X

দেশ-বিদেশ, ডাক্তারী ও কিছু কথা || পর্ব-১

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৩০ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার

ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস. (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান।

ইদানীং বেকার জীবন কাটাচ্ছি। ফেসবুকে অনেক বেশি একটিভ থাকা হয়, আর নানা পোস্ট চোখে পড়ে। একটা কমন অভিযোগ চোখে পড়েছে, গাইনী ডাক্তাররা এমন তেমন। আবার গাইনী ডাক্তাররাও খুব অভিমান ভরে বলছেন, এতো কষ্ট করার পরও এতো অভিযোগ! ‘অবস-গাইনী’ আমার ভালোবাসার সাব্জেক্ট। তবে তিনটি দেশে ডাক্তার-রোগি দুই পক্ষে থাকার অভিজ্ঞতায় কিছু বলছি।

অবস-গাইনী ডিপার্টমেন্ট নিয়ে ঝামেলা কম বেশি সব দেশেই আছে। এই ডিপার্টমেন্টের রোগীরা খুব দূর্বল মুহুর্তে আমাদের কাছে আসে, হয় তার গোপনতম সমস্যাটি নিয়ে, না হয় প্রেগন্যান্সির সময়। এই সময় যে তার সাথে পছন্দসই কথা বলবে, তাকে তার ফেরেশতা মনে হবে। যে একটু খারাপ ব্যবহার করবে, তার চেয়ে দুর্জন আর কেউ থাকবে না। একজন ডাক্তার আমার রোগীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন, তার মানে উনি ১০০% খারাপ আর উনি আমার রোগির সাথে ভাল ব্যবহার করেছেন, তাই খারাপ হতেই পারেননা- এই “all or none law” আমাদের ডাক্তাররাও যদি বলা শুরু করেন, মুশকিলের ব্যাপার।

ওমানে থাকতে দেখেছি, রোগির সদ্যোজাত বাচ্চা মারা যাওয়ার পর, ডাক্তারের মন খারাপ পর্ব শেষ না হতেই- আবার রোগী পক্ষের নালিশ সামলাতে কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি। গাইনী ডাক্তারদের যে পরিমাণ হাজিরা দিতে হয় এসব বিচার সালিশে (সিস্টেমিক), অন্য কোন ডিপার্টমেন্টে এই ঝামেলা নাই। কিন্তু কারো সাহস নাই প্রকাশ্যে তাকে হ্যারাস করার। বড়জোর হোয়াটসঅ্যাপে নিজেদের মধ্যে মেসেজ চালাচালি।

সমস্যা আমাদের সিস্টেমে। আমাদের দেশে রোগীদের অভিযোগ জানানোর প্রোপার কোন সিস্টেম নাই, সেটা আগে করা দরকার (নামকাওয়াস্তে বি.এম.ডি.সি. আছে জানি), যেটাতে রোগী এবং ডাক্তার সুযোগ পাবে নিজ নিজ কথা বলার। তার আগে সোস্যাল মিডিয়াতে, মিডিয়া ট্রায়ালের চেষ্টা করলে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা থাকতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে যে সন্মান অর্জন করেছেন, তা একটা পোস্ট দিয়ে ভূলুন্ঠিত করা যাবেনা।

কাউন্সেলিং এর অভাব আমাদের ডাক্তারদের মধ্যে সার্বজনীন। কিন্তু ভেবে দেখুনতো, মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ঠিক কখন কাউন্সেলিং নিয়ে পড়েছেন বা পড়লেও কতটা গুরুত্ব দিয়ে? আমাদের অনেক ডাক্তাররা যে কাউন্সেলিং করেন, তা অনেকটাই নিজ গুণে, অথচ আমাদের গ্র‍্যাজুয়েশন বা পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশনে ক্লিনিক্যাল বিষয়ের চেয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে তা জানার কথা না। একজন ডাক্তার তো সমাজ থেকেই আসেন। সমাজে যেমন সব শ্রেণির মানুষ আছেন, ডাক্তারদের মধ্যেও তাই থাকবে, শিক্ষার গুণে তার হার একটু কম হতে পারে!

আমার ভাবিকে যখন PROM হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে যাই, ম্যাডাম কোন ব্যাখ্যা বা অনুমতি ছাড়াই পি ভি শুরু করতে যান। ভাবি তিন লাফ দিয়ে বিছানার উপর দিকে উঠেন। ম্যাডাম প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলেন,

“এরকম করলে কিভাবে নরমাল ডেলিভারি হবে? তোমরা কনসেন্ট দিলে সিজার করে ফেলবো, এ নরমাল ডেলিভারি সহ্য করতে পারবে না।”

আমি তখন সদ্য এম.বি.বি.এস. পাশ, আমার নিজেরও ভাবির উপর মেজাজ খারাপ হয়। বাসার সবাইকে বুঝাই, সিজার হয়ে যায়। ম্যাডাম এমনি বেশ ভালো মানুষ এবং ডাক্তার। কিন্তু পরবর্তীতে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, একজন মানুষ ডেলিভারির জন্য এসেছে মানেই তাকে ধুম করে পি ভি করে ফেললাম, এটা কি ঠিক? তার আগে ছোট্ট দুই লাইনের কথার গুরুত্ব অপরিসীম।

কানাডায় একজন ডাক্তারের সাথে কানাডিয়ান অভিজ্ঞতার জন্য তার চেম্বারে বসা হয়েছে কিছুদিন। এক রোগী আসার পর তাকে অনুমতি নিয়ে কথা বললাম। একটু পরে বুঝলাম রোগী কিছু একটা বলতে ইতস্তত করছে। তার চোখে পানি। কিন্তু ক্লিনিকের পুরুষ ডাক্তারকে (যার সাথে আমি কাজ করছি) সে কিছু বলতে চায় না। পরে একজন মহিলা ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট আসলেন। তিনি দুইটা লাইন বলার পর রোগী কান্নায় ভেঙে পড়লো এবং গড়গড় করে সব বলতে শুরু করলো। তিনি যা বলেছিলেন তা হলো,

“I can see you are going through a difficult time. Do you want to share anything? I would like you to know, everything you say will be strictly confidential.”

এটা একটা ম্যাজিক লাইন। নতুন ছিলাম বলে জানতামনা।So pls don’t underestimate the power of a simple line. It can be the magic line.

Sarif Sahriar:
Related Post