করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবুজ হলুদ লাল এলাকা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন ২০২০, শনিবার

ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম শামীম
সহযোগী অধ্যাপক, ইপিডেমিওলজি
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর

কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রনে অর্থাৎ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সমগ্র বাংলাদেশকে সংক্রমণের মাত্রা ও বিস্তৃতি অনুসারে লাল, হলুদ এবং সবুজ এই তিনটি রং এর অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করে জোনভিত্তিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।

পত্রিকান্তরে যতদূর জেনেছি এই তিন রং এ চিহ্নিত করার বিষয়টি নির্ভর করবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার উপর। যেমন- ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর এবং চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ তাই এই অঞ্চলটি হতে পারে লাল রং চিহ্নিত অঞ্চল যেখানে করোনা সংশ্লিষ্ট কঠোর জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অন্য যে সকল অঞ্চলে সংক্রমণ তুলনামূলক কম ওগুলোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ বা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হতে পারে। লাল অঞ্চল থেকে হলুদ অঞ্চলে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হবে এবং সেখানে শুধুমাত্র করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর বাড়ি বা তার চারপাশে লকডাউন কার্যকর করা হবে। সবুজ রং চিহ্নিত অঞ্চলে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে যেন এই অঞ্চলে বাইরের থেকে রোগটির সংক্রমণ না ঘটতে পারে।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো এই বিষয়টি ট্রাফিক বাতির মত নিয়মিত এবং সহজ নিয়মে ব্যাখ্যা করা যাবে না, যেমন লাল বাতি দেখার কিছুক্ষণ পর হলুদ বাতি তার একটু পর সবুজ বাতি। এক্ষেত্রে এমনও হতে পারে লাল এলাকা দীর্ঘ সময় লাল হয়ে থাকতে পারে, হলুদ যখন সবুজ হওয়ার কথা তখন লাল হয়ে যেতে পারে।

ভারতে চর্তুথবারের মত দেশজুড়ে লকডাউন দেওয়ার সময়কার নীতিমালায় লাল, কমলা এবং সবুজ এই তিনটি রং-এ প্রাদেশিক এবং অঞ্চলভিত্তিক বিভাজনের একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত মে মাসের ১৭ তারিখে ভারতের সম্মিলিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক এই বিভাজনের এর জন্য নিম্নোবর্ণিত প্যারামিটারগুলোকে তালিকাভুক্ত করেছেঃ

১/মোট কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যাঃ
মোট সক্রিয় কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ২১ দিনে ২০০ বা এর বেশি হলে ধরা হয়েছে সংক্রমণের মাত্রা গুরুতর এবং ২১ দিনে শূণ্য সক্রিয় রোগীর সংখ্যাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বেঞ্চর্মাক ধরা হয়েছে।

২/কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দ্বিগুন হওয়ার হারঃ ১৪ দিনের কম সময়ে বা ১৪ দিনের মধ্যে যদি কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দ্বিগুন হয় তবে তা গুরুতর এবং দ্বিগুন হতে যদি ২৮ বা ততোধিক সময় লাগে তাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বেঞ্চর্মাক ধরা হয়েছে।

৩/মৃত্যুহারঃ আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৬ জন বা ততোধিক মৃত্যুকে গুরুতর এবং শতকরা ১ জনের কম রোগীর মৃত্যুকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বেঞ্চর্মাক ধরা হয়েছে।

৪/ প্রতি লাখ জনসংখ্যায় সনাক্তকৃত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যাঃ
এখানে ১ লাখ জনগোষ্টীতে সনাক্তকৃত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ১৫ জনের বেশি হলে সংক্রমণের মাত্রা গুরুতর ধরা হয়েছে।

৫/ নমুনা পরীক্ষার অনুপাত (নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা/ প্রতি লাখ জনসংখ্যা)ঃ ৬৫ /১০০০০০ কে গুরুতর অবস্থা এবং ২০০/১০০০০০ কে গ্রহণযোগ্য নমুনা পরীক্ষার সংখা হিসেবে বেঞ্চর্মাক ধরা হয়েছে।

৬/পজিটিভ নমুনা সনাক্তের হার: ৬% এর বেশি গুরুতর এবং ২% এর কম হলে তা গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে থাকবে।

উল্লেখিত বেঞ্চর্মাক বা নির্ধারিত পরিমাপক সীমার বিষয়ে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বেঞ্চর্মাক আঞ্চলিক কোভিড-১৯ এর পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তণশীল।
লাল, হলুদ এবং সবুজ এই তিনটি অঞ্চল ছাড়াও তারা সংযমন অঞ্চল [ ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপদজনক পরিস্থিতিতে আইন দ্বারা সংরক্ষিত এলাকা containment area ] এবং বাফার অঞ্চল [ তারা সংযমন অঞ্চল এবং নিরাপদ অঞ্চল এর মধ্যবর্তী এলাকা] নামে আরও দুটি অঞ্চল চিহ্নিত করেছে। আঞ্চলিক রোগ সংক্রমণ বোঝার জন্য এবং তা রোধ করার উদ্দেশ্যে সংযমন অঞ্চলটি তৈরি করা হয়েছে।

পজিটিভ কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া গেছে এমন বাড়ি বা কয়েকটি একত্রিত বাড়িকে সংযমন অঞ্চলের এপিসেন্টার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এপিসেন্টার জুড়ে চারপাশের আধা কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা ঘেরাও করে সেখানে শুধুমাত্র অত্যাবশ্যকীয় সেবাসমূহ ব্যতীত অন্য সকল কার্যক্রম লকডাউনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। সংযমন অঞ্চলটিতেই রোগ প্রতিরোধের জন্য নিবিড় জনস্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিকবিধি পালন করা হবে তাই সংযমন অঞ্চলের সীমানা নির্বাচনে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসনের মতামতের উপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। সংযমন অঞ্চল নির্ধারিত হয়ে গেলে এর ভিতরে প্রবেশপথ এবং বের হওয়ার পথ নির্দিষ্ট করতে হবে এবং কঠোরভাবে এর ভিতরে চলাচলের ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।যেমন চিকিৎসা সেবা এবং অত্যাবশ্যকীয় সেবা ছাড়া কোন বহিরাগত জনগণের প্রবেশাধিকার থাকবে না। এই অঞ্চলের অর্ন্তভুক্ত মানুষের চলাচলের রেকর্ড রাখতে হবে এবং সার্বক্ষণিক সমন্বিত ডিজিস সার্ভিলেন্স এর আওতাধীন থাকতে হবে।

এই সংযমন অঞ্চলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ দল দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং এর নীতিমালা মেনে রোগী সনাক্তকরণের কাজ পরিচালনা কবে। স্থানীয় মানুষের সহযোগীতায় রোগী সনাক্তকরণ এবং কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা যাবে। এই অঞ্চলে রোগ সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকির্পূণ বিষয়গুলো নিয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়মিত প্রচার করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বয়স্কদের এবং যারাঙ্অগাগে থেকেই অসংক্রামক রোগে ভুগছেন তাদের বিষয়ে বিশেষ মনযোগ দিতে হবে।

বাফার অঞ্চল হল সংযমন অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকা যেখানে রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। রোগের সংক্রমণ রোধে এই এলাকায় উপসর্গ যুক্ত ও গুরুতর শ্বাসকষ্টের রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করা হবে।কার্যকরভাবে রোগের বিস্তার রোধ করতে হলে বেশ বড় আকারে বাফার অঞ্চল নির্ধারণ করতে হবে।

বাংলাদেশ এর জন্যে হুবহু এসব প্যারামিটার মেনে জোনিং কতটা বাস্তব সম্মত সেটা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। রোগীর ঘনত্ব বুঝার জন্যে কোন নির্দিষ্ট এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব জানতে হবে। সেখানকার প্রশাসনিক অবকাঠামো , সেটা কি ধরনের এলাকা, যেমন; এটা কি শিল্পাঞ্চল, ব্যাবসাপ্রধান, রেসিডেন্সিয়াল, শহর, উপশহর এই বিষয়গুলো আমলে নেয়া জরুরী। এছাড়াও সেখানে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা, এবং কত শতাংশ মানুষ নমুনা পরীক্ষার আওতায় আছে , আক্রান্তের কত অংশ সুস্থ হচ্ছে কত অংশ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, কত অংশ মৃত্যু বরণ করছে, সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা , ঐ এলাকার সাথে অন্য এলাকার যোগাযোগ এর ব্যবস্থা এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখা উচিত।

বাংলাদেশে এই কালার কোডিং পদ্ধতিতে অঞ্চলভিত্তিক ব্যবস্থাপনা শুরু করার জন্য প্রথমেই যেটা প্রয়োজন মনে করি তা হলো, রোগতত্ত্ববীদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিসংখ্যানবীদ, অর্থনীতিবীদ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা। তাঁরা বাংলাদেশের সমাজ, পরিবেশ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপযোগী প্রয়োজনীয় প্যারামিটার নির্ধারণ করবেন এবং বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত বেঞ্চর্মাক প্রস্তুত করবেন। এগুলো এমনভাবে ঠিক করতে হবে যেন, জোন নির্দিষ্ট করার পরিমাপক /প্যারামিটার গুলো সহজে নির্ধারণ যোগ্য হয়, এই সংক্রান্ত তথ্য যেন নিয়মিত ও নির্ভুল হয় । এছাড়াও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা খুবই জরুরী। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়ন করা গেলে আশা করা যায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের বর্তমানের উর্ধ্বমুখী ধারা ক্রমশই নিচের দিকে নেমে আসবে।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

"আব্বুর কোভিড-১৯ জয়ের গল্প"- প্রথম পর্ব

Sat Jun 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন ২০২০, শনিবার সায়লা আক্তার রিমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (ডেন্টাল ইউনিট) সেশনঃ ২০১৬-১৭ গত ১১ই মে ২০২০, ১৭ তম রোজার সেহেরী করতে উঠি। আম্মু বললো আব্বুর জ্বর, সেহেরী করবে না। আমি ভাত খেয়ে ডাবল মাস্ক,গ্লাভস আর চশমা পরে আব্বুর রুমে গেলাম, সাথে একটা থার্মোমিটার নিলাম। আব্বুর জ্বর […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo