শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের (শেবাচিম) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সজিব বাড়ৈ। জানা গেছে, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের এক শিক্ষকের মানসিক নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন এই শিক্ষার্থী।
মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষকের নিপীড়নের অভিযোগ এনে সজিবের সহপাঠী সুমন হালদার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “চলেন আজকে আপনাদের আজকে একটা ফুলের গল্প শোনাই, ঝড়ে পড়া ফুলের গল্প। কারন এদের গল্প কেউ শোনায় না। চাপা পড়ে যায় “ডাক্তার” নামক সফলতার ভ্রমের আড়ালে।
কেনো আসলে ঝড়ে পড়তে হলো সজীবকে? কারো কি দোষ ছিলো?
সজীব বাড়ৈ, আমার ব্যাচমেট, গ্রুপমেট, রুমমেট, আমার বন্ধু, আমাদের ভাই। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সবার থেকে আলাদা সে। কারো সাথে খুব একটা কথা বলতো না, চরম লেভেলের ইন্ট্রোভার্ট যাকে বলে। তবে এই ছেলেটিই সবার থেকে সেরা ছিলো সাহিত্যে, আকাঁআঁকিতে, আবৃত্তিতে। কোরিয়ান,জার্মান, চাইনিজ, সাংকেতিক ভাষাসহ ৪-৫ টা ভাষা শিখেছিলো শুধু শখের বশেই। প্রতিদিন নিয়ম করে ধর্মগ্রন্থ পড়তো। বলতো মন শান্ত হয় ধর্মগ্রন্থ পড়লে। একটা দিনের জন্যই বাদ যেতো না ওর অর্চনা করা।
কোথাও যেতে চাইতো না। রুমমেটরা মিলে জোর করে ধরে নিয়ে যেতাম কলেজের কালচারাল প্রোগ্রাম এ, আল্পনা আঁকাতে। যেই ছেলেটা কোথাও যেতে চাইতো না, সেই ছেলেটাই সবার থেকে ভালো করতো আমাদের থেকে এই সব ক্ষেত্রেই। ওর শুধুমাত্র একটা পজিটিভ পুশ এর দরকার হতো সব ক্ষেত্রে। ব্যাচের সবার কাছেই পরিচিত হয়ে উঠলো সবচেয়ে নম্র, ভদ্র জিনিয়াস হিসেবে।
১ম, ২য়, ৩য় বর্ষের সব এক্সাম ঠিকমত দিলো। বাধা হয়ে দাড়ালো ৪র্থ বর্ষের সেই ভয়াবহ কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা। আমাদের গ্রুপের প্রতিটা শিক্ষার্থীর উপর সে এক অমানুষিক মাইক্রোবায়োলজি অভিজ্ঞতা ছিলো। প্রতিদিন ক্লাসের শুরুতে বিনা কারনেই ওকে সামনে ডাকতো। কথা বলে না কেনো সেটা নিয়ে উল্টা পালটা কথা শোনাতো। আস্তে আস্তে চুপসে যেতে থাকলো। প্রায়শই ক্লাসের মাঝে বিভিন্ন টপিকের প্রশ্নের নাম করে সামনে ডাকতো, আবারো সেই সেইম কাহিনী, কেনো পারবি না তুই, সেটা বলে আরো কিছুক্ষন সবার সামনে বসে মজা নিতো। আমরা চুপ করে বসে থাকতাম বাধ্য গাঁ’ধার মত। আমাদের চামড়া হয়তো মানুষের ছিলো না, তাই আমাদের সাথে যা করতো মেনে নিতাম। কিন্তু ও ধীরে ধীরে আরো চুপ হয়ে যেতে থাকলো। এখনো মনে আছে যতদিন মাইক্রোবায়োলজি আইটেম ছিলো, ও একটাতেও উপস্তিত হতে পারলো না। আইটেমের দিন সকালে অসুস্থ্য হয়ে পড়তো। পেট খারাপ করতো। এটা ওর হারিয়ে যাবার প্রথম ধাপ।
ফার্স্ট এসেসমেন্ট এর ৩-৪ দিন আগে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লো। হাসপাতালে বসে রইলাম ওর পাশে। দিতে পারলো না এক্সাম। এরপর জোর করে এক্সাম দিতে নিয়ে যেতাম। আইটেম ম্যাম এর রুমের সামনে দাড়িয়ে থাকতো। আমি ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করতাম। ও দরজা দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকতো। আমি নিয়ে গেলাম সাইকিয়ার্টি স্যারদের কাছে।
“ ডায়াগনসিস: Major Depressive Disorder“ ছেলে অসুস্থ্য! পাগল! অথচ কেউ খুজতে গেলাম না এর পিছনের ট্রিগারিং পয়েন্ট কি ছিলো। কোনো দরকার কি আদৌ ছিলো এভাবে ইন্ট্রোভার্ট একটা ছেলেকে সবার সামনে নিয়ে বারবার অপমান করার? দোষ তো আসলে সজীবের সে মেডিকেলে পড়তে এসেছিলো। ওর মৃত্যুর জন্য তো ও নিজেই দায়ী।
অদ্ভুত ছেলে একটা সজীব। টেরোরিয়াম ছিলো, মাছ ছিলো, পিপড়াদের খাবার দিতো নিয়মিত, ২২ প্রজাতির গাছ ছিলো ওর কাছে। গাছের দিকে, মাছের দিকে তাকিয়ে থাকতো। হয়তো ওদের মাঝেই খুজে বেড়াতো নিজেকে। আমাকে বলেছিলো ওর টেরোরিয়ামে হাইড্রা আছে, ও হাইড্রার মত হতে পারলে নাকি ভালোই হতো, নতুন করে আবার জন্ম নিতো ওর ভগ্নাবশেষ থেকেই। ছেলেটা হাইড্রা হতে পারলো না। হারিয়ে গেলো। কিন্তু হারিয়ে যাবার আগে ওর প্রত্যেকটা গাছ, মাছ, টেরোরিয়ামের কিভাবে যত্ন করতে হবে, অথবা যত্ন না করতে পারলে কাকে কাকে ডোনেট করতে হবে সব লিখে গেছে খাতায়। কি অদ্ভুত এক পাগল ছেলে! মৃত্যুর সময়ও দায়িত্বজ্ঞান ভোলেনি। পিপড়াদের খাবার দিতে লিখে গেছে, গাছগুলোকে পানি দিতে লিখে গেছে, মাছের জন্য কিভাবে পানির কোয়ালিটি কন্ট্রোল করতে হবে সেটা পর্যন্ত লিখে ওর ডাইরীর শেষ পৃষ্ঠাগুলোতে। কি অদ্ভুত তাইনা?
