক ভাবে যতটা না দূর্বল, মানসিক ভাবে তারচেয়েও অনেক বেশি বিপর্যস্ত। তাদের সাথে একটু ভালভাবে কথা বললে, তাদেরকে আশস্ত করতে পারলে, তাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। তাই করোনা রোগীকে ঘৃণা নয়, ভালোবাসুন।

আজকে আপনি সুস্থ আছেন। ২ দিন পরে আপনি, আমি আক্রান্ত হবো না, এইটার কোন নিশ্চয়তা নাই।

রাত ১টা, আগামীকালকের চাহিদা পত্র এখনো রেডি হয় নি। কি লাগবে, কি লাগবে না সবকিছু হিসাব করে চাহিদা পত্র পাঠানো হল। রাত ১.৩০ তিনজন ডাক্তারের কেউ ঘুমান নি। উপরের রাউন্ড শেষে নিচতলা এখনো পরিস্কার করা হয় নি। ডা. ঋতুর  তত্বাবধানে নিচতলা পরিস্কার করা হল। ঘড়িতে এখন রাত ২.৩০, সবার পেটে ক্ষিধা। খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে যাব, ঠিক ওই মূহুর্তে আমাদের প্রিয় ডা. নোবেল স্যারের ফোন। এম্বুল্যান্সে ২ জন পজিটিভ রোগী আসতেছে বেড রেডি করতে বললেন। সেই রোগীদের রিসিভ করে কাজ শেষ করতে করতে রাত ৩.৩০ বাজলো। মোবাইলটা পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল ৭.৩০টায় মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। রোগীদের সকালের খাবার আসছে গেইটে রিসিভ করতে হবে। ক্লিনাররা রাতে অনেক কষ্ট করছে তাই ওদের না ডেকে নিজেই খাবার রিসিভ করে নিয়ে আসলাম। এভাবে নতুন আরেকটি দিনের শুরু!

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ নমুনা প্রদানঃ চিকিৎসক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিএমএ'র নিয়মাবলি

Sat Jun 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন, ২০২০, শনিবার করোনা ভাইরাসের লক্ষণযুক্ত চিকিৎসক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কোভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষার নমুনা প্রদানের নিয়মাবলি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ)। আজ (৬ জুন) একটি চিঠির মাধ্যমে এ ব্যাপারে জানান বিএমএ মহাসচিব ডা. মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী। করোনা ভাইরাসের লক্ষণযুক্ত চিকিৎসক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo