X

বেঁচে আছেন জেরিন , কিন্তু নেই তাঁর কোনো বোধবুদ্ধি

স্ত্রীর স্মৃতি ফেরার অপেক্ষায় স্বামী চিকিৎসক মুনতাহিদ আহসান।

চিকিৎসক মুনতাহিদ আহসান বলছিলেন, ‘গত সোমবার ছিল আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী কেটেছে হাসপাতালে। এবার আমরা বাসায়। ওকে অনেক ডাকাডাকি করলাম। ওর সঙ্গে ছবি তোলার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও তো ক্যামেরার দিকে তাকায় না। ছবিটা ভালো হলো না। দুজনের আগের ছবি দেখি, আর মন খারাপ হয়।’

একরাশ হতাশা নিয়ে মুনতাহিদ বলেন, ‘শুধু একবারই ওর হাত ধরে বিবাহবার্ষিকী পালন করলাম। এখন বিবাহবার্ষিকী আর কীভাবে করব? ও যে বেঁচে আছে, শুধু এইটুকুও যদি বুঝত।’ তাঁর স্ত্রী চিকিৎসক সানজানা জেরিন। বিয়ের এক বছর পাঁচ মাসের মধ্যে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে শুধু নিজের জীবনটাই নয়, সংসারও তছনছ হয়ে গেছে।
২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট সানজানা জেরিনের ফেনীতে কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। ভোর ছয়টার দিকে তিনি রিকশায় করে স্বামীর সঙ্গে যাচ্ছিলেন। রাজধানীর কমলাপুরে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাদা রঙের একটি ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে এক ছিনতাইকারী জেরিনের হাতব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। এতে জেরিন ১০-১৫ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। ‘আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা, আমার মাথার সিটিস্ক্যান করাও’ বলেই জ্ঞান হারান জেরিন। এটাই ছিল স্বামীর সঙ্গে জেরিনের শেষ কথা। এরপর থেকে তিনি নির্বাক। এখন শুধু মাঝে মাঝে হাত ও পা একটু নাড়ান। জেরিনের মাথায় অস্ত্রোপচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) দুই মাস ছিলেন। তারপর ভারত ও কলকাতার হাসপাতালে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা করান মুনতাহিদ। কিন্তু অবস্থার আর উন্নতি হয়নি।
এখন জেরিন বেঁচে আছেন। তবে তাঁর কোনো বোধবুদ্ধি নেই। কাউকে চিনতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারেন না। ঢোক গিলতে পারেন না। পেটের ভেতরে নল লাগিয়ে নিয়ম করে দৈনিক আড়াই লিটার স্যুপ আর দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। গলার মধ্যে ট্রাকিওস্টমি যন্ত্র লাগানো। তাই দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন।
এই দম্পতি কেমন আছেন তা জানতে গতকাল মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ীতে বাসায় গিয়ে মুহূর্তেই থমকে যেতে হলো। বাইরের ঘরেই একটি হুইলচেয়ার। ভেতরের ঘরে ঢুকতেই মনে হলো কোনো হাসপাতালের কেবিন। হাসপাতালের মতোই রোগীর বিছানা, পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। নানা রকমের যন্ত্রপাতি। তিনি বিছানায় উঁচু বালিশে হেলান দেওয়া অবস্থায়। চোখ খোলা। তবে কোন দিকে তাকিয়ে আছেন তা বোঝা বা জানার কোনো উপায় নেই। একটু পরপর ছোট বাচ্চাদের মতো কান্নার ভঙ্গি করেন। তখন স্বামী বা শাশুড়ি গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে ধরে একটু আদর করে দিচ্ছেন। অদর-স্নেহের স্পর্শে কান্নাটা থামে। বাচ্চাদের মতোই ডায়াপার পরিয়ে রাখা হয়। ফিজিওথেরাপিস্ট আসেন প্রতিদিন। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি তাঁকে দেখার জন্য একজন আয়া রাখা হয়েছে। জেরিনের ঘরেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাঁদের বিয়ের ছবি। মাথার কাছে দেয়ালে ঝুলছে কোনো এক শিল্পীর আঁকা জেরিনের হাসিমুখের একটি ছবি।

মুনতাহিদ বলেন, ‘ওর কথা মনে হলে শুধু এখনকার চেহারা দেখতে পাই। জেরিনের আগের ছবিগুলোই শুধু মনে করিয়ে দেয় তাঁর আগের চেহারা।’ ৩৩তম বিসিএস উত্তীর্ণ এই দম্পতি চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। এখন মুনতাহিদ চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কুমিল্লায়।

মুনতাহিদ বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। মুনতাহিদ ও জেরিন পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ভালোবেসে বিয়ে করেন। মুনতাহিদ বলেন, ‘সংসার কাকে বলে তাই তো বুঝতে পারলাম না। বিদেশে হানিমুনে যাওয়ার জন্য টাকা জমিয়েছিলাম, যাওয়া হয়নি। জমানো টাকা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করাই। এখন প্রতিদিন স্ত্রীর বিছানার পাশের মেঝেতে ঘুমাই। ওর বুকে কফ জমে গেলে কষ্ট হয়। তখন বিকট শব্দ হয়। তাই রাতে একটু পরপর কফ বের করে দিতে হয়। ফলে আমারও ঘুম হয় না।’

মুনতাহিদের আফসোস একটাই—স্ত্রী যদি শুধু একটু বুঝতেন তিনি বেঁচে আছেন। সবাই তাঁর পাশে আছেন। মুনতাহিদ জানালেন, এক সপ্তাহ আগে জেরিনের বাবা মারা গেছেন। কিন্তু জেরিন কিছুই বুঝতে পারেননি। জেরিনের যখন ১০ বছর বয়স, তখন তাঁর মা মারা যান। এখন শুধু এক ভাই আছেন। ঘটনার পর মুগদা থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে মামলা করেছেন মুনতাহিদ। কিন্তু মামলার কোনো অগ্রগতি নেই।

জেরিনের চাহিদা ছিল খুবই কম। সময়ের কাজ সময়ে করতে ভালোবাসতেন। গোছানো জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। এখন পুরো জীবনটাই অগোছালো হয়ে গেছে। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করা জেরিনের বাবার শখ ছিল মেয়ে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে। সেই স্বপ্নটাও পূরণ হলো না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর তহবিল থেকে জেরিনকে ১০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। এর বাইরে স্বামী, পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা জেরিনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

মুনতাহিদ জানালেন, বিএসএমএমইউ ও দেশের বাইরের চিকিৎসকেরা বলেছেন, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। জেরিন যদি কখনো স্মৃতিশক্তি ফিরে পান, এখন চলছে সেই প্রতীক্ষা।

সুত্র ঃ প্রথম আলো,১৬ মার্চ, ২০১৬

Ishrat Jahan Mouri: Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation
Related Post