সজীবের আরো বড় অপরাধ ছিলো সে ওদের পরিবারে জন্ম নিয়েছিলো, যেখানে ওকে বোঝার মত আদৌ কেউ ছিলো কিনা মনে পড়ছে না। ছেলে মানসিক সমস্যা, মানে পাগল হয়ে গেছে। পানি পড়া, কবিরাজ চালাতে লাগলো গোপনে। অথচ ওনাদের হাজারবার বুঝিয়েছি আমি ও আমার রুমমেটরা মিলে। যে ও অসুস্থ্য, ওর শুধু আপনাদের সঙ্গটা দরকার। শুধু এক বছর বা ৬ মাস ওরে সময় দিন, ওর সাথে থাকেন। তাদের আর সময় হয়ে ওঠেনি ওকে দেয়ার মত। বললাম আপনারা তাহলে ওকে বাড়িতে নিয়ে রাখেন, তারা বললেন বাড়িতে থাকলে ঝগড়া হয়, তার থেকে বরিশালেই থাকুক, পড়াশোনা করুক বরিশাল বসে। আমি বারবার ফোন দিয়ে ওদের পরিবারের সবাইকে বোঝাতে লাগলাম গত ২ বছর ধরে।
সময়ের বড্ড অভাব তাদের। বুঝালাম সময় ঠিকই দিবেন একটা সময়, যখন ছেলে আর ঠিক হবার মত অবস্থায় থাকবে না। ওনারা বললেন, যা হবার হবে, সব ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিছেন।
তবে কাকতালীয় বিষয় হলো যেদিন রাতে ও এই সুইসাইড এটেম্পট করলো সেদিন সন্ধ্যায় আমি ওর বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম আবারও। বললাম “আপনাদের হাজারবার বলেছিলাম যে পরীক্ষার ১৫ দিন আগে অন্তত এসে ওর সাথে থাকবেন বা ওকে নিয়ে যাবেন বাসায় বসে পড়ার জন্য, আপনাদের জন্য আমি ওর পাশে বেড পর্যন্ত রেডি করে রাখছি। সেখানে এসে থাকবেন বলে। তাহলে কেনো এলেন না?”
উত্তর কি ছিলো জানেন? তাদের সময় হবে না, ওর দাদারও নাকি কাজ আছে। এক্সামের রুটিন তাদের কাছে আছে, প্রত্যেক এক্সামের ১ দিন আগে ওর দাদা আসবেন।
২১ মে ২০২৫ তারিখে ওর প্রথম পরীক্ষা ছিলো। নিজেদের কথামত ওর দাদা, বাবা দুজনেই এলেন পরীক্ষার ঠিক একদিন আগেই। কিন্তু পরীক্ষা দেয়ানোর জন্য না, ছেলের মৃতদেহটা নিতে।
পুরো পরিবারটাকে কষ্ট দিয়ে অনেক অভিমান নিয়ে চলে গেলো সজীব।
সবথেকে বড় দোষীটা হয়তো আমিই। ২ বছর ধরে চেষ্টা করেও ওর ফ্যামিলিকে বোঝাতে পারিনাই ওর একটু সময়ের খুব দরকার তাদের থেকে। আমাদের সামনে বসেই মাইক্রোবায়োলজির স্যার বিনা কারনে অপমান করে যেতো, সেটা দেখেও ক্লাসের সবাই চুপ করে থাকতাম, এটা বড় অপরাধ ছিলো। আরও বড় অপরাধ হয়তো তোর বিশ্বাস অর্জন করতে না পারা। ঘন্টার পর ঘন্টা ছাদে নিয়ে হাটতাম ওর, বাইরে নিয়ে যেতাম জোর করে হাটতে। শুধু কথা বের করার জন্য, যাতে নিজের খোলশ থেকে বের হতে পারে।
আমি ব্যর্থ রে ভাই। হয়তো আমি আরেকটু চেষ্টা করলে তোকে হারাতাম না আমরা। হয়তো আরেকটু বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে এসব করার আগে আমাকে একটাবার বলতি তুই। হয়তো আমি আরেকটু চেষ্টা করলে ICU তে তোর পাশে বসে তোর শেষ নিশ্বাস গুলো দেখতে হতো না আমায়।
ক্ষমা করে দিস তোর এই বন্ধু, তোর এই ভাইটাকে।
আমি কাঁদছি না, কিন্তু বুকটা ভেঙে যাচ্ছে রে ভাই, বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।”